মৃণাল সেন-রাইনহার্ড হফ কথোপকথন, ১৯৮৩

১৯৮৪ সালে সাবেক পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে মুক্তি পেয়েছিল টেন ডে’জ্ ইন ক্যালকাটা : আ পোর্ট্রেট অফ মৃণাল সেন (ইংরেজি নাম) তথ্যচিত্রটি। পরিচালনা করেছিলেন রাইনহার্ড হফ— জার্মানির নতুন প্রজন্মের দুঃসাহসী চলচ্চিত্রকারদের অন্যতম। ছবির সিংহভাগ জুড়ে ছিল মৃণাল সেনের সাথে হফের কথোপকথন। কথাবার্তার বিষয় হিসাবে অবশ্যই যে-প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে, তা হল মৃণাল সেনের সিনেমা ও তার আঙ্গিকের বিশেষত্ব। সত্তরের দশকের শেষপাদে পৌঁছে তাঁর চলচ্চিত্রে দেখা দিতে শুরু করে কিছু নতুন লক্ষণ। ভুবন সোম, কলকাতা একাত্তর, পদাতিক, কোরাস ইত্যাদি ছবির আঙ্গিকের চমকপ্রদ ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে, ক্রমশ মন্থর হয়ে আসে ছবির গতি– ক্যামেরার দৃষ্টি চোরাগোপ্তা ঢুকে পড়তে থাকে দৈনন্দিনের গলি-ঘুঁজি বেয়ে। এইসব পরীক্ষানিরীক্ষার খুঁটিনাটি নিয়ে মৃণাল সেন স্বয়ং কতখানি সচেতন ছিলেন, তারই পরিচয় মেলে এই সাক্ষাৎকারে। 

রাইনহার্ড হফের ছবিটি অবশ্য অধুনা দুষ্প্রাপ্য। ছবির চিত্রনাট্য বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল সিগাল বুকস থেকে, ১৯৮৭ সালে। পরবর্তীকালে, ঐ সিগাল বুকস থেকেই মৃণাল সেনের লেখালিখি ও সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন ছেপে বের হয়–যার নামমন্তাজ (২০০২)। এই কথোপকথনের অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সে-বইয়ে, তারই একটি তর্জমা এবার প্রকাশিত হল কাউন্টার শট-এ। এই অনুবাদের অনুমতি দেওয়ার জন্য, এবং আমাদের পাশে থাকার জন্য, আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই শ্রদ্ধেয় শ্রী কুণাল সেন-কে।


রাইনহার্ড হফ: এটা কি আপনার কখনো মনে হয়েছে, যে কোনো এক সময়ে (জঁ-লুক) গোদার বা (আলেক্সান্ডার) ক্লুগের মত একধরণের ‘মুক্ত আঙ্গিক’ নিয়ে আপনার কাজ করার ইচ্ছা জাগবে?

মৃণাল সেন:  আমি ঠিক নিশ্চিত নই। করতেও পারি। (সেজারে) জাভাত্তিনির একবার ইচ্ছে হয়েছিল অমন করার। উনি খুব একটা সফল হননি। তবে আপনি ছবির মাধ্যমে কী বলতে চান, ছবিতে আপনার লক্ষ্যটাই বা কী – সে ব্যাপারে একটা মোটামুটি ধারণা থাকা ভালো। তারপর আপনি যখন শুট করতে যাবেন, তখন চোখ-কান খোলা রাখলে– দেখবেন চারপাশের কতকিছু আপনার কানে আসবে, চোখে পড়বে– তখন সেগুলোকে ঠিক ঠিকভাবে মিশিয়ে দেবেন আপনি কাজের মধ্যে। যদি কিছু পছন্দ না হয়, সেটাকে বাদ দিতেই পারেন, তবে তাতে খরচ বেজায় বেড়ে যেতে পারে, এ আমি জানি।

রা: কিন্তু আপনার শেষ দুটো ছবির গড়ন এতই নিটোল, দেখে তো মনে হয়, চিত্রনাট্য যেন আগে থেকে তৈরিই ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব হল, কারণ আপনি যেভাবে ছবি শুট করার কথা বলছেন…

মৃ: এর জন্য বোধহয় আমার অভিজ্ঞতাই দায়ী। আমি তো বেশ অনেকদিন হয়ে গেল এই লাইনে আছি। এখানে যে সবসময় সবকিছু আগে থেকে প্রস্তুত থাকে- এমন নয়। এমন অনেক কিছুই আছে, যা আমি যখন চিত্রনাট্য লিখি তখন মাথায় থাকে না। আপনাকে বেশ কতকগুলো উদাহরণ দিতে পারি, কীভাবে শুটিং স্পটে দাঁড়িয়ে আমি একটা বিশেষ দৃশ্যের পরিকল্পনা করেছি, যেটা পরে গিয়ে ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যগুলোর একটা হয়ে দাঁড়িয়েছে – সেরকম অনেক ঘটনা শোনাতে পারি। এটা আমার শেষ দুটো ছবিতেও হয়েছে। বোলপুরের কাছে একটা জায়গা আছে, আপনাকে দেখাব, সেখানে আমরা খন্ডহর শুট করেছিলাম। ছবির একটা দৃশ্য, সেটা মোটেই স্ক্রিপ্টে ছিল না, কিন্তু আমার মাথায় খুঁটিনাটি সমেত তার একটা আদল তৈরি-ই ছিল। দুটো শটের মধ্যিখানে অনেক সময় কিছু জিনিস আমার চোখে পড়ত যা হয়তো-বা আমায় ভীষণ অভিভূত করল, কোনো আইডিয়া উঁকি দিল মনের কানাচে, তৎক্ষণাৎ মনে হল – আমি তো এগুলো রাখতে পারি ছবিতে…!

রা: যখন আপনি এরকম বদলে ফেলার প্রস্তাব করেন, কিংবা হয়তো একটা গোটা দিনের কাজ বদলে দেন, তখন আপনার প্রোডাকশন ম্যানেজার কী বলেন? 

মৃ: যখন ওঁকে গিয়ে বলি যে আমি এরকম এরকম করতে চলেছি, আর তার জন্য এই এই জিনিস আমার লাগবে, ভদ্রলোক ঠায় চেয়ে থাকেন আমার দিকে, কিছুক্ষণ তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি উনি ভিতরে ভিতরে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছেন, কিন্তু অবশেয়ে সায় দিয়ে বলেন, ‘ওকে’। যেহেতু ভদ্রলোক আমায় চেনেন– জানেন আমি প্রায়ই এরকম করে থাকি– তাই উনি সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকেন।

রা: কিন্তু এভাবে কাজ করতে গিয়ে ছবির খরচ আরো বেড়ে যায় না? 

মৃ: না, বেড়ে যায় না, কারণ আমি অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে কাজ করি। আমি আগে দেখেছি, আমি এরকম চান্স নিতে থাকলে সেগুলো শেষমেশ ভালোভাবেই উৎরে যায়।

রা: মৃণাল, আপনার ছবিতে যে ধরণের বাস্তববাদ আমরা দেখি, সে’ সম্বন্ধে আপনার কী মত?

মৃ: বাস্তববাদ বলতে আমি কী বুঝি, সেটা অল্পকথায় বোঝানো বেশ মুশকিল। আমি এটুকুই বলতে পারি যে, যে বস্তুজগৎ আমরা প্রত্যক্ষ করি, তাকে চলচ্চিত্রের সাহায্যে উদ্ধার করা যায় না। বড়জোর যেটা করা যেতে পারে, তা হল বাস্তব সম্বন্ধে আপনার বোঝাপড়াটুকু তুলে ধরা। একটি বিশেষ বস্তুর সামনে লেন্স বসিয়ে– তার আকৃতি ও ঘনত্বের প্রতিরূপায়ণ করে– আপনি আসলে যা সৃষ্টি করছেন, তা বাস্তবের একটি প্রতিচ্ছায়া মাত্র। এই একই জিনিস আমিও চেষ্টা করে থাকি। আমি বাস্তব সম্বন্ধে শুধু নিজের ধারণাটুকুই তুলে ধরতে পারি, যা আপনার ধারণার সাথে হয়তো একেবারেই মিলবে না। আমরা যে বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করছি তা হয়তো একই, কিন্তু যেই আমি সেটাকে পর্দায় তুলে ধরলাম, অমনি সেটা অন্য যেকোনো মানুষের বাস্তবের ধারণা থেকে আলাদা হয়ে গেল। এখানেই নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটা আসে। এখানে বস্তুজগৎ-কে আমি নিয়ন্ত্রণ করছি নিজের মনের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী।

রা: আচ্ছা, আপনার ছবিতে যে বাস্তবতা ফুটে ওঠে, তাকে কি আপনি সাধারণ বাস্তবের সাপেক্ষে বিচার করেন? নাকি তার বড় একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না– (রাইনার ভের্নার) ফাসবিন্ডার যেমন বলেন, ‘আমার ছবিগুলোই বাস্তব। আমি আর দ্বিতীয় কোনো বাস্তব নিয়ে মাথা ঘামাই না।’

