সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সায়ন্তন: আমার পরের প্রশ্ন ওয়েস্টার্নের রাজনৈতিক থিম নিয়ে। ওয়েস্টার্ন নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই বারবার ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনির প্রসঙ্গ চলে আসে। বিশেষ করে প্রথম দিকের একের পর এক ওয়েস্টার্ন ছবিতে সাম্রাজ্যবাদ আর ঔপনিবেশিক জবরদখলের প্রতি ঘোষিত সমর্থন আছে। তাহলে আজকের দিনে বসে – যখন আমরা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক বেশি সচেতন – ওয়েস্টার্নের মত আপাতদৃষ্টিতে ভয়ানক প্রবলেমেটিক একটা জঁরকে কি আদৌ অ্যাপ্রিসিয়েট করা যায়? করলে কীভাবে করব? প্রশ্নটা যেকোনো মার্কিন জঁর নিয়েই করা যেত, কিন্তু আলোচনাটা যেহেতু ওয়েস্টার্ন নিয়ে – আর ওয়েস্টার্নে এই জবরদখলের গল্পকেই যেহেতু ওরিজিন মিথ হিসেবে তুলে ধরা হয় –
অরূপরতন: এটা ওয়েস্টার্নের একটা প্রবলেমেটিক দিক, এখনই এর যুৎসই উত্তর দিতে পারব কিনা জানি না। আমার মাস্টার্স ডিসার্টেশনে আমি একটা আর্গুমেন্ট করেছিলাম – সেটা এখন করলে হয়তো আরো মাপজোক করে করতাম: এমনটা বলাই যায় যে আসলে সব আমেরিকান ছবিই ওয়েস্টার্ন, এধরণের হোলিস্টিক আর্গুমেন্ট মাথায় আসতেই পারে। যেমন লিন্ডা উইলিয়ামসের একটি বই, প্লেয়িং দ্য রেস কার্ড (২০০১, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস) -এ দাবি করা হয়েছে যে সব আমেরিকান ছবি আদতে মেলোড্রামা। এরকম হোলিস্টিক তর্ক গা-জোয়ারি করে চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তার অনেক সমস্যা আছে। ওয়েস্টার্নের মৌলিক বিশেষত্ব হিসেবে যেগুলোকে ধরে নেওয়া হয়, যেমন আমেরিকান আইডেন্টিটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা, একধরণের কমিউনিটি আর কিনশিপকে তুলে ধরা, সেগুলো ওয়েস্টার্ন নয় এমন অনেক ছবিতেই পাওয়া যাবে, তা বলে তাদের ওয়েস্টার্ন বলে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি। ওয়েস্টার্নকে আমরা একটা আলাদা ক্যাটিগরি হিসেবেই দেখব।
এবার তোর প্রশ্নে ফিরে আসি। আজকের দিনে যেকোনো ক্লাসিকাল আমেরিকান ছবি নিয়েই এরকম কূটপ্রশ্ন উঠবে, যে ছবিটা কেন দেখব – কলেজের ক্লাসরুমে যদি হিচককের কোনো ছবি দেখানো হয় তখন স্টুডেন্টদের মধ্যে কেউ বলতেই পারে এই ছবি দেখানোর দরকারটা কী। প্রশ্নটা যে সবসময় অন্যায্য তা নয়। যেমন আমার প্রায়শই মনে হয় – দ্য বার্থ অফ আ নেশনের (ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ, ১৯১৩) মত একটা ছবি, যাতে রেসিসম নিয়ে বিন্দুমাত্র রাখঢাক নেই, আজকের প্রেক্ষিতে তার রেলিভেন্স কোথায়? ছবিটার আঙ্গিকগত অর্জন নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না, কিন্তু তার বাইরে গিয়ে বার্থ অফ আ নেশন -কে অ্যাপ্রিসিয়েট করা যায় কি? এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে যখন আমরা ঐ ছবিগুলো পড়ব, আমাদের এই সমস্যাগুলো সম্বন্ধে সচেতন থেকে পড়া দরকার।
