মাইকেল হানেকের ফানি গেমস্: অবিনির্মাণের চলচ্চিত্রায়ণ

স্ত্রী-পুত্র-স্বামীর সুখী সংসারঃ মাইকেল হ্যানেকের ফানি গেমস
ফানি গেমস ছবির ডিম চাওয়ার দৃশ্য

ফানি গেমস্ (১৯৯৭) ছবির ব্যাপারটা আপাতভাবে খুবই সরল — পরিপাটি স্ত্রী-স্বামী-পুত্রের এক সংসারে হঠাৎই প্রবেশ করে পল আর পিটার নামক দুই অজ্ঞাতকুলশীল যুবক। তারা ঘরে প্রবেশ করে ডিম চাওয়ার ছুতোয়। পাশের বাড়ি থেকে ডিম চাওয়ার স্বাভাবিক দৈনন্দিনতা হঠাৎই পরিণত হয় অস্বাভাবিক এক নিয়মহীন খেলায়। আমাদের মনে পড়তে পারে আলফ্রেড হিচককের রেয়ার উইণ্ডো (১৯৫৪) ছবিটির কথা প্রসঙ্গক্রমে — আমার পাশের বাড়িতেই কীভাবে এক খুনির আবির্ভাব হয় তা আমি নিজেই টের পাই না। দৈনন্দিনতাই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে, আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। মূলত মেলোড্রামা হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবোচিত যে অবশেষটুকু পড়েছিল হিচককের থ্রিলারে তাও যেন অবলুপ্ত হয়ে যায় হানেকের ফানি গেমস্-এ। ছবিটি সর্বার্থেই এক খেলা হয়ে ওঠে। রোজকার এক ঘটনা থেকে সূত্রপাত হয় যাবতীয় সমস্যার। তারপর ধীরে ধীরে অসহায় হয়ে পড়ে বাড়ির মালিক, স্ত্রী-পুত্রসহ। হানেকে ক্রমশ আমাদের নিরাপদ দেখাকে বিপন্ন করে তুলতে‌ সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। বুর্জোয়া গার্হস্থ্যযাপন প্রায়শই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কোনো এক রহস্যময় অমঙ্গল শক্তির অনুপ্রবেশে। ‘অমঙ্গল’ শব্দটির অন্তর্নিহিত কূটাভাস হয়তো আমাদের বুঝতে সাহায্য করতে পারে পুনঃপুনঃ ঘটতে থাকা এই অনুপ্রবেশের তাৎপর্য। প্রাসঙ্গিকভাবে, মাইকেল হানেকের দর্শকের খেয়াল হতে পারে ক্যাশে (২০০৫) ছবিটির কথা — সেখানেও আমরা দেখেছি ‘অমঙ্গল’-অনুপ্রবেশের এক হতবুদ্ধি করে দেওয়া সমগোত্রীয় উপস্থিতি। অনুপ্রবেশের ধারণা যে ইউরোপীয় আর্ট ফিল্মের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং তা যে উন্মোচন করতে পারে সত্ত্বা বিষয়ক প্রশ্নের নানা স্তর, তা নির্দেশ করে টমাস এলসেসার আমাদের জানান এই হামলাকারী প্রায়শই স্বামী-স্ত্রী-পুত্রের ছোট পরিবারের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যার আত্ম-অবিনির্মাণের’ ‘অনুঘটক’। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে এর উপস্থিতি ইতিবাচক। এলসেসার নির্দেশিত এই ইতিবাচক দিকটি অবিনির্মাণের সূত্র ধরে পড়া যেতেই পারে। পাশ্চাত্য মেটাফিজিক্সের শুরু থেকেই রয়ে গেছে থাকবন্দের (hierarchy) প্রণালী। ভাবা যেতে পারে যে থাকবন্দের আপাত নির্দিষ্টতায় দোলাচল ধরাই দেরিদার দার্শনিক প্রকল্পটির উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্য দর্শনের ন্যায়কেন্দ্রিকতার (logocentrism) মধ্যে অতিরিক্ততার ধারণা নিয়ে আসে অবিনির্মাণ (deconstruction)। এই অতিরিক্ততা আসে দোলাচল থেকে। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক্ দেখান যে “অবিনির্মাণ টেকসই বস্তুর তাপ্পি খোলে, জ্ঞানের আপাতদৃষ্টিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ভূমিতে অন্তহীন কম্প লাগায়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র বজায় রাখে”ফানি গেমস্ একইভাবে ‘কম্প লাগায়’ আতিথ্যের চিরচেনা ধারণায়। অতিথি ও অতিথিসেবকের অবস্থানের নির্দিষ্টতা খসে যায়। কে যে অতিথি, আর কার যে ঘর কিছুই নির্ণয় করা যায় না। অবিনির্মাণের পদ্ধতিতে যেভাবে প্রায় টের পাওয়া যায় না কোনটা মূল টেক্সট আর কোনটাই বা আসছে রেফারেন্স হিসেবে। বর্তমান প্রবন্ধটিতে দেখানোর চেষ্টা করব কীভাবে অতিরিক্ততা আর দোলাচলের প্রতিরূপায়ণে হানেকের ছবিটিই হয়ে উঠছে অবিনির্মাণ পদ্ধতির চলচ্চিত্রায়ণ। আতিথ্যের ধারণাটি নিয়ে পুনর্বার ভাবতে প্ররোচিত হই। খেয়াল করি যে প্রশ্নের মুখে পড়ে (দর্শক হিসেবে) আমার সক্রিয়তা। নিজের ঈক্ষণকামী অবস্থান নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম। কিন্তু তাও বিঘ্নিত হয়। যে গোপন স্বায়ত্বশাসন দাবি করে ঈক্ষণকামের বিষয়ী, তাও আর নিরাপদ থাকে না ছবিতে। ঐ দুই ক্রীড়ারত অজ্ঞাতকুলশীল যুবক বেশ জানে কে তাদের দেখছে — কেবল তারাই অতিথি নয়, দর্শকরাও যেন অতিথি হয়ে ওঠে এই খেলায়। বিষয়ের ‘নিজস্ব’ মুহূর্তে বিষয়ী চায় তাকে আত্মগত করতে। আর “দৃষ্টি ফেরত দেবার শর্তই হল বিষয়ীর দৃষ্টি সম্পর্কে অপরের চৈতন্য’ এবং তা বিষয়ীর ‘বীক্ষণকে টলোমলো করতে [পারে] এবং পারস্পরিকের মধ্য দিয়ে প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা সূচিত [হয়]”। তাই যদি হয়, তবে আমাদের, ফানি গেমস্-এর দর্শকদের, কোনো আড়াল নেই। এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। আখেরে এই খেলাই আমাদের বিপন্ন করবে। আমরাও কি তবে পল আর পিটারের অতিথি? পল আর পিটারের দর্শক হয়ে কি যথাযথভাবে সীমা (‘threshold’) অতিক্রম করতে পারছি আমরা? পারছি কি নিজের পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠতে? পল আর পিটার সম্ভবত উঠতে পেরেছে। তবে আতিথ্য সম্পর্কিত আশঙ্কাটি কোথায়? অবিনির্মাণের পদ্ধতিটিই বা কীরকম?