মৃ: আমি কথাটা একটু অন্যভাবে বলি। আমি যা করি তা অনেকটা এরকম – আমি যখন আমার চারপাশের বাস্তবের সান্নিধ্যে আসি, তখন আমি চেষ্টা করি গোটা জিনিসটাকে আত্মস্থ করার, ব্যক্তিগত করে তোলার। তারপর শেষমেশ আমি যে বাস্তবটাকে তুলে ধরি, সেটা আমার নিজেরই বাস্তব, আমিই তার স্রষ্টা। যে বাস্তবকে আপনি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখছেন, এ কিন্তু সেই বাস্তব নয়। এ এমন একধরণের বাস্তব, যাকে আমি স্বয়ং তুলে ধরছি, যার যুক্তিকাঠামো তার নিজস্ব।

রা: বাঙালি হিসেবে আপনার যে সাংস্কৃতিক পরিচয়, সে ব্যাপারে একটা প্রশ্ন…

মৃ: আমার জন্ম বাঙালি পরিবারে, বিয়ে করেছি একজন বাঙালি মেয়েকে, আমার ছেলেও ঘটনাচক্রে বাঙালি, এবং আমাদের বাস বাঙালি-অধ্যুষিত পরিবেশে। কিন্তু এটাও আমি ভুলতে পারি না যে আমরা বাস করছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে, যেখানে দেশকাল আগের চাইতে অনেকটাই ছোট হয়ে এসেছে। আর তার ফলে আজকের দিনে এমন কিছুই নেই যাকে বিশুদ্ধ বাঙালি, বিশুদ্ধ ভারতীয়, বিশুদ্ধ জার্মান, বিশুদ্ধ ব্রিটিশ, বা বিশুদ্ধ ফরাসি বলা চলে। আমরা একটা দো-আঁশলা সংস্কৃতি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি– এ ব্যাপারটা আমার চমৎকার লাগে। আমার মনে হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে-গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে নিজের সংস্কৃতির বিশুদ্ধ খাঁটি শেকড়বাকড় খুঁজে বের করার চেষ্টাটা দিনে-দিনে একটি বাজে পণ্ডশ্রম বলে সাব্যস্ত হবে।

রা: কিন্তু এই একই সময় আমরা ইউরোপে, বিশেষ করে যারা নতুন প্রজন্মের পরিচালক, তারা জগৎ জুড়ে মার্কিন সংস্কৃতি বা বকলমে কোকাকোলা সংস্কৃতির দখলদারি থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে মুক্ত করার দাবি জানিয়ে যাচ্ছি।

মৃ: লোকে সংস্কৃতির ওপর মার্কিন প্রভাবের কথা বলে বটে, কিন্তু আমি সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। প্রযুক্তি তো কোনো একটা বিশেষ সংস্কৃতির বা কোনো বিশেষ সরকারের একচেটিয়া নয়…

রা: আমি কিন্তু প্রযুক্তির কথা বলছি না। আমি বলছি একটা ভোগবাদী সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির ওপর যে প্রভাব ফেলতে পারে, তার কথা।

মৃ: সেটা আমি মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই। আমার যদি মার্কিন কালচারের প্রতি টান থাকে, তাহলে তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার হক্ আমার আছে পুরোমাত্রায়। কিন্তু আমি এটাও বলব, আমার পছন্দ অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করছে আমার চারপাশের বাস্তব। 

রা: বেশ।

মৃ:  আমার ছবিগুলোর ওপর যে সংকটের ছায়া রয়েছে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার প্রথম দিকের ছবিগুলো যদি দেখেন, দেখবেন আমার ভাবনার কেন্দ্রে ছিল বস্তুজগৎ এবং বস্তুগত অস্তিত্বের সংকট। এই বস্তুজগৎ আমার প্রথম ছবিগুলো-র ছন্দ, তার বৈপরীত্য, কঠোরতা, এমনকি রসবোধের ওপরও মাতব্বরি করেছে। আমার ছবির চরিত্ররা যেসব স্ববিরোধ দিয়ে গড়া, যা তাদের কুরে কুরে খায়– তাকেও রেখেছে কব্জা করে। একটা সময় ছিল, যখন আমি বিস্তর চেঁচামিচি করতাম, সব নতুন করে গড়ার কথা, একটা আশ্চর্য নতুন দিনের কথা– যেন সেটা গলির মোড়েই অপেক্ষা করছে– বলতাম সে-সব। নেহাতই সহজসরল এ-সব কথা, কিন্তু মনে মনে তা নিয়ে ছিল স্বতন্ত্র এক আবেগ, ভীষণ সাচ্চা আবেগ। আর এ-সব কিছুই ছিল আমার সময়ের অবদান, সেই সময়ের দাপুটে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে নিংড়ে নেওয়া। এ-সব কথা তখন হাওয়ায় ভাসত। সেই অবস্থান থেকে আজ অনেক দূরে চলে এসেছি আমি, কিন্তু তাতে ক্লান্তি নেই এতটুকুও। এই বয়সে এসেও আমার নিজেকে মনে হয় যেন এক তরতাজা যুবক, তার শিরায় শিরায় বইছে গরম রক্ত! এই শহর কলকাতার মত আমি, জীবন্ত, প্রাণপ্রাচূর্যে পরিপূর্ণ! আমি এখনও আমার সময়ের প্রতি অনুগত, আরো নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় চালিয়ে যাচ্ছি যাবতীয় আত্মসমীক্ষা– আত্মসমালোচনা– আত্মানুসন্ধান, মাথার চুল ধরে টেনে খাড়া করছি নিজেকে (পিটার ওয়াইস যেমন বলেছেন)– তারপর সটান দাঁড় করাচ্ছি আয়নার সামনে। আপনি কি বলবেন একে? নার্সিসিজম? ম্যাসোকিজম বলবেন? কভি নেহি! এ-ধরণের জিনিসে আমি প্রশ্রয় দিই– এমন অভিযোগ করতেই পারেন না আপনি। আমি শুধু ছানভিন করি নিজের ভিতরটা– তারপর ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলি, তাকে উলটে নিয়ে আসি বাইরে, তুলে ধরি সবার চোখের সামনে। আমি চাই নিজেকে জানতে, নিজেকে বুঝতে, এই সমাজটাকে বুঝতে – যার সাথে আমি জড়িয়ে আছি আষ্টেপৃষ্টে। এই প্রক্রিয়াটাই চলছে এখন। সেই ১৯৭৯ তে একদিন প্রতিদিন-এর সময় থেকে, এই শেষ কয়েক বছর যাবৎ, আমি মানুষের ভিতরের জগৎটা নিয়ে চিন্তা করছি, তার রহস্যময়তা, হতাশা, দ্বিধাদীর্ণ জটিলতা, এবং অবশ্যই তার ভিতরের জ্বলন্ত শক্তির উৎসটিকে আবিষ্কার করাই আমার লক্ষ্য। এই ভাবনা নিয়েই আমি আমার চরিত্রদের এবং আমার আপন সত্তার সংকটের ওপর জোর দিচ্ছি…আমার একদিন প্রতিদিন দেখুন, সাতজন সদস্যের একটি পরিবার, যাদের মধ্যে মোটামুটি সদ্ভাব রয়েছে। অথচ ছবি যত এগিয়েছে, তারা যেই না সরাসরি বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছে, অমনি তাদের ঝগড়া-বিবাদ চড়েছে সপ্তমে, যেন একে অপরকে ছিঁড়ে কুটিকুটি না-করা অবধি তারা থামবে না! কিংবা আকালের সন্ধানে-র কথাই ধরুন। অতীতের একটি বীভৎস বাস্তব ঘটনা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ওপর ছবি করতে গিয়ে ফিল্ম কোম্পানির লোকজন মুখোমুখি হল বর্তমানের নগ্ন নির্মম বাস্তবের সঙ্গে, যা থেকে তারা পালানোর চেষ্টা করেছে এতদিন। অথবাখারিজ-এর কথাই ভাবুন না, সেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু জীবন বড় শক্ত ঠাঁই, তার থেকে পালিয়ে বাঁচা কঠিন। আমি এই অমোঘ নিয়মের কথাই বলার চেষ্টা করি।

