আমাদের পুনরুজ্জীবিত জনপ্রিয় মূলধারা প্রয়োজন
একটি প্রস্তাব আছে। সাংস্কৃতিক পশ্চিমবঙ্গীয় ফিল্মমেকাররা তো মূলধারা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছেন। যারা ‘বৌদ্ধিক’ চলচ্চিত্রচর্চা-য় অংশগ্রহণ করতে চান, তাঁরা বিকল্প-তে পা না রাখলে কৌলিন্য পান না; যাঁরা মূলধারায় কাজ করেন, তাঁরা বৌদ্ধিক ‘চলচ্চিত্রচর্চা’-য় পা রাখেন না। এতে আখেরে লাভ হচ্ছে না, কারণ সবাই মূলধারার ছবিই আসলে প্র্যাক্টিস করছেন, বাংলায় আর্ট সিনেমা প্র্যাক্টিস বহুদিন হল হচ্ছে না। অর্থাৎ নতুন ছবির ভাষা, নতুন ছবির ফর্ম নিয়ে দীর্ঘদিন কোনও ভাবনাচিন্তার অবকাশ, সমর্থন বা পরিবেশ পাচ্ছেন না ফিল্মমেকাররা। পেলেও তা জনমানসে বা আগামীর ফিল্মমেকিং-এ ছাপ ফেলতে পারছে না। যদি আখেরে মেনস্ট্রিম ফরমাটে ছবি করাই সার সত্য হয়, তাহলে তা নিয়ে তাত্ত্বিক বা ক্রিটিকাল ভাবনা হবে না কেন? এখানেই সমস্যা। যে তরুণ সিনেমা নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চা করতে চান, তিনি মূলধারার ছবি দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। যিনি মূলধারার ছবি দ্যাখেন, তিনি বৌদ্ধিক কথাবার্তা শুনলেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত রেগে যান।
গত দশ-পনেরো বছরের আমাদের যে ছবিগুলো প্রিয়, তার তালিকা করলেই দেখা যাবে বেশিরভাগই পরিচালকদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি, এবং তারপর তাঁরা পরের ছবি হয় করতে পারছেন না, নয়ত অনেক বছর পরে করছেন – এটা অনেককিছু প্রমাণ করে যা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। আখেরে গতানুগতিক সোজাসাপ্টা গল্প বলাতেই সবাইকে ফিরতে হচ্ছে। একটি সোজা ফর্মুলা হল কলকাতা থেকে দূরে গ্রামে চলে যাওয়া (গিল্ডের হাত থেকে বাঁচা যায়; দশজনের বদলে সত্তরজনের ক্রু নিতে হয়না; শুটিং-এর দিন বাড়ানো যায়); তারপর সেই গ্রামে গোটা দুয়েক বালককে নিয়ে ছবি করা (বালিকা নিয়ে ছবি করতে গেলেই বিশগুণ কঠিন হয়ে যেত!)। এই ফর্মুলায় বেশ কিছু ভাল ছবি আমরা পেয়েছি। কিন্তু যখন তা পুনরাবৃত্ত হচ্ছে তখন ঙ্কী করা যাচ্ছে না তা বড্ড স্পষ্ট হয়ে যায়; এবং বোঝা যায় সংবেদনশীল ছবিও হয়ে পড়ছে ফর্মুলা-নির্ভর।
যদি আখেরে গতানুগতিক ঢং-এ ছাঁচে ফেলা গল্পই বলতে হয়, তাহলে সেই কাজটিকেই যত্ন করে করা নয় কেন? সেই কাজটাই – জনপ্রিয় বক্স-অফিস ফ্রেন্ডলি ছবি বানানোকে – যাতে যত্ন করে করা যায় তার জন্য একটি প্রতিকূল কাজের আবহ, ওয়ার্ক-কালচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা নয় কেন? ইন্ডাস্ট্রিকেই বাঁচানোর জন্য ইন্ডাস্ট্রির নিয়ামকদের সঙ্গে ঝগড়া করা নয় কেন? ইতিহাস ঘেটে দেখুন, যখনই আমাদের ‘আর্ট সিনেমা’ উৎকর্ষে পৌঁছেছিল, তখন আমাদের মূলধারার ছবিও লাভজনক হত, কারণ সেই ছবিও উৎকর্ষে পৌঁছেছিল। অর্থ বিনিয়োগ হলে তার লাভসমেত ফেরত আসাটা