আমার নিজের একটা হাইপোথিসিস আছে, সেটা বলি। প্রত্যেকটা আর্ট ফর্ম জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়। সেই প্রশ্নগুলোর প্রাসঙ্গিকতার একটা সময়সীমা থাকে, অর্থাৎ এমন নয় যে সব প্রশ্ন সবসময় রেলিভেন্ট থাকছে। যেমন, ‘সিনেমা কি আর্ট?’, ‘সিনেমা কি সিরিয়াসলি আলোচনা করার মত জিনিস?’ – এই প্রশ্নগুলো কি আজকে খুব রেলিভেন্ট? আজ থেকে একশো বছর আগে তামাম লোকজন এই নিয়ে লিখে তার মীমাংসা করে ফেলেছে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু একটা সময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা ছিল – তখন সিনেমা যে শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, সেটা প্রমাণ করার জন্য কিছু ছবি তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছিল। গ্রিফিথের বার্থ অফ আ নেশন সেরকমই এক ছবি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবিতে প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে যে সিনেমা উপন্যাসের মতই জটিল ন্যারেটিভ বুনতে পারদর্শী একটা মিডিয়াম। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটা আমার কাছে ততটাও জরুরি নয়।
কিন্তু আমরা ইতিহাসের ঠিক কোন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি, কী করে এখানে এলাম, সেটা বুঝতে গেলে তো ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো ছাড়া গতি নেই, তাই না? যারা সিনেমা নিয়ে সিরিয়াসলি চর্চা করছে, তাদের ওপর এই দায়টা বিশেষভাবে বর্তায়। একই জিজ্ঞাসা নিয়ে বারবার আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের কাছে, নতুবা সবই ‘মন্দির উওহি বানায়েঙ্গে’ হয়ে যাবে, কার মন্দির, কার জমি – সেসব নিয়ে তর্ক করার আর জায়গাই থাকবে না। ইতিহাসকে না জেনে খরচার খাতায় ফেলে দিলে তো খুব মুশকিল। তাহলে তো লেনি রিফেনস্টালে হাতই দেওয়া যাবে না (রিফেনস্টাল একজন কুখ্যাত জার্মান পরিচালক, অ্যাডলফ হিটলারের স্নেহধন্যা, থার্ড রাইখের জন্য একাধিক প্রোপাগ্যান্ডা ছবি বানিয়েছিলেন), ব্যাপারটা এরকম নয় যে রিফেনস্টাল যা দেখিয়েছেন সে’ সব সত্যি। আমি মোটেই এরকম দাবি করছি না। আমার বক্তব্য হল – ছবিটা আগে মন দিয়ে দেখ, তার ফর্মটাকে দেখ; সিনেমার পক্ষে কতদূর কী করা সম্ভব সেটা সম্বন্ধে সবসময় সচেতন থাকা দরকার, যাতে অন্য কোনো ছবিতে স্বৈরতন্ত্রী বা ফ্যাসিস্ট প্রবণতা থাকলে সেটাকে চিনে নিতে ভুল না হয়। এই সূত্র ধরেই আমরা যেখানে আলোচনাটা শুরু হয়েছিল সেখানে ফিরে যাই। আমার ধারণা আমেরিকাকে বুঝতে গেলে ‘ওয়েস্টার্ন’-কে বুঝতেই হবে, না বুঝলে চলবে না।
এবার আর কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই আমি নিজে একটা কথা পাড়ি – রিসেন্টলি ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ছবির ক্লিপ চোখে পড়ল। ছবিটা হচ্ছে, জুরাসিক পার্ক সিরিজের যে দ্বিতীয় ট্রিলজিটা রয়েছে – জুরাসিক ওয়র্ল্ড – তার শেষ পার্ট। ছবিগুলো ন্যাচারালি খুব খাজা! সে যাই হোক। শেষ ছবিটার নাম জুরাসিক ওয়র্ল্ড ডোমিনিয়ন (কলিন ট্রেভেরো, ২০২২) – তাতে, ঐ যা হয়, ডাইনোসরগুলো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে, গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রীতিমত ডাইনোসর অ্যাপোক্যালিপ্স যাকে বলে। গোটা মানবসভ্যতার অস্তিত্বই এখন খাদের ধারে ঝুলছে। ছবির একদম শুরুতে দেখাচ্ছে আলাস্কার মত একটা বরফঢাকা ল্যান্ডস্কেপ, চারদিক ধু ধু করছে, সেখানে ক্রিস প্র্যাট একটা ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে, পরনে লেদারস্ট্র্যাপ, জিন্স, ব্রিচ ইত্যাদি, এবং ক্যাঙ্গারু গোছের কয়েকটা ঘাসখেকো ডাইনোসর ওর পাশে পাশে ছুটছে। ক্রিস প্র্যাটের হাতে একটা ল্যাসো, বোঝাই যাচ্ছে ওটা দিয়ে ডাইনোসরগুলোকে পাকড়াও করছে। এটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে গোটা আইকনোগ্রাফিটা ওয়েস্টার্ন জঁর থেকে ধার করা।