“যেন একে অপরকে ছিঁড়ে কুটিকুটি না-করা অবধি তারা থামবে না”: একদিন প্রতিদিন

এখন আমায় যেটা টানে সেটা স্রেফ বস্তুজগৎ নয়, যা আমার কাছে জড়বৎ, নিষ্প্রাণ। বরং আমি এই বস্তুজগতের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাই এই সময় থেকে জন্ম নেওয়া বোধ-কে। বাস্তব, তার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ভাষ্য, টীকাটিপ্পনী। কিন্তু শেষমেশ সেটা যদি হয় আগাগোড়া স্বকপোলকল্পিত, তাহলে চলবে না। বাস্তবের অনেক রূপভেদ আছে। আপনার নিজের বাস্তবের অবয়বটিকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে খন্ডন করতে হবে অন্য কারোর বাস্তবের অবয়বকে। এটা তথ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তথ্য যতক্ষণ না একটা আদল পাচ্ছে, ততক্ষণ তো সেটা একটা নখদন্তহীন খবরমাত্র, তার কোনো অভিঘাত নেই। সামাজিক জীব হিসেবে, আমার নজর থাকে এই অভিঘাতের ওপর। আপনি চাইলে আমাকে প্রোপাগ্যান্ডিস্ট বলতেই পারেন। আমার ছবিতে যখন আমি কিছু চরিত্রের সপক্ষে একটা যুক্তি খাড়া করি, আর কিছু চরিত্রের যুক্তিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই, তখন আমি একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থির থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু এটা প্রোপাগ্যান্ডা হিসেবে যতটা গা-জোয়ারি ভাবছেন ততটাও নয়। আমার প্রথম দিকের ছবিগুলোর দিকে যখন আবার ফিরে তাকাই, বুঝতে পারি সেখানে এ-ধরণের দূর থেকে ভেসে আসা, সূক্ষ্ম প্রোপাগ্যান্ডার কোনো স্থান ছিল না। আমি যখন একটা সর্বজনীন সংস্কৃতির উল্লেখ করছি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমি বলতে চাইছি যে পরিকাঠামো ও প্রযুক্তির প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা মন্থর গতিতে, কিন্তু অনিবার্যভাবে, দুটি সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি: একটি সুবিধাভোগীর সংস্কৃতি, অন্যটি বঞ্চিত মানুষের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির আঞ্চলিক লক্ষণগুলো আস্তে আস্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, তার জায়গায় মাথাচাড়া দিচ্ছে সব নিত্যনতুন লক্ষণ। এ’সব কিছুই হয়তো হচ্ছে কোনো সামূহিক বিপদের প্রকোপে, যা এখনও আমাদের দুনিয়া ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার এখানে একটা অনুঘটকের কাজ করছে বলেও মনে হয়, যার ফলে আরো তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেওয়া যাচ্ছে। আমি যখন আপনার একটা ছবি দেখছি তখন আপনি জার্মান, আমি ভারতীয়, অবিশ্বাস্যরকমের ভারতীয়। কিন্তু আমার ধারণা, আপনাকে একজন জার্মান যতটা বুঝবে, আমিও ঠিক ততটাই বুঝব। আপনার মতের সাথে আমার মত মেলে। এমন নয় যে আমি আপনার সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলি না, কিন্তু আবার একমতও হই। আপনার সংকট, আপনার অসহায় ক্রোধ – এগুলোর মধ্যে আমি অব্যর্থভাবে খুঁজে পাই নিজেকে। আমার মনে হয়, আজ হোক বা কাল, ন্যাশনাল সিনেমা নামক বস্তুটির দিন ফুরোবে। তার জায়গায় দু-ধরণের সিনেমা থাকবে: একধরণের ছবি থেকে ফুটে বেরোবে সুবিধাভোগী রঈসদের ভাবজগৎ, আরেকধরণের ছবি ধরে রাখবে বঞ্চিত মানুষের বিশ্ব ও তার দেখার ভঙ্গিমাকে। এর বাইরে থাকবে না আর কিচ্ছু।

রা: আপনি কোন শ্রেণির ছবিকরিয়ে-দের মধ্যে ফেলেন নিজেকে? কোন দলে?

মৃ: আমি যে শ্রেণি থেকে উঠে এসেছি, তার সাথেই আমি একাত্ম অনুভব করি, আর সেটা হল বঞ্চিত মানুষের শ্রেণি। কিন্তু সেখানেও একটা সমস্যা রয়েছে। আমি শুরুতে যে মানুষটা ছিলাম, আজ তো আর সেরকম নই। অতএব আমার নিজের মধ্যে হরবখত একটা লড়াই চলে। ভিতরে আমি যেন দুটো মানুষ। যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি আমার জীবনের ধরণধারণ বদলেছি কিনা, আমি খুব জোরগলায় বলে উঠব: না, বদলাইনি। কিন্তু আবার আমি এও জানি যে বদলে আমি গিয়েছি নিশ্চয়ই, হয়তো নিজের অজান্তেই।

রা: মানে আপনি বলতে চান আপনার বৌদ্ধিক অবস্থানটা বদলে গেছে?

মৃ: আমি ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারব না, তবে যখন নিজের অজান্তে, এমনকি আপনার নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীবনের ধরণধারণ বদলে যায়, তখন জগতের প্রতি আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা তো একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আমি সেই ভয়টাই পাই। সেজন্য আমি চেষ্টা করি পিছনদিকে ফিরে তাকাতে। চেষ্টা করি অতীতকে ভুলে না যেতে। এরকম সময়েই আমার মনে পড়ে যায় চ্যাপলিনের সেই উক্তি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কোনো অপমানবোধ নেই, আর অপমানবোধ হল এমন এক জিনিস, যাকে কখনও চাইলেও ভোলা যায় না।’ আমি চেষ্টা করি এই লাইনটা সবসময় স্মরণে রাখতে, নিজের কাছাকাছি রাখতে, যাতে কখনও হারিয়ে না ফেলি নিজেকে, নিজের নোঙরগুলোকে। এটা খুব জরুরি।

রা: কিছু লোকে যে বলে, মৃণালবাবু, আপনি কেবল বিদেশি ফেস্টিভালের জন্যই ছবি-টবি করেন, নিজের দেশের জন্য আর করেন না।

মৃ: আমি ছবি বানাই যাতে আমার নিজের বিবেক সন্তুষ্ট থাকে। আমার বিবেক আমাকে নির্দেশ দেয় ছবি বানাতে, আর আমি আমার ছবির বিষয় নিয়ে বরাবরই খুশি। যা-ই বলতে চাই না কেন, আমার ইচ্ছে করে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে সেটা পৌঁছে দিই। আর সিনেমার কায়দাকানুন হচ্ছে আমার ভালোবাসার জিনিস। কনটেন্ট আর ফর্ম, এই দু’য়ের জোরেই আমি জগৎ-জোড়া দর্শকের কাছে পৌঁছনোর তাগিদ অনুভব করি। আর এ-ও সত্যি যে আমি বিদেশি ফেস্টিভালগুলোয় ছবি পাঠাই। এমন কেউ কি আদৌ আছেন, যিনি নিজের ছবি বিদেশি ফেস্টিভালে পাঠাতে চাইবেন না? 

রা: সকলেই চাইবে।

মৃ: আমি চাই আমার ছবি লোকে দেখুক, সে নিয়ে আলোচনা করুক। সেই উদ্দেশ্যেই আমার ছবিগুলো বিদেশের ফেস্টিভালে পাঠানো।

রা: আমার এক ভালো বন্ধু, পরিচালক পিটার লিলিয়েনঠাল একবার বলেছিলেন, ‘সত্যি বলতে কী, এর বোধহয় একটাই উত্তর হয়। আমি ছবি বানাই সবার আগে নিজের জন্য, তারপর আমার বন্ধুদের জন্য। তারপর যদি সেটা একটা বড় সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছয়, তাহলে আম খুশি।’ কিন্তু এটা তো ওঁর মত। আপনি এ ব্যাপারে কী মনে করেন?

মৃ: পরিচালক যখন দেখেন যে তাঁর ছবি একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে, তখন তার চেয়ে সুখী আর কেউ হয় না। যখন সেটা হয় না, কেবল তখনই তিনি মনে মনে একটা কৌশল করেন, বলার চেষ্টা করেন যে তিনি ছবি বানান শুধু নিজের জন্যই। কিন্তু আপনার বন্ধুর মত আমারও মনে হয় যে আমি নিজের জন্যই ছবি বানাই, আর যখন সেটা দেখে নিজের সন্তুষ্ট লাগে, তখন বুঝি সেটা বাকিদেরও সন্তুষ্ট করবে। আর বিদেশি ফেস্টিভালে ছবি পাঠানো নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই সূত্রেই বলি, আপনি যে ছবি বানিয়েছেন, তার জন্য পুরষ্কার জেতা কোনো গর্হিত অপরাধ নয়। বরং উল্টোটা, এতে করে আপনার মনে তৃপ্তি আসে, যে আপনি নিজেকে সঠিক উপায়ে প্রকাশ করতে পেরেছেন। সেই কারণেই আপনার ছবি বিদেশি ফেস্টিভালে মানুষের মনে ধরেছে। কেউ যদি তার কদর করে থাকে, তবে আপনার খুশি হওয়ার ন্যায্য কারণ আছে।

রা: আপনার প্রযোজকের সাথে আজকেই দেখা করেছি, ওঁর মতে, আপনার পরের ছবিটা যদি মুখ থুবড়ে পড়েও, কুছ পরোয়া নেহি। উনি বললেন, আমি যখন কারোর সাথে বন্ধুত্ব করি, সেটা চিরকালের বন্ধুত্ব, আর যদি তার ছবি ফেল করে, তাহলে বলব, আমার বন্ধু তার সেরাটা দিয়েছে, এ নিয়ে আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে?