নিশ্চিন্ত ছিল বলেই প্রযোজকরা এমন ছবিতে বিনিয়োগ করতে পারতেন যার ব্যবসার তেমন গ্যারান্টি নেই, কিন্তু ভিন্নধর্মী শৈল্পিক উৎকর্ষের সম্ভাবনা আছে, এবং এদিক ওদিক পুরষ্কৃত হলে সেই ছবি দেখার উৎসাহ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলা ছবির জনপ্রিয় মূলধারাকেই সচেতনভাবে পূনরুজ্জীবিত করাটা নতুন ফিল্মমেকারদের কাজ হবে না কেন, যেহেতু আখেরে তাতে বিকল্প ছবির প্রযোজনার সম্ভাবনা বাড়াবে? এবং সত্যি বলতে কী ইন্ডাস্ট্রির যে অবস্থা, আর্ট সিনেমা নয়, সফল জনপ্রিয় ছবি করাই এখন নতুন ফিল্মমেকারদের প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ। জনপ্রিয় ছবিতেই নতুন ভাবনার জোয়ার আনা ছাড়া ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচানোর আমাদের আর উপায় আছে কি? সেই ভাবনা-চিন্তায় সমসাময়িক আন্তর্জাতিক পপুলার ‘ফিল্ম সেন্স’এর প্রয়োগ থাকবে না কেন? এবং তাকে ‘চলচ্চিত্রচর্চা’, অর্থাৎ চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বৌদ্ধিক ডিসকোর্সের অন্তর্গত করে তোলা হবেনা কেন? অর্থাৎ, মূলধারার ছবি বানানো ভাবনা-চিন্তা ব্যতিরেকে হবে কেন?
আমি কিছু তরুণ ফিল্মমেকারদের চিনি, যারা পরীক্ষামূলক জনেরিক ছবি (যেমন হরর) করতে ইচ্ছুক। কিন্তু তারা নিশ্চিত নন যে তাদের কাজ বঙ্গবাজারে উৎসাহ উদ্রেক করবে; তাই তাদের ফেস্টিভাল মার্কেটের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। ফেস্টিভালে গিয়ে তারা দেখছেন যে সেখানকার কর্তাব্যক্তিরা ভিন্ন কিছু মাত্রা চান, যেসব মাত্রা অধিরেখ করা হয়ত তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। অতএব তারা ত্রিশঙ্কুতে ঝুলে থাকেন। এর মূল কারণ বাংলা মূলধারায় জঁর নিয়ে আলোচনা হয়না, হয়না বৌদ্ধিক মহলেও, এমনকি দর্শকমহলও জঁর নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। মানে, তাঁরা একটা হরর ছবি ভয়ের হল কি হল না তা বোঝেন; কিন্তু সেই ধরণের ছবির ইতিহাস নিয়ে অবগত নন। বিস্তারিত করার সুযোগ নেই, এই ‘ইতিহাসচেতনা’ ছাড়া এই যুগে জঁরধর্মী ছবি করা যাবে না।
কেন বাংলা ছবিতে জঁরের ধারণা অত্যন্ত দুর্বল? কারণ শুধুমাত্র অবস্থাপন্ন প্রৌঢ়দের কালচারাল ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় মত্ত থাকলে জঁর নিয়ে না ভাবলেও চলে। যে রাজ্যে যুবসম্প্রদায়ের কর্মসংস্থান নেই তাকে চলচ্চিত্রের প্রধান কনজিউমার করার কীই বা প্রয়োজন এই ইন্ডাস্ট্রির? তাই প্রতিষ্ঠিত প্রজন্মের কালচারপনাই আমাদের ছবির প্রধান পুঁজি। এমনকি মিস্ট্রি ছবিতে মিস্ট্রিটি ঘটার আগে এক ঘন্টা ধরে প্রৌঢ়দের কালচারের প্রদর্শনী চলেছে – এমন বাংলা ছবিও আমি দেখেছি।