মোটামুটি টের পাওয়া গেল মাইকেল হানেকে কাজ করছেন একটি গভীর দার্শনিক সমস্যা নিয়ে। তবে ফানি গেমস্ ছবিটির গ্রটেস্ক দৃশ্যাবলির পরতে পরতে ইচ্ছাকৃতভাবে রয়ে গেছে স্থূল রসিকতা। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে প্লেটোর সংলাপ ভেস্তে দেয় ইয়ার্কির মুখোমুখি গম্ভীরতাকে দাঁড় করানোর প্রবণতাটিকে। হানেকেও কি চান এমনই এক গুরুগম্ভীর আলোচনা যা কৌতুকময়? আদর্শ রাষ্ট্র বানানোও এক খেলার মতো যেন। তাই, কীরকম হবে আদর্শ সেই রাষ্ট্রের নেতৃবর্গ, সেখানকার মানুষ, এ নিয়ে বলতে বলতে রিপাবলিক-এ যখন গম্ভীর হয়ে যান সক্রেতিস, তখন আত্ম-তিরষ্কারের সুরে বলেন, যা বললাম তা বলে ফেললাম বেশ গম্ভীরভাবেই — ‘I forgot we were playing and spoke too vehemently.’ হানেকেও যেন দার্শনিক কচকচির মধ্যে ভুলতে দিতে চান না যে আসলে আমরা খেলছি। অ্যাথেন্সে এরকমই এক দ্বৈধের মুখে পড়েন সক্রেতিস তাঁর শেষ বিচারের সময়। বোঝা যায় না তিনি কি একজন বিদেশি? আলঙ্কারিক ভাষাব্যবহারে শ্রেষ্ঠ সক্রেতিস বুঝতে পারেননা আদালতের কেজো ভাষা। তাঁর যেহেতু সেই দক্ষতা নেই, নিজেকে মনে হয় এক ‘বিদেশি’। অফ হসপিটালিটি গ্ৰন্থে এই প্রসঙ্গে জাঁক দেরিদা পুনর্বার ভাবতে শুরু করেন আতিথ্যের স্বভাবধর্ম (ethics) বিষয়ে। আত্ম-অপরের সম্পর্ক পাশ্চাত্য দর্শনের একটি মূলগত সমস্যা। প্রথাগতভাবে এই সম্পর্কটি পর্যবসিত হয় প্রায় প্রভু-ভৃত্যের এক অসম সম্পর্কে যেখানে আত্ম সবসময় অধিকার করতে চায় অপরকে। অধিকার করবার মধ্যে রয়েছে অপরকে বস্তুতে পরিণত করবার প্রবণতা। বিংশ শতাব্দীতে ইমানুয়েল লেভিনাস ও জাঁক দেরিদার মতো দার্শনিকেরা আত্ম-অপরের সম্পর্ককে পড়বার চেষ্টা করেছেন স্বভাবধার্মিকভাবে — কীভাবে অপরের স্বরূপকে গ্রহণ করতে পারে আত্ম? এর মধ্যেও রয়েছে এক ধরণের অসম্ভব্যতা। অবিনির্মাণের স্বভাবধর্ম ধরে, আতিথেয়তা, ক্ষমা, বন্ধুত্ব, হিংসা, মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে জাঁক দেরিদার দার্শনিক ভাবনা আমাদের গোচরে আনে (অ)সম্ভব্যতার সূত্রগুলি। অপরকে অধিকার না করে, তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এ এক (অ)সম্ভব প্রচেষ্টা। নৈতিকভাবে ভেবে দেখলে, যে মুহূর্তে বিদেশি প্রবেশ করে অন্দরে, সত্তার আপাত সুরক্ষিত স্থিরতায় এক কঠিন আঘাত পড়ে। আমন্ত্রণ জানানো এক স্বভাবধার্মিক প্রক্রিয়া এবং আমন্ত্রণের মুহূর্তে আমন্ত্রক ত্যাগ করেন তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ, কেননা অপরের দায় গ্ৰহণ করবার প্রতিশ্রুতি নিহিত এই কাজে। নিজের ঘর দুয়ার খোলা রেখে নিজেকে বোঝানো “আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে,” অপরের প্রতি এই চিরসমর্পণ ব্যক্তিসত্তা বিষয়ে এত গভীর দার্শনিক সমস্যা উন্মোচিত করে যে আমন্ত্রণ, স্বভাবধার্মিকভাবে, এক (অ)সম্ভাব্যতা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি আরেকটি সমস্যার উত্থাপন করেন দেরিদা:

To dare to say welcome is perhaps to insinuate that one is at home here, that one knows what it means to be at home, and at home one receives, invites, or offers hospitality, thus appropriating for oneself a place to welcome [accueillir] the other, or, worse welcoming the other in order to appropriate for oneself a place and then speak the language of hospitality.

দেরিদার ‘অফ হসপিটালিটি’ বই

অতিথি আর অতিথিসেবকের অবস্থানের নির্দিষ্টতায় যেন এক দ্বিধা সঞ্চারিত হল। কখনো কি একটি ঘর নির্ণয় করতে পারেন আমন্ত্রক? নাকি আমন্ত্রণ করবার মাধ্যমেই তিনি ঘরকে নিশ্চিত করেন? টের পাওয়া যায় এই খটকাটি — অপরকে আমন্ত্রণ করব কীভাবে, আমার নিজেরই তো নির্দিষ্ট ঘরের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সক্রেতিসেরও অ্যাথেন্সে মনে হচ্ছিল যে তিনি বিদেশি। আমারও তো নিজের ঘরের নিরালায় হঠাৎই কিংকর্তব্যবিমূঢ় বোধ হয়। ঘরে কীভাবে যেন এক উনহেইমলিশ প্রবেশ করে। যখন ঘরই নেই তখন আমন্ত্রণ করব কীভাবে আমি? আমন্ত্রণ তো জানাবো আমি নিজের বা নিজের ঘরের ওপর কর্তৃত্ব ত্যাগ করতে। এই দুইয়ে মিলে কি সৃষ্টি হচ্ছে না এক অসম্ভাব্যতার? ঘর বিষয়ক একটি বক্তৃতা অরিন্দম চক্রবর্তী শেষ করেছিলেন এই বলে, “নিজের ঘর সেখানে ফেরত গিয়ে আমি বুঝি এটা আমার নিজের ঘর নয়। আমার এই নিজের ভাবটাকে দূর করবার জন্য আমার ঘরে বসেই এই জ্ঞান হতে পারে”। অদ্ভুতভাবে ধ্বসে যায় ক্ষমতা ও মালিকানার ভাবনাগুলি। ঘরের সাথে যে আগলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, তা প্ররোচিত করে আমাদের সুরক্ষিত মালিকানার দিকে। বুদ্ধ ভগ্নস্তূপ ঘরের চিত্র অঙ্কিত করে তার সাথে তুলনা করেছেন লোভ লালসা মুক্ত এক আমি-র। ‘বেঘর’ আর ‘বে-আমি’ যেন এক। ঘরের নির্মাণই যেন হয় অপরের উদ্দেশ্যে। প্রশ্নাতীত স্বাগত জানানোই তাহলে আতিথেয়তার মূল। ‘প্রশ্নাতীত’ শব্দটির মধ্যেই রয়েছে নিঃশর্তের ভাবনা। দেরিদা জানান শর্তহীন আতিথেয়তা (‘absolute hospitality’) ন্যায় কানুন দ্বারা বৈধ আতিথেয়তার ভাবনা থেকে গুরুতররকম পৃথক। শর্তহীন আতিথেয়তা প্রত্যাশাহীন, নিষ্প্রশ্ন। নিজ গৃহের দরজা সর্বদা খুলে রাখার ওপরই তা নির্ভর করে — অপেক্ষা করা, কেবল‌ গোলমেলে পরিচয়ের বিদেশির জন্য নয়, সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত অপরের জন্যেও। আত্মের সার্বভৌমত্ব আতিথ্য এতটাই কেড়ে নেয় যে আমার আতিথ্য প্রদানের সম্মতিও চায় অপরের সমর্থন। আতিথ্য তখনই সম্ভব হয় যখন অপর সম্মতি জানায়। অপরের সম্মতির পশ্চাতে আসে আত্ম-র সম্মতি। এই প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণতা খুলে দেয় অন্তহীন এক অপরকে — ‘This responsible response is surely a yes, but a yes to preceded by the yes of the other’।8 তবে কি অন্তহীন অপর অসম্ভাব্য আতিথেয়তার কথা বলে? দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা বইতে, রণজিৎ গুহ অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, কর্তব্যবোধের মধ্য দিয়ে ধরতে চেয়েছিলেন প্রাগভিজ্ঞের (a priori) ক্ষেত্র। বহির্জগতের অভিজ্ঞতা সীমিত করে আমাদের অন্তরের কর্তব্যবোধ। অন্তরের কর্তব্যবোধে রয়েছে অনুভূতির প্রাবল্য। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে, স্বভাবজ যে প্রাগভিজ্ঞ তা বহন করে অন্তহীন অপরকে ধারণ করার সম্ভাবনা। এই অন্তহীনতাকেই যেন স্বাগত জানানো হয় অপরকে স্বাগত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে — ‘The response is called for as soon as the infinite — always of the other — is welcomed’১০ফানি গেমস্-এ কি তবে অন্তহীনতার ভার গ্রহণ করতে পারল না সেই স্ত্রী, স্বামী আর পুত্র? আপন স্বভাব থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন আমরা যে নিষ্প্রশ্ন গ্ৰহণ করতে পারি না অপরের অন্তহীনতাকে?