মৃ: উনি বেশ অমায়িক মানুষ। তবে আমার সবসময় মনে হয়, পরিচালক, প্রযোজক, যে লোক ছবিতে টাকা ঢালছে, তাদের সম্পর্ক আগাগোড়া নির্ভর করে লাভলোকসানের খতিয়ানের ওপর। যদি ছবি বক্স অফিসে ভালো চলে, তাহলে প্রযোজক খুশি। আর যদি সে’ ছবি টাকা তুলতে না পারে, তাহলে, স্বভাবতই তাঁর খুব একটা ভালো লাগবে না।

রা:  আপনি তো মাঝে-মধ্যেই প্রযোজক বদলেছেন…

মৃ: আগে যেটা হত, একই প্রযোজকের সাথে পর পর দু’-দু’বার কাজ করার সুযোগ আমার কখনোই হত না, যদি না সেই প্রযোজক হতাম আমি নিজেই। কিন্তু ইদানীং, যেহেতু দুনিয়ার সর্বত্র যত মাইনরিটি ছবির পকেট আছে সেখানকার দরজা আমার কাছে খুলে গিয়েছে, যেগুলো একসঙ্গে ধরলে বেশ বড়সড় একটা বাজার হয়, তার ফলে আমি এখন আগের চাইতে বেশ লাভজনক-ই বটে, কাজেই আগের মত প্রযোজক পেতে এখন আর বড় একটা সমস্যা হয় না।

রা: আপনার প্রযোজক জানালেন যে উনি যে পরিমাণ টাকা লগ্নি করেছেন, সেটা ফেরত পেতে হলে এক কোটি কুড়ি লক্ষ লোককে ছবি দেখতে হবে। আর তিনি যেহেতু জানেন যে সেটা এদেশে সম্ভব নয়, কাজেই তিনি প্রত্যাশা করছেন বিদেশ থেকে টাকা উঠে আসবে। তাই নয় কি?

মৃ: ওঁর সেটাই ধারণা। আমার যদিও মনে হয় ভদ্রলোক একটু বেশিই আশাবাদী এ ব্যাপারে। আমি নই। কিন্তু দেখা যাক কী হয়। আশা তো আমরা করে যাবই। আর এই কয়েক বছর ধরে এমনিতেই আমি প্রায় যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় ছবি করে চলেছি, যেমন আপনিও করছেন, কাজেই দেখা যাক কী হয়। ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।

রা: শুনেছি, অনেক ভারতীয় পরিচালকের নাকি কিছু অনুগামী থাকেন, যাঁরা বছরের পর বছর ঘিরে থাকেন তাঁদেরকে– এটা সত্যি নাকি? এমনটা ইউরোপে কদাচিৎ হয়। ফাসবিন্ডারের কিছুকাল জুটেছিল এরকম, তা বলে খুব বেশি লোকের ভাগ্যে তেমনটা হয়নি।

মৃ: না, আমাদের এখানে সেরকম কিছু নেই। প্রথম দিকে আমরা অনেকটা সময় একসাথে থাকি, কিন্তু যে মুহূর্তে নিজের পায়ের তলায় শক্ত জমি পেয়ে যাই, সে’মুহূর্তে আমি বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি নিজেকে। এমনটাই হয়ে আসছে। আমি যখন শুরু করি, তখন আমাদের একটা দল ছিল। তারা তখন সবাই তাল করছে, কীভাবে সিনেমার দুনিয়ায় ঝটিতি ঢুকে পড়া যায়। শেষমেশ আমাদের দ্বারা সেটা হল। তার আগে অবধি আমাদের মধ্যে ছিল একটা আশ্চর্য বন্ধুত্ব– তাই এখন যখন অতীতের কথা ভাবি, তখন এত রোমাঞ্চ অনুভব করি! কিন্তু ফিল্মের জগতে এসে যেই আমরা একেকজন কেউকেটা হয়ে গেলাম, অমনি প্রত্যেকে হয়ে যেতে থাকলাম একা, পরস্পরের সাথে কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। আমার মনে পড়ে, ১৯৭৫ কি ৭৬ সাল, আমি গেছি কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোরে, সেই প্রথম কানাড়া ভাষার ‘নিউ সিনেমা’র সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমার মনে আছে, একদিন রাত একটা বাজে, আমি ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করা একজন তরুণের ছবি দেখলাম, নাম গিরীশ কাসারাভল্লি, আর সেটা ছিল তার প্রথম ছবি, ঘটশ্রাদ্ধ (১৯৭৭)। তাকে বললাম: এটা তো তোমার প্রথম ছবি, অথচ আমি একজন ছাত্রের মত দেখলাম তোমার ছবিটা, তার থেকে শিখলাম কত কিছু! তা-বলে কিন্তু এই নয় যে তোমার ছবি আমার একেবারে নির্ভুল, নিখুঁত লেগেছে। আমি নিজে কিছু জায়গায় দ্বিমত পোষণ করি, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে তোমার এখনও অনেক পথ চলা বাকি। চলো, আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটুকু রাখি, আমাদের মধ্যে কথাবার্তা যেন চলতে থাকে। তিন বছর বাদে আমি আবার সেখানে গেলাম, আর দেখলাম ততদিনে সেই কথোপকথন থেমে গিয়েছে।    

রা: মৃণাল, আপনার কি কোনো বন্ধুবান্ধব আছে, নাকি শত্রুই আছে অনেক? শিল্পী হিসেবে আপনার কি কখনও নিজেকে খুব একা লাগে?

মৃ: শত্তুরের দলে অনেক বন্ধু ভিড়ে গিয়েছে – এটা বলতে পারি। শো বিজনেসে আছি তো, এখানে যতক্ষণ না কারোর প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছি, ততক্ষণ তার সাথে বন্ধুত্ব রাখাই যায়। যে মুহূর্তে সে বুঝে যাবে আমি তাকে টেক্কা দিতে পারি, অমনি দুজনের মাঝখানে কী একটা যেন চলে আসবে। এটাই হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে ভীষণ একা লাগে নিজেকে, ভীষণ একা, নিজেকে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মনে হয়। এ’ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবলেও খারাপ লাগে। মনে হয়, কথা বলে মিটিয়ে নিই না কেন। মনে আছে, একবার এক ফরাসিকে এই সমস্যার কথা জানিয়েছিলাম, তাতে সে আমায় বলল, এ’ তো চিরকেলে সমস্যা। তুমি যদি মাতিসের কাছে গিয়ে তাকে পিকাসোর কথা বল, মাতিস বলবে, ‘উফ্’, আর তুমি যদি পিকাসোকে গিয়ে মাতিসের কথা বল, পিকাসো বলবে, ‘উফ্’! এই তো ব্যাপার। কিন্তু ভারতবর্ষে এটা আরো অশালীন পর্যায়ে চলে যায়, যার পিছনে একটা আশঙ্কা কাজ করে, চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ফলে আমাদের মধ্যে যখন শত্রুতা জন্মায়, তখন তার কদর্যতার কোনো তুলনা হয় না।

রা:  এক বন্ধু আমায় বলেছিল, তার মনে হয় কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বড্ড একগুঁয়ে, অথচ পরিস্থিতি সম্বন্ধে হয়তো তারা একেবারেই ওয়াকিবহাল নয়। আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন, তাতে মনে হয় এই আচরণের সাথে এদের ইতিহাসের কোনো যোগসূত্র রয়েছে, যা নিয়ে ওরা যারপরনাই গর্ববোধ করে। হয়তো তাতে করে অনেকগুলো বিষয়, যা নিয়ে এখন আলোচনা করা দরকার, সেগুলো অক্লেশে ভুলে থাকা যায়, শুধু তাই নয়…

মৃ: কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের আলাদা করে কোনো বিশেষ দোষ বা গুণ নেই, গোটা দেশেরই এক অবস্থা। তবু যখনই দেখি কলকাতার বুদ্ধিজীবীকুল মাত্রাতিরিক্ত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে  তখন বুঝি এটা আসলে তাদের নিজ নিজ নৈরাশ্য আড়াল করার একটা ছল।

রা: এই যুক্তিটা বোধহয় সবরকম বুদ্ধিজীবী-সুলভ ঔদ্ধত্যের ক্ষেত্রেই খাটে। কিন্তু বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দাদের মুখে শোনা যায়।


২: গোরস্থানে

মৃ: কিন্তু খেয়াল করবেন, আমি আটাত্তর সালে পরশুরাম শুট করার সময় এই গোরস্থান যা ছিল, আর আপনি এখন যে গোরস্থান দেখছেন–এই দু’য়ের মধ্যে কিন্তু একেবারেই কোনো মিল নেই। তখন সব খোলামেলা ছিল। এখন দেখুন, এখানে ওখানে বাসা উঠেছে, যার মানে আরো অনেক নিরাশ্রয় মানুষ এখানে আশ্রয় খুঁজছে। গৃহহীনতা ভারতীয় জীবনযাত্রার, বা বলা ভালো, ভারতীয় বাস্তবের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।

রা: এই যে একটা পুরনো শুটিং লোকেশনে আবার ফিরে এলেন– একটুও নস্টালজিক লাগছে না?

মৃ: তা অবশ্য লাগছে, কিন্তু এটা দেখে খারাপও লাগছে যে সব আর আগের মত নেই।

রা: আপনি বলতে চাইছেন, তাদের পরিবর্তনগুলো ঠিক ইতিবাচক অর্থে হয়নি?

মৃ: না, ইতিবাচক অর্থে তো নয়ই। এগুলো খতিয়ে দেখলে আপনার আরো খারাপ লাগবে। তা সত্ত্বেও, বেঁচে থাকার যে ইচ্ছে, তার যে তীব্র তাড়ণা মানুষকে এতকিছুর মধ্যেও জীবিত রেখেছে, সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের। এটাই বোধহয় এখানে মানুষকে টিকে থাকার আশা জুগিয়ে যাচ্ছে। 

রা: এই যে বাস্তব বদলে যায়, কিন্তু মিউজিয়াম বা আর্কাইভের তাবৎ শিল্পবস্তু একইরকম থাকে, এটা দেখে আপনার আশ্চর্য লাগে না?