অধুনা বাঙালির জঁর-চেতনার দুর্বলতা নিয়ে খানিক বলি। এর সবচাইতে বিরক্তি-উদ্রেককারী সিম্পটম হল বাংলা সিনেমার একের পর এক ফেলুদা আর ব্যোমকেশ করে যাওয়ায়। আপনি বলতে পারেন, পাশ্চাত্যেও তো সেই শতখানেক বছর হল শার্লক হোমস হয়ে আসছে। না, তুলনীয় নয়, তারা হোমস নিয়ে প্রচূর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, আমরা একটা-দুটো দৃশ্যে ফেলুদাকে মোবাইল ধরিয়ে কসমেটিক মেক-আপ দিয়েছি, আখেরে ব্যাপারটা বেখাপ্পা ভাবে সেই সত্যজিৎ যা লিখেছেন তাই চলছে, তবে সত্যজিতের স্মার্টনেস ছাড়া।
প্রথমত, গত একশো-দেড়শো বছর ধরে গোয়েন্দা সাহিত্যে নানান ধরনের বিবর্তন হয়ে আসছে, তার মধ্যে স্থিতিশীলতা পেয়েছিল ব্রিটিশ গোল্ডেন এজ-এর প্রাইভেট ডিটেকটিভের আধারে লেখা গল্প, যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল আর্থার কোনান ডয়েল এবং আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস। কিন্তু আমেরিকাতেই বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আরম্ভ করে বিশ্বযুদ্ধের পরে যে একদম নতুন মডেলের গোয়েন্দা গল্প আসে, যার অন্যতম লেখক হল ড্যাশিয়েল হ্যামেট এবং রেমন্ড শ্যান্ডলার, এবং যে গোয়েন্দা গল্প থেকে ‘ফিল্ম নোয়া’ (film noir) নামক আস্ত একটি চলচ্চিত্রীয় ধারা শুরু হয় চল্লিশের দশক থেকে, তার প্রভাবই আমাদের জনপ্রিয় গোয়েন্দা সাহিত্যে পড়েনি, পরের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উপন্যাসের ধারার কথা তো ছেড়ে দিলাম। এই প্রতিটি ধারায় শুধুমাত্র নতুন গোয়েন্দার মডেল যে আমরা পাচ্ছি তাই নয়, পালটে যাচ্ছে আখ্যানের ধরন, পালটে যাচ্ছে গল্পগুলির নৈতিক বিশ্ব এবং উদ্রেক করছে বিবিধ তদন্তের জটিলতা। সেরকম বিবর্তন আমাদের জনপ্রিয় গোয়েন্দা-কল্পনায় নেই, যারা লিখেছেন সেরকম গল্প (বা ‘ছোটলোক’-এর মত সিরিজের চিত্রনাট্য) আমাদের জনপ্রিয় কল্পনায় বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। অতএব মিতিনমাসি ইত্যাদিতে সেই একই মডেল ঘুরে ফিরে আবর্তিত হয়, সেখানে এই জঁরের ইতিহাস নিয়ে কোনও সচেতনতা নেই। এখানে আমি বইয়ের পাতায় বা পর্দায় ব্যতিক্রমের কথা একদম বলছি না, আমি বলছি সাধারণ ধারণার কথা। অথচ, এই যে বিশ্বসাহিত্যে এখন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কল্পনা অস্তমিত হয়েছে (এবং বাংলা সিনেমায় সেই অস্তমিত সুর্যই একমাত্র আলো), তার বদলে কেন্দ্রীয় স্থান নিয়েছে police procedural, সেরকম গল্পের আদিতম উদাহরণ হল বাংলাতেই লেখা ‘দারোগার দপ্তর’।
সিনেমা থেকে ছোট্ট বিরতি নিয়ে ব্যক্তিগত কথা বলি। আমি গত কয়েক বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লিখছি। আমি মূলত লিখি কল্পবিজ্ঞান গোত্রের গল্প। দুটি উপন্যাস বেরিয়েছে, একটি গল্প-সংকলন। সায়েন্স-ফিকশন হলেও, আমার গল্পের কাঠামো মোটামুটি রহস্য-গল্প বা থ্রিলারের আকারে লেখা হয়। তাতে অতএব জনপ্রিয় উপাদান থাকে, এমনকি গল্পগুলিতে অ্যাকশন ও ভায়োলেন্সও জায়গা পেয়েছে। এর মধ্যেই আমি বৌদ্ধিকতার কিছু উপাদান রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি ওই থ্রিলার-মিস্ট্রি কাঠামোগুলো খুব বেশি নষ্ট না করে। উপন্যাস দুটি ভাল রিভিউ পেয়েছে। কিন্তু আমার হতাশা ভিন্ন জায়গায়। আমার গল্পগুলি সচেতনভাবে ৩৫-এর নিচে বয়সী পাঠকদের উদ্দেশ্য করে লেখা; মূলত ছাত্রযুবদের। কিন্তু তাদের রেসপন্স আমি প্রায় কিছুই পাইনি। যেহেতু আমি আদতে সিনেমার ছাত্র, লেখাগুলিতে অনেক সিনেমাটিক রেফারেন্স থাকে যা গল্পগুলি বোঝার জন্য জরুরি নয়, কিন্তু ধরতে পারলে একধরণের উপভোগ্যতা বাড়ে। যারা ভাল রিভিউ দিয়েছেন, তারা এগুলি খুব একটা ধরতে পারবেন বলে মনে হয়না; বা পারলেও, তা রসাস্বাদনের প্রক্রিয়ায় কীভাবে অন্তর্গত করা তা তার জানা নাও থাকতে পারে যেহেতু তারা হয়ত সিনেমা নিয়ে কম উৎসাহী। এরকম ইন্টারটেক্সচুয়াল অথবা রেফারেন্স-ধর্মী আখ্যান ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের কাছে পরিচিত, তারা সেরকম ছবি-সিরিজ দেখে থাকেন। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার সারমর্ম এরকম – যে তরুণ-তরুণী এই ধরণের গল্প পড়েন, তিনি বাংলা পড়েন না; যে যুবক-যুবতী শুধু বাংলা ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ, তিনি এইরকম ফিকশন পড়েন না; অনেকে ফিকশনই পড়েন না। আমার বাকি জীবন এরকম গল্প লিখে চলার ইচ্ছে, আরো বিভিন্ন জঁরে লেখার ইচ্ছে, কিন্তু সেরকম অনুপ্রেরণা পাই না, কারণ আমি বুঝে গেছি যে এই ধরণের গল্পের ছবি দেখার অভ্যেস যাদের আছে, তারা হয় ফিকশন পড়েনা, নয় বাংলাতে এই সাহিত্য পড়ে না।
তাই ক্রিটিকাল সাফল্য পেলেও আমি আমার লেখাগুলিকে ব্যর্থ বলে মনে করছি। এর কারণ আমাদের উচ্চ-সাংস্কৃতিক ধারণা যে জঁর-সাহিত্য ‘কুলীন’ নয়। এই ধারণাগুলি মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে তৈরি হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের তিরোধান এখানে বড় ল্যান্ডমার্ক ইভেন্ট, কারণ যদ্দিন তিনি ছিলেন, জঁর-কল্পনার হাল্কা হলেও, কিশোরতোষ সাহিত্যে হলেও, চল ছিল। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর পরই যেন আর এইসব ‘বালখিল্য’ চর্চার প্রয়োজন নেই স্থিরীকৃত হয়, কারণ এইসব সাহিত্যে ‘সিরিয়াস’ কিছু হয়না, এমন বেসিকালি অনাধুনিক ধারণায় প্রত্যয়ী হয় বঙ্গ-কালচার। ইদানিং জঁর সাহিত্যের পূণরুত্থান হচ্ছে, কিন্তু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তার যে অগভীরতা, তা প্রমাণ করে যে গত তিন, সাড়ে তিন দশকে এই কল্পনায় একটা বড় ভ্যাকুয়াম আছে। যারা এ ধরণের গল্প লিখেছেন, তারাও লিখেছেন চুপিচুপি, বিশেষ কিছু আশা না করে।