চার্লস রাসেলের আঁকা পেন্টিং ‘ওয়াইল্ড হর্স হান্টার্স’ (১৯১৩)

আরো দুটো উদাহরণ দিই। একটা লং রানিং সিরিজ রয়েছে, নাম দ্য ওয়াকিং ডেড (ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট, ২০১০-), সেখানে গপ্পের নায়ক হলেন পুলিশের লোক। তিনি গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ইতিমধ্যে জম্বি অ্যাপক্যালিপ্স হয়ে গেছে। জ্ঞান ফেরার পর তিনি আবিষ্কার করলেন চারপাশে কিছুই আর আগের মত নেই, মানুষ জম্বি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের হিরো কিন্তু আমেরিকান সাউথের কোনো একটা স্টেটের শেরিফ – তার মাথায় হ্যাট, তাতে টিন স্টার লাগানো। যেহেতু জম্বি-অ্যাপোক্যালিপ্স, যথারীতি কোনো পেট্রোল পাম্প আস্ত নেই। সুতরাং তিনি কীসে চড়ে ঘুরছেন? ঘোড়া!
আরেকটা ছবি – এটা নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছে – ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড (জর্জ মিলার, ২০১৫) – যেখানে একটা নিউক্লিয়ার অ্যাপোক্যালিপ্স ঘটে গোটা পৃথিবী শুকিয়ে খটখটে মরুভূমি হয়ে গেছে, তাতে গড়ে উঠেছে একটা টিরানিকাল রেজিম, একদল মানুষ সেখান থেকে পালিয়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে – এই নিয়েই গল্প। এছাড়াও এরকম আরো কিছু ছবি, যেমন দ্য রোড (জন হিলকোট, ২০০৯), যেটা করম্যাক ম্যাকার্থির উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, বা দ্য বুক অফ ইলাই (হিউজ ভ্রাতৃদ্বয়, ২০১০) – এগুলো যদি পাশাপাশি ফেলে পড়া হয়, তাহলে দেখা যাবে সবকটার মধ্যে একটা অ্যাপোক্যালিপ্সের আইডিয়া রয়েছে। অ্যাপোক্যালিপ্সটা হয়তো সবসময় আমাদের দেখানো হচ্ছে না, কিন্তু অ্যাপোক্যালিপ্স-পরবর্তী এক পৃথিবী আমরা ছবিতে দেখতে পাচ্ছি।

এতদ্সত্ত্বেও প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই দুনিয়াকে কোনোভাবেই ডিসটোপিয়া বলা যাবে না, কারণ সবকটা ছবিতেই একটা কমন প্রোজেক্ট রয়েছে – তাদের লক্ষ হল সব প্রতিকূলতা জয় করে একটা নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। আবার নতুন করে একটা কমিউনিটি গজিয়ে উঠবে, সেটা হয়তো অন্য কোনো ক্রাইসিসের মুখে পড়বে – এভাবেই চলবে। আমরা আমেরিকান সিভিলাইজেশান বলে যদি কিছু চিহ্নিত করতে পারি, সিভিল ওয়ার থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যে তাকে যে যে সমস্যাগুলোর মুখে পড়তে হয়েছে – যেমন সোশাল জাস্টিস রক্ষিত হচ্ছে না, নানান অপরাধবৃত্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে…গত পনেরো কুড়ি বছরে তৈরি ছবিগুলোতে নতুন করে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করতে করতেই এগোতে হচ্ছে – এই সমস্যাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে একটা ‘সুস্থ স্বাভাবিক’ সমাজ গঠনের দিকে- যেখানে all Americans are equal before the eyes of God. এটাই ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি। এই ছবিগুলো নিজেদেরকে যতই ডিসটোপিক বলে দাবি করুক না কেন, আক্ষরিক অর্থে এগুলো কিন্তু ইউটোপিয়া। সেখানে যতই শিশুমৃত্যু থাকুক, মহিলারা রেপড হয়ে যান, জলের কষ্টে মানুষ মরে গিয়ে তাকে শকুনে ঠুকরে খাক, আদতে এগুলো নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠার বৃত্তান্ত – ভীষণই ইতিবাচক!