মৃ: তা তো বটেই, বাস্তবতার পরিবর্তন হলে ফিল্ম সাবেকি হয়ে যায়, আর্কাইভে সেঁধিয়ে যায়, এতে করে সম্ভবত প্রমাণ হয় যে ফিল্ম আদতেই সমাজে কোনো আশাপ্রদ পরিবর্তন আনতে পারেনি। এই গোরস্থানের দিকেই চেয়ে দেখুন না–গোরস্থান তো–তা সত্ত্বেও লোকে এখানে এসে থাকছে–তার কারণ তাদের অন্য কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এটাও মনে রাখবেন, এরা সবাই কিন্তু এসেছে গ্রাম থেকে। জমিসংস্কার নিয়ে অনেক কথার ফুলঝুরি উঠলেও, এতদিনে কাজের কাজ খুব কমই হয়েছে। ফসল তোলা আর লাঙল দেওয়ার মরশুমের মধ্যিখানের সময়টুকু-তে, যখন মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না, তখন তারা একের পর এক ঢেউয়ের মত এসে আছড়ে পড়ে শহরের বুকে।  ফুটপাথে ঠাঁই হয় তাদের, ভাড়া খাটে এখানে ওখানে, তবে সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের–তা হল–এত কিছু সত্ত্বেও তারা স্বপ্ন দেখা থামায় না–সন্তান জন্ম দেয়–বংশবৃদ্ধি করে চলে। এটাই আমায় এতখানি মুগ্ধ করে রাখে।


৩: আকালের সন্ধানের লোকেশনে

মৃ: একটা দৃশ্য ছিল বটে যেটা আমার পক্ষে এখানে তোলা সম্ভব হয়নি, স্টুডিওয় গিয়ে তুলতে হয়েছিল। সেটা ঐ বাড়ির সেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামীকে নিয়ে, আকালের ছবির শুটিং চলাকালীন এক রাতে যাঁর মৃত্যু হয়। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সিকোয়েন্সটা বাড়িতেই ঐ ঘরের মধ্যে শুট করব, কিন্তু তার আগে আমাদের আরেকটা দৃশ্য শুট করতে হয়েছিল, যেখানে বিধবা স্ত্রীকে শেষকৃত্যের প্রথা-মাফিক স্নান করতে হবে। ওখানেই একটা পুকুরপাড়ে দৃশ্যটা তুলছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম – উপস্থিত গ্রামের বাসিন্দারা, বিশেষ করে মেয়েরা, দৃশ্যটাকে ঠিক ভালো মনে নিচ্ছে না। অন্ধবিশ্বাস থেকে তাদের মনে হয়েছে যে, এখানে মৃত্যু নামক জিনিসটাকে নিয়ে খানিক হেলাফেলা করা হচ্ছে। ব্যাপারটায় ওরা বেশ রুষ্ট হয়েছিল। তখনই আমি ঠিক করে ফেলি যে, স্বামীর মারা যাওয়ার দৃশ্যটা আমি ওদের থেকে দূরে স্টুডিওয় শুট করব। ওদেরকে ‘সংশোধন’ করা অসম্ভব। ওদের জীবনযাপনের সাথে ওতোপ্রোত জড়িয়ে আছে কুসংস্কার। তাই আপনি যখন ছবি-করিয়ে হিসেবে আমার দায়িত্ব, অর্থাৎ সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে আমায় প্রশ্ন করেন, তখন আমি বলব যে, আমি যাদের নিয়ে এসব ছবি বানাই, তাদেরকে আগাগোড়া শুধরে দেওয়ার এলেম আমার নেই।

রা: হয়তো ওদের ‘সংশোধন’ করা নয়, বরং পরিস্থিতিকে শুধরে দেওয়া…

মৃ: হ্যাঁ, আলবাৎ, সিস্টেমটাকে শোধরানো, আর সেটা যারা এসব ছবি দেখে, তাদের মাধ্যমেই করতে হবে। আমি যখন এ-ধরণের ছবি বানাই, তখন আমি কিছু বিশেষ লোকজনকে নিয়ে বানাই– তা-বলে এমন নয় যে ছবিগুলো তাদের জন্য বা তাদেরকেই উদ্দেশ্য করে তৈরি করা হয়েছে। আমি সেইসব মানুষের জন্য ছবি বানাই, যারা আমার ছবির সমঝদার দর্শক। আর আমি সর্বতোভাবে চেষ্টা করি যাতে দর্শক আমার ছবি বুঝতে পারে। কিন্তু বোধ করি, আমি সমস্যাগুলোকে ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারি না, তাদেরকে ঠিক মত বিশ্লেষণ করতে পারি না। এটা একটা চিরন্তন, ঘটমান প্রক্রিয়া, চলতেই থাকবে। আমি ছবি বানাতে থাকি, সমস্যা তুলে ধরি, পরিস্থিতিগুলো নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করি, আর একটা দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাই সবসময়। অপর দিকে আমি চাই দর্শক এই পরিস্থিতিগুলোকে বুঝুক, আমাকে শুধরে দিক। আমার ছবি দেখে তারা যে প্রতিক্রিয়া দেয়, এবং তার সাথে সাথে আমার যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া– এই দুয়ের মধ্য দিয়েই কাজটা সম্পন্ন হয়।

রা: কিন্তু এই যে আপনি এত কাঠখড় পোড়ালেন, তারপর এখানে এসে দেখলেন আদপে কিছুই বদলায় নি, সব যে-কে-সেই রয়েছে, এমনকি সে নিয়ে কারোর কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই, সবাই তাতে‌ই খুশি – আপনার মনে হয় না এটা একটা মারাত্মক সমস্যা? আপনি তো ছবিটা করেছিলেন কিছু জানান দেওয়ার জন্য!

মৃ: যখন ওরা পর্দায় নিজেদের দেখে উৎফুল্ল বোধ করে, তখন আমার একটা খটকা লাগে, আমি টানটান হয়ে বসি…

রা: কিন্তু গাঁয়ের লোক নিজেদেরকে পর্দায় দেখে খুব আহ্লাদিত হচ্ছে, এটা তো খুব একটা সিরিয়াস ব্যাপার বলে মনে হয় না … 

মৃ: কেবল গাঁয়ের বাসিন্দারা নন, আপনি এখন একটা বস্তিতে যান, সেখানকার মজুরদের নিয়ে কি বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে ছবি বানান, দেখবেন ওরাও নিজেদেরকে সিনেমার পর্দায় দেখে আহ্লাদে আটখানা হচ্ছে। 

রা: তা তো বটেই, কিন্তু আপনি কি একটা ভিন্ন অ্যাপ্রোচ নিয়ে ছবি করতে শুরু করেননি? আমার কাছে তো এটাই সবচেয়ে জরুরি পয়েন্ট, আমি সবসময় একটা কিছু নিয়ে ছবি করতে শুরু করি, তখন যদি আমার এই আশাটুকু না থাকে যে এর দ্বারা সামান্য হলেও পরিবর্তন আসবে – সেই পরিবর্তন অবশ্যই সরাসরি ফিল্মের মাধ্যমে হবে না – কিন্তু যদি ফিল্ম অন্তত কিছুসংখ্যক মানুষের চিন্তাভাবনার ওপর ছাপ ফেলতে পারে, যাদের দায়িত্বজ্ঞান বাকিদের চাইতে বেশি, যাতে করে সিস্টেমটা…

মৃ: সম্ভবত একটা অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে ফিল্ম তার ছাপ ফেলে যায়।

আকালের সন্ধানে-র সেটে মৃণাল সেন এবং স্মিতা পাতিল

রা: আমার আরেকটা প্রশ্ন ছিল। ঐ বাচ্চা মেয়েটি, যার নাম আরতি, যার সাথে এই মাত্র দেখা হল, সে জানতে চেয়েছিল আপনি তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা। তার উত্তরে আপনি কী বলেছিলেন?

মৃ: আমি এখানে আসার পরপরই ও জানতে চাইল, আমার সাথে আমার বাড়ি যেতে পারবে কিনা। আমি শুধালাম: ‘তারপর তুমি কী করবে?’ ও বলল ফিল্মে পার্ট করতে চায়। অর্থাৎ আমি ছবির মাধ্যমে কী বক্তব্য রাখতে চাইছি তা নিয়ে ওর একটুও মাথাব্যথা নেই, তবু ও ছবিতে অভিনয় করতে চায়।

রা: কিন্তু মেয়েটি আপনার ওখানে আসতে চেয়েছিল কাজ করবে বলে? 

