বাংলা সিনেমার সংকট নিয়ে: প্রথম পর্ব

বাংলা সিনেমার সংকট নিয়ে, আবার …। আবার , কারণ এককালে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম বলে … এই লেখায় এবং এই লেখায়

প্রথমেই এই দীর্ঘ লেখায় সংকট বলতে কী বুঝছি তা বলে রাখি। পাঠক যদি সেগুলিকে সংকট বলে মনে করেন তাহলেই বাকিটা পড়বেন। এই বছরে পশ্চিমবঙ্গ আর কেরালার ছবির বক্স-অফিস কালেকশন তুলনা করলে বুঝবেন। এই বছরের সবচাইতে সফল পাঁচটি মালয়ালাম ছবি হল (সূত্র IMDB) –

১। মানজুম্মেল বয়েস – ২৪১.১০ কোটি টাকা (কেরালা বক্স অফিসে ৭২ কোটি টাকা)

২। আদুজীভিথম – ১৫৮.৪৮ কোটি টাকা (কেরালা বক্স অফিসে ৭৯.২৮ কোটি টাকা)

৩। আভেশম – ১৫৬ কোটি টাকা (কেরালা বক্স অফিসে ৭৬.১০ কোটি টাকা)

৪। প্রেমালু – ১৩৫.৯০ কোটি টাকা (কেরালা বক্স অফিসে ৬২.৭৫ কোটি টাকা)

বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল বলে, বক্স অফিসের নিরিখে না হলেও, ৫ম ছবিটি হল ‘ব্রহ্মযুগম’ (৫৮.৭০ কোটি টাকা; কেরালা বক্স অফিসে ২৪.১৫ কোটি টাকা)

বাংলা ছবির এহেন পরিসংখ্যান পাওয়া খুবই মুশকিলের (সংকটের অন্যতম লক্ষ্মণ)। তাও টলিবাংলা বক্স-অফিস নামক একটি ফেসবুক পেজের ওপর ভরসা করে, শুধুমাত্র জাতীয় মাল্টিপ্লেক্স চেনের হিসেব এরকম (সিঙ্গেল স্ক্রিনের হিসেব পাওয়া যায় না) –

গত বছরের শেষের দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রধান’ রাউন্ড ফিগার ১ কোটি ৮২ লাখ (তেরো সপ্তাহ)

১. অযোগ্য: প্রায় ৯৯ লাখ (ছ’ সপ্তাহ)

২. এটা আমাদের গল্প: প্রায় ৬৮ লক্ষ (সপ্তম সপ্তাহ)

৩. নয়ন রহস্য: প্রায় ৫৩ লাখ ( সপ্তম সপ্তাহ)

৪. অতি উত্তম: রাউন্ড ফিগার ৫০ লাখ ( অষ্টম সপ্তাহ)

৫. বুমেরাং: রাউন্ড ফিগার ২৭ লাখ (চতুর্থ সপ্তাহ)

এই বছরটা নাকি বাংলা সিনেমার মন্দ যাচ্ছে না!

সেই সঙ্গে মালয়ালাম সিনেমায় এই ছবিগুলির সঙ্গে আমাদের সফল পাঁচটি ছবির ‘কনটেন্ট’ ও ফর্ম তুলনা করবেন; তুলনা করবেন শুধু ছবিগুলির রোজগারই নয়, ছবিগুলির বাজেটেরও। সেই সঙ্গে ভেবে নেবেন যে ‘মানজুম্মেল বয়েস’-এর মত ছবি কলকাতায় ২০ কোটি টাকার বাজেট পাবে কিনা, কেন পাবে না, এইরকম মান অর্জন করার পরিকাঠামো পাবে কিনা এবং সর্বোপরি, দর্শকের সমর্থন পাবে কিনা।

কেন এই ফারাক? আফটার অল বাংলা ছবি বলে? আমরা কতদিন এমন ‘আফটার অল’ থাকবো? আমরা কতদিন এমন ‘আফটার অল’-এ তৃপ্ত কুয়োর সোনাব্যাঙ হয়ে থাকবো?