সিনেমায় ফিরি। বাংলাভাষায় বৌদ্ধিক চর্চায় একদম ব্রাত্য (কার্যত পারিয়া) অ্যাকশন ছবির কথা ধরি। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের কথা ধরুন, সেই অগ্নিযুগে কিছু তরুণ ভায়োলেন্সকে পন্থা করে নিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। চল্লিশের দশকের বাংলা যুদ্ধ-মন্বন্তর-কুইটইন্ডিয়া-দাঙ্গা ইত্যাদি দিয়ে উত্তাল, এই সময়েই তেভাগা আন্দোলনের হাত ধরে বামপন্থী রাজনীতির উত্থান, কিছুদিন আগে নেতাজি অন্তরালে চলে গেছেন, সেখান থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এইবার পঞ্চাশের একটু স্থিতির পরই ষাটের দশক শেষ হচ্ছে নকশাল আন্দোলন এবং ওপারে মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। সত্তর দশক তো রাজনৈতিক হিংসা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে আকীর্ণ। এর মধ্যে পঞ্চাশ দশকের জাতিগঠনের আশাবাদ ও সামাজিক স্থিতিই উত্তম-সুচিত্রা যুগের রোমান্টিক মেলোড্রামার ধরনটাকে আকার দিলো। কিন্তু তা বাদ রাখলে বাঙালি কি সমাজে এবং আখ্যানে ভায়োলেন্স নিয়ে একটু কপট নয়? যেখানে ইতিহাস ভায়োলেন্সে আকীর্ণ ছিল গত শতকের অনেকটাই? আমি ‘উচ্চ’-সাহিত্যের কথা বলছি না, বলছি পপুলার ন্যারেটিভের কথা। এইবার ভায়োলেন্স (বা অ্যাকশন, দুটো এক জিনিস নয় ঠিক, সম্পৃক্ত) আমাদের ছবিতে কখন এলো? ৮০-র দশকে; কিন্তু তাও তরলীকৃত ডেরিভেটিভ ফর্মে। কিন্তু যে ছবির থেকে তা derive করা হল – ভেবে দেখুন – অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রিক সেই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর ঘরানা, তা কি পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সবার আগে উদয় হওয়ার কথা ছিল না? ইতিহাসে যে বদলগুলো হয় তা তো একরকম পপুলার মনস্কামণার চরিত্র ও প্লটও তৈরি করে। সেটা বাংলায় হল না কেন? আমি তো প্রমাণ দিলাম, আমরা খুব ‘শান্ত’ মানুষ ছিলাম না। এই সংঘাত এড়ানো নরম চরিত্রধর্মিতাটাই মধ্যবিত্তের কপট ‘কালচারাল কনস্ট্রাক্ট’।
বরং ষাটের শেষ আর সত্তর দশকের ‘সিরিয়াস’ সিনেমার কথা বলি। সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, সিদ্ধার্থ একজায়গায় গণধোলাই দেয়, ক্লাইম্যাক্সে ভাঙচুর করে (“আমরা কি জানোয়ার?”), মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’, আবার ক্লাইম্যাক্সে ভাঙচুর। তপন সিনহার-র ‘এখনই’, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’, ঋত্বিকের শেষ ছবিতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যুবকেরা – মূলত চল্লিশের দশকে যাদের যৌবন অতিবাহিত হয়েছে, সেইসব প্রৌঢ়রা যখন সেই সময়ের যুবকদের নিয়ে ছবি করছেন, সবাই বলছেন যে ভায়োলেন্স এই সময়ের যুবকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য – কেন ‘কমার্শিয়াল’ ছবি সেই আর্কেটাইপ তৈরি করতে পারল না? কেন সেটা ‘হিন্দিবাজারি অতএব আমাদের নয়’ এরকমভাবে অবহেলিত হল বা পরে সেইভাবেই অনুকরণ করা হল? যখন আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টর ব্যানার্জি, চিরঞ্জিত, প্রসেনজিৎরা মারপিট করতে শুরু করবেন – তখন তাতে আর ‘দীওয়ার’, ‘জঞ্জির’-এর