মৃ: হ্যাঁ। আমি জানতে চাইলাম, কোন কাজের জন্য? সে বললে, ‘আমি আপনার ছবিতে পার্ট করতে চাই, আপনি বলুন না আমায় কী করতে হবে।’ তারপর কী হল জানেন? আমি তখন একটা অন্য ছবির শুটিং করছি, এমন সময় মেয়েটির বাবা কলকাতায় আমার বাসায় এসে উপস্থিত, তারপর সে কী কান্নাকাটি। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে নাকি দু’মাস হয়ে গেল বেপাত্তা– হেন জায়গা নেই যেখানে তিনি মেয়ের সন্ধান করেননি, কিন্তু কোত্থাও পাওয়া যায়নি তাকে। পুরো ছ’-ছ’মাস লেগে গেল মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে। এক্ষেত্রে যেহেতু আমিই তাকে ছবির একটা ছোটখাটো সিকোয়েন্সে পার্ট দিয়েছিলাম, আর তার পরেই সিনেমার ভূত চাপল ওর মাথায়, কাজেই মনে হয় কোথাও গিয়ে যেন আমার ওপরও খানিকটা দায়িত্ব বর্তায়। ঐ-জন্যই তো মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে পালাল। শেষমেশ পরিবর্তন বলতে এ-টুকুই হয়, যত নচ্ছাড় পরিবর্তন। 


রা: আচ্ছা, আর্টিস্ট হিসেবে আপনাকে যেসব কঠিন বাধার মুখোমুখি হতে হয়, সে-ব্যাপারে আপনার কী মত?

মৃ: কেরিয়ারের শুরুর দিকে আমার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা ছিল কীভাবে টাকাপয়সা জোগাড় হবে। কিন্তু এখন টাকা জোগাড় করাটা আর তেমন কঠিন বলে মনে হয় না। তবে বিষয় পছন্দ করার ব্যাপারে আজকাল আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে গেছি। কারণ কেরিয়ার শুরু করার সময়ে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক যা ছিল, তার চাইতে এখন ও-সব আরো জটিল। বিষয় খুঁজে পাওয়াটাই এখন আমার কাছে একটা বিষম ব্যাপার। কোন দিকে নজর দেব? দর্শককে আমার বলার আছে-টা কী? ছবিতে আমি আদৌ ঠিক কী দেখাতে চাইছি? প্রত্যেকবার ছবি শুরু করার সময় আমার এ-রকম একটা না একটা ক্রাইসিস হবেই! মনে হয় যেন একটা খাঁ খাঁ শূন্যতার মধ্যে রয়েছি। মনে হয়– এই বুঝি আমার নতুন কিছু সৃষ্টি করার সামর্থ্য ফুরিয়ে যাবে– হয়তো আর বেশিদূর যাওয়া-ই হবে না আমার। শেষ কয়েক বছর ধরে কেবলই মনে হচ্ছে এ-রকম। ছবিতে টাকা লাগাবে বলে লোকজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। আমি বলি তাদের– সবুর করো। কিন্তু তারাই বা কাঁহাতক করবে সবুর? তার ওপর আমার ইউনিটের লোকজন আছেন, আমি নতুন ছবি হাতে না নিলে তাঁরা বেকার হয়ে বসে থাকবেন। সেটাও একটা দুশ্চিন্তার কারণ। ফলে দ্বিধা-সংশয় আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়।

রা: মৃণাল, প্রশ্নটা আমি হয়তো একটু অন্যভাবে করতে পারতাম। একজন আর্টিস্ট হিসেবে, আপনার কি কখনও এমন মনে হয়েছে যে গল্প বলার ব্যাপারে আপনি হয়তো খুবই পটু, কিন্তু ইমেজ তৈরির ব্যাপারে ততটা নন, বা এরকম কিছু?

মৃ: দেখুন, আমার সবসময় মনে হয় ছবি করার সময়, সবার আগে আমাকে একটা আইডিয়া বা কনসেপ্ট ভেবে নিতে হবে। এই কনসেপ্টটাই প্রথমে আমার মাথায় আসে, তবে দৃশ্য হিসেবে নয়। একটা ছবি দেখে বা শব্দ শুনে মানুষের মনে কনসেপ্টের উদয় হতেই পারে, কিন্তু কাজ শুরু করতে হবে ঐ কনসেপ্ট থেকেই। ওটাই হচ্ছে কাজ শুরু করার ভিত। তারপর সেখান থেকে বাড়াতে থাকো, ছবি নিয়ে ভাবো, শব্দ নিয়ে ভাবো, সুর নিয়ে ভাবো, তারপর ভাবো ছবি বানাতে গেলে যা যা সরঞ্জাম দরকার, সেসব নিয়ে। 

রা: তার মানে ধরুন আপনি একটা লোকেশনে গেছেন, গিয়ে সেখানে একটা বাড়ির সন্ধান পেলেন, তারপর ভাবলেন, আরে, এটা নিয়ে তো একটা গল্প ফাঁদতে হবে – এরকম আপনার সাথে কখনো হবে না? 

মৃ: আপনার পয়েন্টটা ঠিক ধরতে পারলাম না।

রা: ধরুন আপনি একটা লোকেশনে গেলেন…

মৃ: …ছবি করতে?

রা: …হ্যাঁ, ছবি করতে, তারপর আপনি সেই লোকেশনটা দেখে খুবই প্রভাবিত হলেন, ঠিক করলেন সেটা নিয়েই একটা ছবি করবেন। এরকম কখনও হতে পারে?

মৃ: নিশ্চয়ই পারে। আমি একটা কিছু দেখলাম–বা কিছু আমার কানে এল–কোনো শব্দ। আমি ছবির মত করে দেখলাম–তারপর সেখান থেকে একটা আইডিয়া ঠিকরে বেরোল–সেটা হয়তো একটা কনসেপ্টের জন্ম দিল। তবেআসল কাজটা শুরু করতে হবে কনসেপ্ট থেকেই। ধরা যাক, একটা জায়গায় এসে পড়েছি, সেখানে হয়তো কিছু চোখে পড়ল আমার–তারপর বলে বসলাম, এই জায়গাটা নিয়ে একটা ছবি করবই করব। কিন্তু সেটার বিষয় কী হবে? এ’টা হল মোদ্দা কথা। বা আমি হয়তো খবরের কাগজে একটা কিছু পড়লাম, তারপর ভাবলাম: এটা নিয়ে একটা ছবি করলে কেমন হয়? কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, এই খবর থেকে কীভাবে একটা কনসেপ্ট খাড়া করা যায়। ঠিক কোন জিনিসটায় তোমার আগ্রহ, আর তা নিয়ে তুমি আসলে কী করতে চলেছ? এভাবেই শুরু হয়, এটা আমার ক্ষেত্রে বারবার নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। ধরুন, একটা গল্প, সেটা হয়তো অনেককাল আগে পড়েছি। সেটা আমার মনে ধরেছে কি ধরেনি, তারপর সেটার ব্যাপারে আর কিচ্ছু মনে নেই। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে আমি একটা বই নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম, সেখানে সেই গল্পটা, আজ থেকে দশ বছর আগে যা পড়ে আমি আহামরি কিছু পাইনি। আবার সেটা পড়তে আরম্ভ করলাম, আর সেটাই আমার ছবির স্টার্টিং পয়েন্ট হয়ে গেল। এভাবেই হয় ব্যাপারটা, ছবির কায়দাকানুনের ভাবনা অনেক পরে আসে। 

ছবির ডানদিকে রাইনহার্ড হফ ও মধ্যমণি মৃণাল সেন

রা: এরকম কখনও হয়েছে, যে আপনি একটা চিত্রনাট্য প্রায় শেষ করে ফেলেছেন, হঠাৎ ঠিক করলেন সেটা নিয়ে আর ছবি করবেন না?

মৃ: কখ্খনও না। একটা ছবি আমি করতে চলেছি, এটা না জানা অবধি আমি কোনো মতেই চিত্রনাট্য লেখায় হাত দিতে পারি না। যখনই একটা গপ্পো পছন্দ করে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি, মনে হয় যেন খুব বোকার মত কাজ করছি, আমার গল্প বাছাই-এ গলদ হচ্ছে। চাপ থাকে। কিন্তু চাপ আমার মন্দ লাগে না। চাপে থাকলে, মনে হয় বয়সটা এখনও কমই আছে। সেটা একটা চ্যালেঞ্জের মত হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই চিত্রনাট্য ক্রমশ আড়েবহরে বাড়তে থাকে, যতক্ষণ না রীতিমত চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠছে। আমার কাছে চিত্রনাট্য নেহাতই একটা গাইডলাইনের মত, আমি হরদম সেটার রদবদল করতে থাকি। 

রা: আমার ধারণা আপনি ছবি করার ক্ষেত্রে ডায়ালেকটিকাল স্টাইলে বিশ্বাসী।

মৃ: ডায়ালেকটিক্সের নাগাল এড়ানো মুশকিল, ওটা যে শেকড় গেড়ে বসে রয়েছে চিন্তাভাবনায়। তবে চলচ্চিত্রের আঙ্গিকের দিকটা ধরলে, আমার ঝোঁকটা থাকে যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দিকে, মানে আমার ক্যামেরা, রেকর্ডিং মেশিন, তারপর শুটিঙের পরে যা যা করা হয়, মন্তাজ, মিক্সিং, আরো কী না কী…সেই নিয়ে। আমি এই সব কিছু নিয়েই নাড়া চাড়া করতে পছন্দ করি, ঠিক যেরকম একটি শিশু তার বিল্ডিং ব্লক নিয়ে করে, একজন কবি করেন তাঁর শব্দ নিয়ে, ফুটবলার করেন ফুটবল নিয়ে, শিল্পী করেন তুলি দিয়ে – সেরকমই আমি আমার ক্যামেরা আর সাউন্ড নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি।  

রা: কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি আপনার কী বলতে চাইছেন, তা কিন্তু আপনার কাছে ভীষণভাবে স্পষ্ট– যদিও আপনি সবসময় স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে কথা বলছেন, আর এত সব যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন।