দ্বিতীয়ত, একদম আইকনোগ্রাফির জায়গা থেকে যদি দেখি, এই ছবিগুলোর মুখ কিন্তু ওয়েস্টার্নের দিকে ফেরানো। একটু কাব্য করে বললে, যখনই আমেরিকাকে একটা নতুন সমাজ আর সভ্যতা গঠনের গল্প বলতে হচ্ছে, তখনই আবার lone rider, cowboy, Westerner – এই ফিগারগুলোকে ঐ চেনা ল্যান্ডস্কেপে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে। আমার ধারণা আশির দশকে যাকে ওয়েস্টার্নের demise বলা হচ্ছিল – যখন ওয়েস্টার্ন বলে ওয়েস্টার্ন তৈরি করা একরকম বন্ধই হয়ে গেল বলা যায়, সারা বছরে সাকুল্যে হয়তো দশটা ওয়েস্টার্ন তৈরি হত – তখন ওয়েস্টার্নের একটা ডিসপ্লেসমেন্ট ঘটছে অন্যান্য জঁরের ছবিতে। এটা ঠিক যে এখনকার ডিসটোপিক ছবিগুলোয় এমন অনেক বিশেষত্ব রয়েছে যেগুলো হাওয়ার্ড হক্স বা জন ফোর্ডের ছবিতে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। যেমন কোনো ছবির নায়ক একজন কৃষ্ণাঙ্গ। বা ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোডের মত ছবি, যেখানে মুখ্য চরিত্রে রয়েছে একজন মহিলা (যদিও সে খুবই masculinised), কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়েস্টার্নের যে ইম্যাজিনেশন, সেটা প্রায় একইরকম থেকে যাচ্ছে।
অভিষেক: গত কুড়ি বছরে টিভি আর ওয়েব সিরিজের দৌলতে খোদ ওয়েস্টার্নকে একভাবে ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে। তিনটে সিরিজের কথা মাথায় আসছে এই মুহূর্তে – ডেডউড (ডেভিড মিল্চ, ২০০৪-২০০৬), গডলেস (স্কট ফ্র্যাঙ্ক, ২০১৭) আর ওয়েস্টওয়র্ল্ড (জোনাথন নোলান আর লিসা জয়, ২০১৬-)। সিরিজ ফর্ম্যাটে যে ওয়েস্টার্ন ফিরে এল – তার গল্পেও কিন্তু একধরণের ‘সুস্থ সমাজ’ আর স্টেটহুডের দিকে যাত্রা, সমসাময়িক সোশাল জাস্টিস মুভমেন্টগুলোকে স্বীকৃতি জানানো, একটা Hobbesian পরিস্থিতিকে শৃঙ্খলায় আনা, আইনের শাসন চালু করা – এই জিনিসগুলো রয়েছে।
অরূপরতন: আর এই সুস্থ সমাজ গঠনের চেষ্টা মানে কিন্তু সেই গতে বাঁধা আগের আমেরিকাতেই ফিরে যাওয়া – কখনোই কোনো সোশালিস্ট মডেল অফ সোসাইটি বা কমিউন গড়ে তোলার চেষ্টা নয়। সেটা ফ্যামিলি, চার্চ, কমিউনিটি, রিপাবলিক – এই সম্পর্কিত মূল্যবোধগুলোকে বজায় রেখেই হচ্ছে।
অভিষেক: অর্থাৎ সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার সুস্থ সমাজ এবং রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা – যেটা তুমি বলছ সাম্প্রতিক (তথাকথিত) ডিস্টোপিক ছবিগুলোর মূল থিম, সেটা ওয়েস্টার্ন থেকেই ধার নেওয়া, এবং নতুন ওয়েস্টার্ন সিরিজগুলোও সেটাকে আত্মস্থ করছে। কিন্তু ধরো- ক্লিন্ট ইস্টউডের মত একজন পরিচালক আশির দশকে ওয়েস্টার্নের ‘মৃত্যু’ ঘোষণা হওয়ার পরও ওয়েস্টার্ন বানাচ্ছেন, যেমন আনফরগিভেন (১৯৯২), তাঁর ওয়েস্টার্নে কিন্তু এই ইউটোপিয়ার লেশমাত্র নেই।