নাকি অতিথিই কখনো হয়ে ওঠে পরজীবী? অতিথিসেবকের সাথে আর আলাদা করা যায় না তাকে কেননা সে বেঁচে থাকে অতিথিসেবকের শরণে। শরণে নাকি তাকে অধিকার করে? আতিথ্যের স্বভাবধর্ম সমগ্ৰ আলোচনার প্রেক্ষিতটি তৈরি করে। তবে হানেকে, প্রকৃতপ্রস্তাবে, সচেষ্ট থাকেন পরজীবী সংক্রান্ত বীভৎসতার প্রতিরূপায়ণে। ফানি গেমস্-এর খেলা আসলে অতিথিসেবককে দখল করবার খেলা। দৈনন্দিনতা ছেনে বেরিয়ে আসে এক ভয়াবহতা যেখানে অতিথিসেবক ক্রমে আক্রান্ত হতে থাকে। পল আর পিটারের কোনো কুলকুলজি আমরা জানিনা। তাদের আগমন হয় আচম্বিতে। এসেই তারা প্রশ্নের মুখে ফেলে ছোট সেই পরবিবারকে। প্রশ্নটি আস্তিত্বিক। অফ হসপিটালিটি-তে জাঁক দেরিদা বলেন এই বিদেশি আদপে পিতৃহন্তা — সে প্রবেশ করে গৃহকর্তার সার্বভৌমত্ব নষ্ট করে। গৃহকর্তার সার্বভৌমত্বর সঙ্গেই সম্পৃক্ত ন্যায়কেন্দ্রিকতা। বিদেশি নাড়িয়ে দেয় ‘the threatening dogmatism of the paternal logos১১। এতক্ষণ তাও এক অবস্থানগত নিশ্চয়তা বোঝা যাচ্ছিল — কেউ কেউ ঘরের কেউ কেউ ঘরের বাইরের। ধীরে ধীরে সেটিও অস্পষ্ট হয়ে যায়। ফানি গেমস্-এ পাঁচজনের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বিদেশি। অতিথির হন্তারক সত্তা হয়ে ওঠে স্পষ্টতর। ঘরের বীভৎসতা ধীরে ধীরে প্রকট হয়। এখানেই বোঝা দরকার প্যারাসাইট ও হোস্টের সম্পর্ক। এই সম্পর্কই প্রকাশ করে হানেকের ছবিটি কীভাবে হয়ে ওঠে অবিনির্মাণ প্রদ্ধতিটিরই চলচ্চিত্রায়ণ। জে. হিলিস মিলার তাঁর ‘দ্য ক্রিটিক অ্যাজ হোস্ট’ প্রবন্ধে এই সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এম.এইচ. আব্রামসের একটি লেখার প্রতিসমালোচনা করতে গিয়ে তিনি দেখান, আসলে প্যারাসাইট আর হোস্টের কোনো অবস্থানগত স্থিরতাই থাকে না আর। যেটাকে মনে হয়েছিল আক্রান্ত হোস্ট আর আক্রমণকারী প্যারাসাইট, তা ত্রিমুখী কাঠামো তৈরি করে। সম্পর্কটি গেস্ট, হোস্ট আর প্যারাসাইটের এক ত্রিকোণ সম্পর্ক, কোনো পরিপূর্ণ বিপরীত নয়। ফানি গেমস্-এ পল আর পিটার নিছকই কোনো হন্তারক হয়ে আসে না, যেভাবে সাধারণ জ্ঞানে রেফারেন্স আসে টেক্সটে। স্ত্রী স্বামী পুত্রের সেই ঘরও টিকতে পারবে না, পল আর পিটার ছাড়া। হোস্টেরও প্রয়োজন প্যারাসাইটকে। এটিই অবিনির্মাণের স্বভাবধর্ম। যেরকম দেরিদা জানান অপরের হ্যাঁ-র অগ্ৰাধিকার বিষয়ে, অরিন্দম চক্রবর্তী বে-ঘর হবার মধ্যেই খুঁজে পান সত্তার চৈতন্যময় জাগরণ, সেভাবেই পল আর পিটার ঘরের ‘মালিক’দের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে স্থিরতর অবস্থানকে নাড়িয়ে দিয়ে। ক্রমশ টের পাওয়া যায় অবিনির্মাণের অতিরিক্ততা ফানি গেমস্-এ — উৎসহীন, স্থিরতাহীন। যেন বা, মিলারের ভাষায়,