মৃ: স্পষ্টতা পরে আসে…আসলে আমি একধরণের পাগলামিতে বিশ্বাস করি। সেই পাগলামির অবশ্যই একটা কায়দাকানুন থাকা চাই। একবার ঠিক করেছিলাম ক্রেডিটে লিখব: ডিরেকশন, স্ক্রিপ্ট অ্যান্ড গিমিকস – অল বাই মৃণাল সেন। ভারতবর্ষের মত একটা চরম গোঁড়ামি-সর্বস্ব দেশ, যেখানে মানুষ পূর্বপুরুষের বেঁধে দেওয়া পথ থেকে একচুলও নড়ে না, সেখানে মাঝেসাঝে একটু-আধটু পাগলামি করার প্রয়োজন আছে বইকী। আমার দিক থেকে যতটুকু করার আমি করেছি। কিন্তু এখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি আমি, যখন ইচ্ছে করে ভিতরের দুনিয়া-টার কথা বলতে। সেখানে আগেকার মুহূর্মুহূ কাটের কোনো স্থান নেই। মন্তাজের কাজটা আগে যেভাবে করতাম, তার চাইতে অনেকটাই বদলে গিয়েছে এখন। ছবির বিষয়বস্তুই আসলে স্থির করে দেয় তার স্টাইলটা ঠিক কী রকমের হবে।

রা:  কখনও বিষয়বস্তু নেই এরকম কোনো ছবি তৈরির কথা ভেবেছেন, ফিল্ম অ্যাস ফিল্ম – এই ভেবে? 

মৃ: বিষয়বস্তু তো ফিল্মে থাকতেই হবে। ফিল্ম অ্যাস ফিল্ম বলতে কি বিমূর্ত ছবির কথা বলছেন? বিমূর্ত হলেও তো কিছু বলার থাকে তার। বিমূর্ততা তো কারোর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আহরণ করা হয়। 

রা: তবু, আজকাল তো এমন অনেকেই আছে যারা ছবির সম্পাদনার ভাষাকে ঘোর সন্দেহের চোখে দেখে, যেহেতু ধরেই নেওয়া হচ্ছে তার দ্বারা কিছু না কিছু বলা হবে, বা কোনো বার্তা দেওয়া হবে।

মৃ:  আমি একেবারেই তার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি সেধরণের ছবি কখনও বানাবো না। তবে যদি দেখি এমন কোনো কাজ রয়েছে যেটা স্রেফ আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, আমি তাকে কখনোই সটান ‘না’ বলে নাকচ করে দেব না। আমার যথেষ্ট আগ্রহ থাকবে তার ব্যাপারে। দর্শকের সাথে ভাবনার আদান-প্রদানের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয়, তবে আমি হয়তো এ’রকম ছবি থেকে দু একটা কায়দাকানুন ধারও নিতে পারি। উদাহরণ হিসেবে নরমান ম্যাকল্যারেনের কথাই ধরুন না [(১৯১৪-৮৭) স্কটিশ ক্যানাডিয়ান অ্যানিমেশন-শিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজক]–বিচিত্র সব থিমের ওপরে ছবি বানিয়েছেন, আবার এমন ছবিও করেছেন যেগুলো আগাগোড়া আইডিয়া-বিবর্জিত, স্রেফ কিছু প্যাটার্নের খেলামাত্র–আমার তো ওঁর প্যাটার্নগুলো অসামান্য লাগে। উনি এধরণের যে;কটা ছবি বানিয়েছেন, সেগুলো নিয়ে আমি খুবই উৎসাহী। 

রা: এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, যখন আমরা এই ছবিটা শুরু করলাম, আপনাকে কিন্তু বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। আর আপনার বন্ধুবান্ধব অনেকের মুখেই শুনেছি আপনি নাকি খুব নার্ভাস প্রকৃতির। এটা সত্যি নাকি?

মৃ: আমি জীবনে এর আগে কখনো ক্যামেরার সামনে আসিনি। যখন আপনি প্রশ্ন করছিলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে আমার ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে উঠব। সেজন্যই বোধহয় একটু নার্ভাস লাগছিল। বেশ কয়েকবার আমতা আমতা করছিলাম। আর আমার জবাবগুলোও সবসময় ঠিকঠাক হচ্ছিল না। শট নেওয়া হয়ে গেলে পরে মনে হচ্ছিল জবাবগুলো বোধহয় অন্যভাবেও দেওয়া যেত। 

রা: আপনার মনে হয় না, জীবনে একবার না একবার ক্যামেরার সামনে আসাটা নিজেকে পরখ করে নেওয়ার একটা ভালো উপায়?

মৃ: সে তো বটেই, আমি ভেবেছিলাম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কী করতে হয় না হয় সে’সব বুঝি আমার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু যখন নিজে হাতেকলমে করতে গেলাম, দেখলাম কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমার মনে হয় এটা আরো অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি সত্যিই জানি না। আমার সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হচ্ছে, যখন আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই, তখন আমার হাত দু’খানা নিয়ে যে কী করব সেটা কিছুতেই ঠিক করতে পারি না। 

রা: আপনি তো বেশ কয়েকটি প্রোভোকেটিভ ছবি করেছেন। এমনকি আজও আপনার ইচ্ছে হচ্ছে আমাকে নানাভাবে উসকে দিতে। আপনার কি মনে হয় একটা ছবির উচিৎ দর্শককে উসকে দেওয়া, দিলেও সেটা কতটা?

মৃ: ফিল্ম তো উসকে দেয়ই। একটা সময় ছিল যখন আমি নিজেকে এজেন্ট প্রোভোকেটর বলতাম। দর্শক আমার সাথে একমত হল কি হল না ততটা জরুরি ছিল না সে প্রশ্নটা। আমার কাজ তাদেরকে উসকে দেওয়া–দর্শককে বিচলিত করা–তারপর একটা প্রতর্ক উসকে দেওয়া–সেটা আমার সাথে দর্শকের না হলেও, হবে দর্শকের সাথে তার সহ-দর্শকের। একটা ছবি করেছিলাম– নাম পদাতিক— কলকাতা-ত্রয়ীর তৃতীয় ছবি। সেসময় মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরা যে আন্দোলনটি করছিলেন (নকশালবাড়ি আন্দোলন)– আমি যদিও তার ঘোর সমালোচক ছিলাম– কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম ছবিতে যেন কোনোভাবে তার কুৎসা না করে ফেলি। আত্মসমালোচনা আর কুৎসার ভেদরেখা কখনো কখনো খুবই সূক্ষ্ম হয়, সে ব্যাপারে আমি ছবি করার সময় ভীষণ সচেতন ছিলাম। পদাতিক বাংলার বেশ কয়েকজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কর্মীর একেবারেই মনে ধরেনি। ওঁরা ছবিটাকে রীতিমত অপছন্দ করেছিলেন। তবু, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছিলেন তাতে, রাজনৈতিক দিক থেকে। একটা ছবি যদি রাজনৈতিক আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে–আমার পক্ষে সেটুকুই যথেষ্ট। আপনার ছবিটা পছন্দ হল কি না–আমার দৃষ্টিভঙ্গি আপনি গ্রহণ করলেন কি করলেন না–সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এই যে আমার ফিল্ম একধরণের অনুঘটকের কাজ করল, বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়ে বাদানুবাদ উসকে দিল, এখানেই বোধহয় আমি উৎরে গেছি।

রা: আচ্ছা মৃণাল, আপনি কি দর্শককে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে পছন্দ করেন?

মৃ: হ্যাঁ, তা করি বটে। কিন্তু তার পাশাপাশি আমি জবাবও দিই, অথবা তার সূত্র ধরিয়ে দিই। আমার ছবিতে দর্শকের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন থাকে, আজ বেশ কিছুকাল ধরে আমি যেটা করছি সেটা হল, ছবির শেষগুলো অমীমাংসিত রেখে দেওয়া। কোনো নিশ্চিত নিষ্পত্তিতে পৌঁছনোর অভিপ্রায় আমার নেই, কারণ জীবনের বেশিরভাগটাই আমার মনে হয় নিষ্পত্তিহীন। আমরা স্রেফ পরিস্থিতিগুলো বিশ্লেষণ করতে পারি, যাতে দর্শক যতক্ষণ না নিষ্পত্তি খুঁজে পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্ন করে চলে। 

রা: এই যে আপনি ন্যারেটিভ, যেটা কিনা একটা গল্প-বলার ফর্ম, সেখানে এরকম পন্থা অবলম্বন করছেন – এটা আমার বেশ কঠিন লাগে। যেভাবে ফর্মটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে তার একটা শেষ বা পরিসমাপ্তি তো থাকবেই, সেই পরিণতিতে কোনো নিষ্পত্তি না হলেও: কারণ গল্প-বলার তো একটা শেষ আছে। অতএব এটা একটা স্ববিরোধ।

মৃ: মানে আপনি বলতে চাইছেন স্ববিরোধটা কাঠামোর মধ্যেই আছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে নিষ্পত্তি আপনাকে পেতেই হবে। আপনার হয়তো একটা পরিসমাপ্তি থাকবে, কিন্তু সেটাকে একটা পর্যায়ে অমীমাংসিত রেখে দিতেই পারেন।