অরূপরতন: এখানে খেয়াল কর, প্রথমত, ইস্টউডের আনফরগিভেন ঘোষিতভাবে ওয়েস্টার্ন। দ্বিতীয়ত, আনফরগিভেন-এর পরে কিন্তু ইস্টউড আর সেভাবে ওয়েস্টার্ন বানাচ্ছেন না। বানানো সম্ভবও নয় – কারণ আনফরগিভেন নিজেই যেন বলে দেয় যে ওয়েস্টার্নের মৃত্যু হয়েছে।
আনফরগিভেন আসলে এত রিচ একটা ছবি, এবং আমার এত পছন্দের ছবি – এটা নিয়ে বলতে শুরু করলে ঘন্টার পর ঘন্টা নানান খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলা যায়। তার আগে কয়েকটা অন্য কথা বলে নেওয়া যাক, যেগুলো ওয়েস্টার্নের ‘ডেমাইস’ এর প্রসঙ্গে চলে আসে।
বিভিন্ন যেসব কারণ দেখিয়ে ওয়েস্টার্নের ‘ডেমাইস’-কে ব্যাখ্যা করা হয়, তার অন্যতম হল ১৯৮০তে মুক্তি পাওয়া ফিল্ম হেভেন’স গেট। পরিচালক মাইকেল কিমিনো। কিমিনো ইতিপূর্বে দ্য ডিয়ার হান্টার (১৯৭৮) নামে একটা বাণিজ্যসফল ছবি বানিয়েছেন, যেটা আবার ক্রিটিকদেরও ভীষণ ভালো লেগেছে, দেশবিদেশের নামকরা জায়গা থেকে বিভিন্ন পুরষ্কার জুটেছে তার জন্য। এই ছবিটাই বলতে গেলে মেরিল স্ট্রিপের কেরিয়ার লঞ্চ করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সে বছর ডিয়ার হান্টার এক গুচ্ছ নমিনেশন পায় – হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তরফে এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর হয় না। মাইকেল কিমিনোর আগে এতখানি সমাদর যে মার্কিন পরিচালকের কপালে জুটেছিল তিনি ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলা। দ্য গডফাদার (১৯৭২) আর দ্য গডফাদার টু (১৯৭৪) বানিয়ে তিনি ইন্ডাস্ট্রির চোখের মণি হয়ে গেছিলেন – তারপর তো অ্যাপক্যালিপ্স নাও (১৯৭৯) করলেন, যেটা ইন্ডাস্ট্রির সাথে একরকমের গদ্দারিই বলা চলে। কারণ ছবিটার বাজেট ছিল পাহাড়প্রমাণ, কিন্তু রিলিস করার পর মুখ থুবড়ে পড়ল, চলল না।
কিমিনোর ডিয়ার হান্টার বেরোনোর পর ইন্ডাস্ট্রির মনে আশা জেগেছিল, তারা মনে করল বুঝি নতুন কোপোলা খুঁজে পেয়েছে – ফলে এবার সে যা চাইবে তাই হাসিমুখে তার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিমিনো বললেন যে তিনি ওয়েস্টার্ন বানাতে চান। যথারীতি স্টুডিও তাতে টাকা ঢালতে রাজি। সমস্যা হচ্ছে, টাকা হাতে পেলেই সবার মাথায় অ্যাপক্যালিপ্স নাও -এর ভূত চাপে। কিমিনোকে হয়তো শুরুতে দু’ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল, কিছুদিন পর তিনি জানালেন যে তাঁর আরো চার মিলিয়ন চাই, সেই টাকা দেওয়া হলে পর বললেন আমার আরো ছ’ মিলিয়ন দরকার। এভাবে বাজেট বাড়তে বাড়তে শেষমেশ দাঁড়ালো পঁয়তাল্লিশ মিলিয়নের কাছাকাছি!