যত তাড়াতাড়ি আমরা মেনে নিতে পারব যে বাংলা সিনেমা (আসলে পশ্চিমবঙ্গীয় সভ্যতা) প্রবল সংকটাপন্ন, তত আমাদের সিনেমার মুক্তি দ্রুত আসবে। বাংলা সিনেমা বিবিধ ট্র্যাপে ঢুকে গেছে। এক জাতীয় বাংলা ছবি মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে চলবে না, এক জাতীয় ওটিটির বাইরে টিকবে না, এক জাতীয় ছবি ইউটিউবে থাকবে, এক জাতীয় ফেস্টিভালে ঘুরবে, এক জাতীয় গ্রাম-মফস্বলে যেতে চায়, কখনোই পারবেনা, এক জাতীয় ছবি গ্রামকে ইউরোপে নিয়ে যাবে।

সর্বজনপ্রশংসিত ‘মানিকবাবুর মেঘ’ দেখে এলাম, আর্ট ফিল্ম ঘরানার ছবি; এবং ‘কাউন্টারশট পডকাস্ট’-এ লুব্ধক চ্যাটার্জির সাক্ষাৎকার শুনলাম, তাঁর আসন্ন ছবিটিও আর্ট ফিল্ম ঘরানার ছবি। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ পরিচালকের প্রথম ছবি; তাই ধরে নিচ্ছি তরুণ বাঙালি পরিচালকদের অভীষ্ট হল আর্ট সিনেমা। কেন এটা বললাম? কারণ একমাত্র ‘ফেস্টিভাল’-এর ফিল্ম হলেই মিডিয়া খবর দেয় যে এটি পরিচালকের প্রথম ছবি। শেষ কোন কমার্শিয়াল ছবিকে পরিচালকের প্রথম ছবি হিসেবে চিনেছেন? যাই হোক, ছবি এবং পডকাস্ট দুটোই নানানভাবে মন ছুঁয়ে গেল, কিন্তু মন ভরল না। কিন্তু কেন, এই নিয়ে লিখতে দ্বিধা হয় আজকাল, কারণ মনে হতে পারে আমি এই ছবিটাকে বা তরুণ পরিচালকদের সমালোচনা করছি; আমি আদপেই সেই ভাবটি পোষণ করতে চাইনা। আমি আমার দৃষ্টি থেকে ছবিটাকে ক্রিটিকালি দেখতে চাই, পডকাস্টে যা আলোচিত হয়েছে ক্রিটিকালি শুনতে চাই।

কিন্তু বাংলা ছবির পাশে সদর্থে দাঁড়াতে গেলে যে ক্রিটিকাল দৃষ্টি ছাড়া উপায় নেই! ক্রিটিকাল দৃষ্টি যেটা দেখাতে পারে সেটা হল ছবিগুলি কোন দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, কোন দিকে যেতে পারছে বা পারছে না, অর্থাৎ দিশা কোনদিকে হতে পারে। সোশাল মিডিয়ার আবহে এই ক্রিটিকাল দেখার ভিন্ন সংজ্ঞাকে এখন বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা মুশকিল। অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রটি ‘ভাল ছবি’, লুব্ধকের ছবিটিও ‘ভাল ছবি’-ই হবে। হয়েই আছে; না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু শুধু ব্যর্থ ছবিতে নয়, সফল বা ভাল ছবিতেও সংকটের সিম্পটম থাকে। সেই সিম্পটম নিয়ে কথা বলা মানে ছবিটাকে খারাপ বলা নয়, এই ডিসক্লেমার দিয়ে রাখলাম; বরং বলা যে ছবিটা নিজের করা কোন প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে না এবং কেন পারছে না, এবং সেই না পারাটা কীরকম সংকটের ইঙ্গিতবাহী।

এই লেখায় আমি একটি কমার্শিয়াল ছবিরও আলোচনা করব, তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিয়া’, যে ছবিটিও সর্বজনপ্রশংসিত হয়েছে। এর সঙ্গে এটাও বলে রাখা উচিত যে সোশাল মিডিয়াধর্মী তাৎক্ষণিক নেগেটিভিটি, যাতে ভাবনাচিন্তার কোনো ভূমিকা নেই, সেখানে ক্রিটিকাল কিছু থাকেনা, আমি সেইসমস্ত মতামত থেকে নিজের দুরত্ব রাখছি। তেমনই কাজের কিছু থাকে না হার্ড-মেন্টালিটি গোত্রের সমর্থনেও। কিন্তু আপাতত আবহ এরকমেরই; বললেই তো আর নিজেকে দূরে রাখা যায় না। দেখি, আমার আলোচনার মেজাজ কীভাবে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে।

বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বৃদ্ধি ঘটছে না, মানের অবনতি হচ্ছে। এই পিঠ ঠেকে যাওয়া, একটি দুটি পাড়ায় কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ইন্ডাস্ট্রির ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। গত তিরিশ বছরে আমাদের পরিশীলিত চলচ্চিত্রবোধের প্রসারণ ঘটানো সম্ভব হয়নি; আমরা যত্ন করে তার ক্ষেত্র সংকুচিত করেছি। সেভাবেই যত্ন নিয়ে সংকুচিত করা হয়েছে আমাদের ছবির মার্কেট।