রা: ভাবনার স্তরে আমার মনে হয় দর্শক চাইবে জিনিসটাকে অমীমাংসিত রেখে দিতে, কিন্তু আবেগ-অনুভূতির স্তরে, আমার আন্দাজ, ওরা সবসময়েই কোনো না কোনো পরিসমাপ্তি প্রত্যাশা করে। 

মৃ: কিন্তু আপনি একটা পরিসমাপ্তির ইঙ্গিতটুকু দিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন। যেমন আপনার নাইফ ইন দা হেড (১৯৭৮) আর ম্যান ইন দ্য ওয়াল (১৯৮২) ছবিতে আপনি একটা শেষের ইঙ্গিত দেন, মীমাংসার ইঙ্গিত করেন, কিন্তু তবু সেটা নিষ্পত্তিহীন থেকে যায়। তারপর যে যার ইচ্ছে মত সেটার অর্থ নিরূপণ করুক না।

রা:  এটা দর্শকদের একটা সমস্যা, যেহেতু তাদের একটা পরিসমাপ্তি দরকার…

মৃ: …তার সাথে মীমাংসা ও নিষ্পত্তি। চামচে করে খাইয়ে দিলে দর্শকরা খুব খুশি। তারা মাথা খাটাতে নারাজ।

রা: হ্যাঁ, তবু হয়তো আমরা আমাদের ফিল্ম সম্বন্ধে তাদের ভাবতে বাধ্য করতে পারি। আমাদের উচিত তাদের একটা পরিসমাপ্তি দেওয়া। আমার ধারণা, অমীমাংসিত রেখে দেওয়ার চাইতে হয়তো সেটাই ভালো।

মৃ: কোথাও একটা গিয়ে তো থামতে হবেই ফিল্মকে। সেটা একশ-বার সত্যি। ফিল্ম কোথাও একটা গিয়ে থেমে যায়, কিন্তু সেটা যে সবসময় নিষ্পত্তি দেয় তা-ও তো নয়।

রা: কোনো স্থায়ী নিষ্পত্তি নেই, হয়তো এটাই গল্পের একমাত্র নিষ্পত্তি, কিন্তু এটা আরো খানিক দূর অবধি যাওয়া উচিত।

মৃ: হ্যাঁ, আরো দূর অবধি যাওয়া উচিত। দর্শকের মনে থেকে যাওয়া উচিত তার রেশ। সেই জন্যই আমার মনে হয়, এধরণের সৃষ্টিশীল কাজে দর্শকদের অংশ নেওয়াটাও ভীষণ জরুরি। পরিচালক, যিনি ছবি করছেন, তাঁকে মাথায় রাখতে হবে যেন তিনি দর্শকের হাতে কিছু সূত্র ধরিয়ে দিতে পারেন, যাতে করে সে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ছবির পরিস্থিতিকে মিলিয়ে দেখতে পারে। এভাবেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে থাকাকালীন হয়ে ওঠেন একজন সৃষ্টিশীল অনুঘটক। এরকম অনুকূল পরিবেশ যদি তৈরি করা সম্ভব হয় (তখনই সম্ভব যখন আমরা সেই ধরণের ছবি তৈরি করব, তার সঙ্গে দেখা পাব উপযুক্ত দর্শকের) যখন স্রষ্টা আর দর্শকের মধ্যে একটি মিলনক্ষেত্র প্রস্তুত করা যাবে, সেই মুহূর্তে একটা অন্য কিছু ঘটতে আরম্ভ করবে। তখন আপনি আপনার দর্শকের সামনে কিছু পেশ করবেন, দর্শক তার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখবে, অতঃপর সেই দর্শক পৌঁছবে এমন একটি সিদ্ধান্তে, যেটি মোটেই আপনার নয়…

রা: এমনটা নিশ্চয়ই সম্ভব…

মৃ: …আর সেটা, আমার মতে, হলে ভালোই হয়। আমার মতে সেটাই আদর্শ পরিস্থিতি, যেখানে আপনি আপনার দর্শককে একটা সৃষ্টিশীল কাজের অংশীদার করে তুলছেন, তাকে উসকে দিচ্ছেন স্বয়ং সৃষ্টিশীল কাজের একজন সক্রিয় অনুঘটক হয়ে উঠতে। এই একই কারণে আমি দর্শকদের উসকে দিতে চাই।

রা: পুরোটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা মাথা খাটিয়ে তাদেরকে ম্যানিপুলেট করছি– তার ওপর।

মৃ: আর তারাই বা কতটা বুদ্ধি খাটিয়ে সেই ম্যানিপুলেশনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।

রা: হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি ম্যানিপুলেটর হওয়ার পক্ষপাতী?

মৃ: না হওয়ার কী আছে? আমি একজন ম্যানিপুলেটর তো বটেই, এমনকি আপনিও!

রা: মানছি আপনার কথা। কিন্তু আমি চাই কেউ একটা পর্যায় অবধি আমায় ম্যানিপুলেট করুক, তার অতিরিক্ত হয়ে গেলে সেটা আমার পছন্দ নয়।

মৃ: একটা সময় ছিল, যখন বেজায় বুকনিবাজ ছিলাম আমি– কথায় কথায় বুলি ঝাড়তাম, তখন আমরা সকলেই মনে মনে এক শিশুসুলভ আশাবাদ পুষে রেখেছিলাম– ভাবতাম বুঝি রাস্তার মোড় ঘুরলেই দেখব– আশা বলে একটা জিনিস দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা আমাদেরকে সেরকমই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছিলেন– তার ছোঁয়াচ আমিও এড়াতে পারিনি। সে-সময় অত্যন্ত বুকনিবাজ নীতিবাগীশ কয়েকটি ছবি করেছি– আর বলে বেড়িয়েছি– কেউ যদি আমার ফিল্মকে ইস্তাহার বিলির মঞ্চ মনে করেন, তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাব না আমি। কথাটা যে খাঁটি ছিল তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু লাভের লাভ হয়নি খুব একটা। কারণ ওসব করে বাস্তবকে যথাযথ দৃষ্টি দিয়ে দেখানো সম্ভব হয়নি, মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপদান করতেও সাফল্য আসেনি বড়-একটা। অতঃপর, নিজেকে শুধরে নিয়েছি আমি।

জার্মান চলচ্চিত্র-পরিচালক রাইনহার্ড হফের জন্ম ১৯৩৯ সালে জার্মানির মারবুর্গে। যুবাবয়সে সাহিত্য ও সমাজতত্ত্বের পাঠ নিতে গিয়েছিলেন মিউনিখে, কিন্তু ঘটনাচক্রে অক্ষচ্যুত হয়ে ঢুকে পড়েন বাভারিয়া স্টুডিও-তে। টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করেন একাধিক তথ্যচিত্র ও অনুষ্ঠান। চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি হয় লব্ধপ্রতিষ্ঠ পরিচালকদের সহকারী হিসেবে। ১৯৭৩ সালে জার্মানির নতুন প্রজন্মের অন্যতম খ্যাতনামা পরিচালক ভোলকার শ্লন্ডর্ফ ও প্রযোজক এবার্হার্ড ইয়ুঙ্কার্সডর্ফের সাথে একটি প্রযোজনা সংস্থার পত্তন করেন, যার নাম বায়োস্কোপ ফিল্ম।


অনুবাদ সম্বন্ধে দু-চার কথা

এই অনুবাদটি করার সময় আমরা মূল বয়ানের কিছু ইংরেজি শব্দ অপরিবর্তিত রেখেছি, যেমন: থিম, আইডিয়া, কনসেপ্ট, প্যাটার্ন, প্রোভোকেটিভ, ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি, যেহেতু শব্দগুলি বাংলা কথোপকথনে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া গা-জোয়ারি তর্জমা করলে সংলাপ কৃত্রিম ঠেকতে পারে– এমন আশঙ্কাও ছিল। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে বহুলব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি শব্দকে আমরা বাংলায় অনুবাদ করেছি, কারণ আমাদের ধারণা তাদের বাংলা প্রতিশব্দ যথেষ্ট সুপরিচিত–আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োগে তারা একই অথবা নিকটবর্তী কোনো দ্যোতনা বহন করে। আবার কতিপয় শব্দ/শব্দবন্ধ, যা আমাদের নিত্যদিনের কথোপকথনে বড় একটা উঠে আসে না–কিন্তু শিল্প ও জ্ঞানচর্চার প্রাঙ্গনে হাজিরা দেয় ঘন ঘন– ভবিষ্যতের কথা ভেবে খানিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাদের বঙ্গীকরণ করা হল। 

শেষ দু-ধরণের কিছু শব্দ ও তাদের বাংলা প্রতিশব্দের একটি তালিকা: 

অবয়ব – form, আবহ – climate, একাত্ম অনুভব করা – identify, কায়দাকানুন – technique, বস্তুজগৎ – physical reality*, বিষয় – content/subject, মুক্ত আঙ্গিক – open form, সর্বজনীন সংস্কৃতি – common culture, প্রতর্ক**/বাদানুবাদ – discourse, সৃষ্টিশীল অনুঘটক – creative agent

* এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ শ্রী অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক)

**দ্রষ্টব্য: গৌতম ভদ্র প্রণীত ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার (ছাতিম বুকস, ২০১১), পৃ: ৩৭৯-৮০

Leave a comment