হেভেন’স গেট দেখলেই বুঝবি – it’s a beautiful film! একেবারে ব্যারি লিন্ডন মার্কা (স্ট্যানলি কুব্রিক, ১৯৭৫)। তিল তিল করে পরম যত্নে তৈরি করা একেকটা ফ্রেম, সেখানে গাছের পাতায় কতখানি সূর্যের আলো পড়বে সেটাও মেপে মেপে করা। অর্থাৎ অসম্ভব self-indulgent একটা ছবি। ওয়াইওমিং স্টেটের দুই র্যাঞ্চ মালিকের মধ্যে একটা ক্যাটল ওয়ার নিয়ে গল্প। গোটা ছবিতে ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি, ইউরোপীয় সভ্যতা ইত্যাদি নিয়ে জট পাকাতে গিয়ে ঘেঁটে ঘ করেছে। তারপর যা হয় – ফ্লপ করল – একেবারে লাল সিং চাড্ডা মার্কা ফ্লপ। ছবির প্রোডিউসার ইউনাইটেড আর্টিস্টস্ ফতুর হয়ে গিয়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হল। ওয়েস্টার্ন জঁরটাও তখন সবার চোখের বিষ, কেউ আর তাতে টাকা ঢালতে রাজি নয়। ততদিনে হলিউড পেয়ে গেছে তার ফেভারিট ফর্মুলা – ব্লকবাস্টার ফিল্ম। নতুন যুগের মাচো হিরো কীরকম হবে, তারও একটা আদল পেয়ে গেছে হ্যারিসন ফোর্ডের মধ্যে – যিনি আর কিছুদিনের মধ্যেই ইন্ডিয়ানা জোন্স শুরু করবেন (১৯৮১ থেকে শুরু করে এখনও চলছে)। সভ্য দুনিয়ার বাইরে গিয়ে স্যাভেজ-দমনের প্রোজেক্টটা ইন্ডিয়ানা জোন্সের দৌলতে শুরু হবে নবকলেবরে।
তবে হেভেন’স গেট একটা সিগনিফিকেন্ট জিনিস করেছিল। ধর, যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ওয়েস্টার্নের মূল জায়গাটা কী? What makes western different from the other genres? – তার উত্তর কী হবে? আমি বলব, ফ্রন্টিয়ার মিথ। এই মিথটার একটা প্রয়োজন আছে জঁরে, হয় মিথটাকে গড়তে হবে, বলবৎ করতে হবে, পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, অথবা তার খোলনলচে বদলে দিতে হবে। একদম নির্বাক যুগের ওয়েস্টার্ন, যেমন জন ফোর্ডের আয়রন হর্স (১৯২৪), সেই থেকে শুরু করে ক্লিন্ট ইস্টউডের ছবি অবধি সব ওয়েস্টার্ন কিন্তু এই ফ্রন্টিয়ার মিথ নিয়েই কাজ করছে। আয়রন হর্স এই মিথটাকে নির্মাণ করতে সাহায্য করেছিল – যে দেখ, কিছু দুঃসাহসী লোক, যাদের চালচুলো কিছুই নেই, তারা স্রেফ শরীর আর মনের জোরে লড়ে যাচ্ছে বন্য প্রকৃতি আর স্যাভেজদের সঙ্গে – এদেরকে হারিয়েই তারা বপন করবে সভ্যতার বীজ। এর অনেক পরে যখন স্যাম পেকিনপা, বাড বেটিকার, ক্লিন্ট ইস্টউড – প্রমুখ ছবি করতে এলেন, তখন তাঁরা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়!’ (হাসি) কিন্তু সবকটা ন্যারেটিভেই ফ্রন্টিয়ার মিথটা কেন্দ্রে রয়েছে।