a strange sort of chain without beginning or end, a chain in which no commanding element (origin, goal, or underlying principle) may be identified. … The relation between any two contiguous elements in this chain is a strange opposition which is of intimate kinship and at the same time of enmity.১২

পাদটীকা:

১) Thomas Elsaesser, “Performative Self-Contradictions: Michael Haneke’s Mind Games,” in A Companion to Michael Haneke, ed. Roy Grundmann (Chichester, West Sussex: Wiley-Blackwell, 2010), 59.

২) তদেব, 59.

৩) গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক্, “অবিনির্মাণ: অনুবাদ,” in জ্যাক দেরিদা: পাঠ ও বিবেচনা, সম্পা. পারভেজ হোসেন ও ফয়েজ আলম (ঢাকা: সংবেদ, ২০০৬), ১৪.

৪) চিরন্তন সরকার, শরীরের সংস্কৃতি সংস্কৃতির শরীর (কলকাতা: অবভাস, ২০১৯), ১৫.

৫) Jacques Derrida, Adieu to Emmanuel Levinas, trans. Pascal-Anne Brault and Michael Naas (Stanford, California: Stanford University Press, 1999), 15.

৬) অরিন্দম চক্রবর্তী, “‘সব পাখি ঘরে ফেরে’: ঘর ছেড়ে ঘরে ফেরার বাস্তু-দর্শন” in এ তনু ভরিয়া: দর্শন আপাদমস্তক (কলকাতা: অনুষ্টুপ, ২০২০), ১৮৫.

৭) তদেব, ১৮৪-৫.

৮) Derrida, Adieu to Emmanuel Levinas, 23.

৯) রণজিৎ গুহ, দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা (কৃষ্ণনগর: আদম, ২০২১), ৩৫-৬, ৫৩.

১০) Derrida, Adieu to Emmanuel Levinas, 23.

১১) Jacques Derrida, Of Hospitality, trans. Rachel Bowlby (Stanford, California: Stanford University Press, 2000), 5.

১২) J. Hillis Miller, “The Critic as Host,” in The J. Hillis Miller Reader, ed. Julian Wolfreys (Stanford, California: Stanford University Press, 2005), 22.


One thought on “মাইকেল হানেকের ফানি গেমস্: অবিনির্মাণের চলচ্চিত্রায়ণ

Leave a comment