নায়কের poignance রইলো না। বরং হয়ে উঠলো মিঠুন চক্রবর্তীর মত খানিক ডেরিভেটিভ লুম্পেন নায়কের প্রতিফলিত ছায়া। অর্থাৎ, তাতে আর আমাদের ইতিহাসের substance রইল না। এবং সেই ‘ডেরিভেটিভ’ ভাব জিৎ এবং দেব অবধি চলেছে, চরিত্রগুলি এবং তাদের গল্প মৌলিক না, ‘অন্যদের মত’। অধুনা যুবকরা যে massy ছবির মত অ্যাকশন বাংলা পপুলারে দেখতে চান, তাও হবে একইরকম ডেরিভেটিভ ও শেকড়হীন।
মৌলিক জঁর-ছবি ছাড়া যুবসম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছোনো যাবে না; এবং তা করতে গিয়ে এমন জঁরের ছবি করতে হবে যা, এক, বাংলায় খুব বেশি হয়নি, আর দুই, যে ছবি সেই জঁরের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন। কারণ, যুবক-যুবতীরা সেইরকম ছবি অন্য ভাষায় দেখতে অভ্যস্ত। আমি আগের কিস্তিতে অ্যাকশন ফিল্ম হিসেবে ‘পারিয়া’-র আলোচনা করলাম। সেই ছবির নায়ক বিক্রম চ্যাটার্জি গত বছরে ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ আর ‘শেষ পাতা’ করেছেন, কিছুদিন আগে ‘সূর্য’ – চারটে ছবি, চাররকম নায়ক চরিত্রে উজ্জ্বল, তবুও তিনি নাকি এখনও স্ট্রাগলিং! এতেই প্রমাণিত হয় যে আমাদের আর তরুণ নায়কের তেমন প্রয়োজন নেই, প্রৌঢ় দিয়েই কাজ চলবে।
যে জাতির শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে যুবসম্প্রদায়ের কাছে সিনেমা কল্পনার খোরাক দিতে পারে না, সেই সিনেমা সুস্থ কী করে থাকে? যে জাতি যুগধর্মে জারিত প্রেমের গল্প, প্রতিশোধের গল্প, দ্রোহের গল্প, মনস্কামনার গল্প শুনতে-দেখতে-চাইতে ভুলে গেছে, নতুন যুগের নায়ক বা নায়িকার কল্পনার প্রয়োজন নেই – সেই জাতি সুস্থ আছে কি?
(চলবে)

আমি অভিনন্দন স্যার। যে কিশোর রহস্য বানিয়েছিলাম। আশা করি মনে আছে আমার কথা। পরিয়ার স্ক্রীনিং এর দিন দেখাও হয়েছিল। পরিয়া যদিও আমার খুবই খারাপ লেগেছে, তবে সেটা অন্য আলোচনা। আমি আপনার অপার্থিব কিনে পড়েছি স্যার। আপনার গল্প সংকলনটির নাম জানতে চাই এবং সেটিও কিনে পড়তে চাই। ১৯৮২এর কথাও জানতে পেরেছি এবং সেটাও কিনে পড়বে। বাংলায় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে খুব বেশি তৃপ্তিদায়ক লেখা পাইনি বলে আপনার লেখা আমার কৌতুহল জাগিয়ে তোলে বারবার। আপনি লেখা থামাবেন না স্যার। তবে আমাদের মত নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছুতে বাংলা কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের বদলে যদি গ্রাফিক নভেল করেন, কিছুটা সুবিধে হতে পারেন। আপনি তো জানেনই যে genre নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ এবং আমি বাংলাতে genre কাজই করে যেতে চাই। এবং আমিও বিশ্বাস করি genre কাজই নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা। তাই অনুপ্রেরণা হারাবেন না স্যার। সময় লাগবে। কিন্তু চাকা ঘুরবে।
LikeLike
হ্যাঁ অভিনন্দন, মনে আছে 🙂
LikeLike