হেভেন’স গেট যেটা করে বসল – সে ওয়েস্টার্ন বানাতে গিয়ে বানিয়ে ফেলল একটা সুদৃশ্য পিরিয়ড পিস। ওয়েস্টার্ন আর পিরিয়ড পিস – এই দুটোকে গোলালে চলবে না – দ্য গুড, দ্য ব্যাড, অ্যান্ড দ্য আগলি (সের্জিও লিওনি, ১৯৬৬) -কে যেভাবে আমরা ওয়েস্টার্ন বলে থাকি – গন উইথ দ্য উইন্ড-কে (ভিক্টর ফ্লেমিং, ১৯৮০) কিন্তু একইভাবে ওয়েস্টার্ন বলতে পারি না, যদিও দুটোই সিভিল ওয়ারের পটভূমিতে তৈরি। পিরিয়ড পিস অতীতের গল্প বলে, সেটা দাঁড়িয়ে থাকে একধরণের নিঁখুত ইতিহাসসম্মত প্রোডাকশন ডিসাইনের ওপর, যেখানে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা পিরিয়ডের পুনর্নিমাণ করা হয়, সেইরকম দেখতে প্রপ, বাড়ি ঘর, সংলাপ, উচ্চারণভঙ্গি – যেমন ধর, মুঘলে-আজম (কে. আসিফ, ১৯৬০), পাকিজা (কামাল আমরোহী, ১৯৭২), যোধা আকবর (আশুতোষ গোয়াড়িকর, ২০০৮) – এধরণের ছবিতে যেটা হয়ে থাকে। আর পিরিয়ড পিস কথাটা কিন্তু অ্যাকাডেমিক নয়, পুরোদস্তুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল টার্ম। আমেরিকাতে এরকম হাজার হাজার পিরিয়ড পিস তৈরি হয়েছে, কখনো সিভিল ওয়ার নিয়ে, কখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। আঙ্কল টমস কেবিন নিয়ে ছবি তৈরি হলে সেটাকে নিশ্চয়ই কেউ ওয়েস্টার্ন বলবে না, বলবে পিরিয়ড পিস।



হেভেন’স গেট একটা টার্নিং পয়েন্ট, কারণ খুব অদ্ভুতভাবে ছবিটা ওয়েস্টার্নটাকে পিরিয়ড পিস করে তুলল। এটা আমি প্রস্তাব হিসেবে রাখছি, কেউ আমায় কাউন্টার করতেই পারেন। ওয়েস্টার্নে মিথলজি জিনিসটা খুব ফান্ডামেন্টাল ভূমিকা পালন করত। কিন্তু হেভেন’স গেটের পর পপুলার রিসেপশনে একটা বড়রকমের পরিবর্তন আসে, এমনকি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও ছবিটা দর্শকমনে স্থায়ী ছাপ রেখে দেয়। এরপর থেকে ওয়েস্টার্ন বলতে মানুষ বুঝবে স্রেফ ওয়েস্টে ঘটে যাওয়া অতীতের গল্প। এরই মধ্যে দেখা যাবে এর পাশাপাশি ওয়েস্টার্নে একমাত্র ক্লিন্ট ইস্টউডের কেরিয়ারটাই চলছে, যদিও তিনি এর পরবর্তী সময়ে খুব বেশি ওয়েস্টার্ন বানাবেন না।
এরপর টুকটাক কিছু ছবি হয়েছিল, যেমন সিলভারাডো (লরেন্স কাসডান, ১৯৮৫), ডান্সেস উইথ উলভস (কেভিন কস্টনার, ১৯৯০), টুম্বস্টোন (জর্জ পি কসমাটোস আর কেভিন জারে, ১৯৯৩), ওয়ায়েট আর্প (কাসডান, ১৯৯৪) ইত্যাদি- সেগুলো দেখলেই বুঝতে পারবি – মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইনে (জন ফোর্ড, ১৯৪৬) যে মিথের ব্যাপারটা ছিল, সেটা এখানে সম্পূর্ণ হাওয়া হয়ে গেছে*। ক্লেমেন্টাইন দেখলেই বোঝা যায় যে ওয়ায়েট আর্প, ক্ল্যান্টন ব্রাদার্স, ডক হলিডে – এই সব চরিত্রগুলো এবং প্লটের সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতের বাইরেও একটা বৃহত্তর আমেরিকার ইতিকথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে – তার ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। পরবর্তীকালের ছবিগুলোয় আর সেই প্রজেক্টটা নেই। সেই মিথলজিটা অনুপস্থিত। এরা অনেক বেশি হিস্টরিকালি অ্যাকিউরেট – অথচ আমরা এটা দ্য ম্যান হু শট লিবার্টি ভ্যালেন্স (ফোর্ড, ১৯৬২) থেকেই জানি, “When History becomes legend – print the legend.” এতদিন ওয়েস্টার্ন মাথা ঘামিয়েছে সেই ‘লেজেন্ড’টাকে নিয়ে।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)




* ক্লাসিকাল ওয়েস্টার্ন বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ চল্লিশের দশক পর্যন্ত যেসব মার্কিন ছবির মাধ্যমে ওয়েস্টার্নের চলচ্চিত্রীয় আদলটি পাকাপোক্ত হয়েছিল দর্শকমানসে, তারই অন্যতম পরাকাষ্ঠা মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন। এই ছবিতে ওয়ায়েট আর্প, ডক হলিডে প্রভৃতি কিংবদন্তীসম চরিত্রকে নিয়ে ইতিহাস, কল্পনা, ও রটনার মিশেলে একটি জমজমাট গল্প ফাঁদা হয়। ভাগ্যান্বেষী বন্দুকবাজ ওয়ায়েট আর্প কীভাবে ওয়েস্টের একটি উপদ্রুত শহর টুম্বস্টোনের দায়িত্ববান টাউন মার্শাল হয়ে উঠল সেই বৃত্তান্ত, আর তার পাশাপাশি মৃত্যুপথযাত্রী ডক হলিডে ও তার খোঁজে সুদূর বস্টন থেকে ছুটে আসা ক্লেমেন্টাইন কার্টারের করুণ কাহিনি – এই টুকরো ঘটনাগুলিকে একসূত্রে গেঁথেই ছবি এগিয়েছে। এর সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে গেছে কমিউনিটি গড়ে ওঠার গল্প, অরাজকতার আগাছা উপড়ে অসভ্য ওয়েস্টে আইনের শাসন প্রবর্তনের ইতিকথা। পুনরায় নব্বইয়ের দশকে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ওয়ায়েট আর্প ও ডক হলিডের সাথে ক্ল্যান্টন ব্রাদার্সের কলহ নিয়ে হলিউডে একাদিক্রমে দুটি ছবি হয়েছিল, টুম্বস্টোন এবং ওয়ায়েট আর্প, অরূপদা যাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ছবিগুলি একই চরিত্র এবং কিংবদন্তী নিয়ে তৈরি হলেও, ওয়েস্টের অতীতকে তারা যেভাবে পুনর্নির্মাণ করে, তার সাথে প্রায় পাঁচ দশক আগে তৈরি মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন-এর বিস্তর ফারাক। সে’জন্যই ওয়েস্টার্ন মিথ নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে ফোর্ডের সেই ছবির কথা উঠে এল।
ছবি নির্দেশিকা: প্রচ্ছদের ছবিটি গডলেস নামক লিমিটেড সিরিজ থেকে নেওয়া হয়েছে।