একদা পশ্চিমবঙ্গে আর্ট সিনেমার তরুণ দর্শক নাক-উঁচু ছিলেন। পনেরো বছর আগে একজন বিশ্বসিনেমায় দীক্ষিত যুবক বলতে পারতো যে সারা পৃথিবীতে এতই উচ্চমানের ছবি হয়েছে এক শতাব্দীতে, যে তা দেখেই তার ইহজীবন কেটে যাবে, সে কেন অপর্যাপ্ত বাংলা সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করবে? সেই অবস্থা এখন মূলধারার ছবিতে হয়েছে। অন্য কথায়, বাংলার কমার্শিয়াল সিনেমার দর্শক এহেন নাক-উঁচুপনা করেন আজকাল। বাংলা মূলধারার দর্শক, যুবকরা এখন আর বাংলা ছবির কাছে কিছু প্রত্যাশা করে না। স্পেকটাকল্-ধর্মী ছবির জন্য তার তামিল-তেলুগু ছবি আছে, ভিন্নধর্মী ছবির জন্য মালয়ালাম ছবি আছে। আর যুবতীরা কী দেখে বা দেখতে চায়? আমি নিশ্চিত কারুর ধারণা নেই।

এই বছরের সফল বাংলা ছবিগুলির তালিকা আবার দেখুন, হয় তা অতীত-আশ্রয়ী (উত্তমকুমার রিসাইকেল্ড, ফেলুদা রিসাইকেল্ড) নয় তা প্রৌঢ়-আশ্রয়ী (‘অযোগ্য’ এবং ‘এটা আমাদের গল্প’)। বাংলা সিনেমার দুই চল্লিশোর্দ্ধ্ব সুপারস্টার দেব আর জিৎ হলেন প্রোডিউসার-স্টার, তাঁদের সাফল্য গোটা ইন্ডাস্ট্রির সাফল্য হতে পারে না, কারণ বছরে তারা কয়েকটা ছবিই করতে পারেন। অতএব তাদের হিসেবের বাইরে রাখলে কালচারাল নস্টালজিয়া এবং অবক্ষয়ে রোদনের নন্দনতাত্ত্বিক আবেশ পাওয়ার জন্যই বাংলা ছবি আছে; আর আছে এক রক্ষণশীল পরিবার-কেন্দ্রিকতার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ধরে রাখার জন্য বাংলা সিনেমা। দুটি ক্ষেত্রেই বাংলা সিনেমা বয়োজ্যেষ্ঠদের সিনেমা, বয়োজ্যেষ্ঠ মানসিকতার সিনেমা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন এসভিএফের একটা ছবিকে কেন্দ্র করে একরকম অচলাবস্থা শুরু হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। এই প্রসঙ্গগুলো অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেইগুলি নিয়ে এই লেখায় কিছু থাকবে না কারণ তা নিয়ে লিখতে গেলে ইন্ডাস্ট্রির ইনসাইডার হতে হয়। আমি আপাতত এই সংকটকে দেখব শুধুমাত্র দর্শক হিসেবে।

কমার্শিয়াল, আর্ট ইত্যাদি বিভাজন আর কার্যকরী নয়

কারণ একধরণের সংকট সর্বব্যাপী, শুধুমাত্র একটি খোপে সীমাবদ্ধ নয়। আমি আশি-নব্বইয়ের দশকে শুনতাম ভিন্নধর্মী পরিচালকরা বলছেন যে কমার্শিয়াল ছবির দৌরাত্ম্যে তাঁদের শিল্পীজীবন অতীষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। আবার হালে কিছু ইউটিউব রিভিউয়ারদের প্রধান অভিযোগ যে বাংলা কমার্শিয়াল ছবি তীব্র সংকটে আছে, মুষ্টিমেয় নাগরিক দর্শকদের জন্য ‘আঁতেল’ ছবি বানিয়ে বানিয়ে যারা আপামর জনতা, সেই দর্শকগোষ্ঠীকে হারিয়েছে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি। তাই এই আলাদা খোপের সংকট নিরীক্ষা করে লাভ হবেনা, সেগুলি অন্ধগলি। সার্বিকভাবেই সমস্যা হল এরকম যে – বাংলা ছবি দিশাহীন, দর্শক ঠিক কোন ছবিকে চায়, কোন ছবির পাশে থাকবে তা নির্ণয় করা মুশকিল। হয়তো বাংলা ছবির দর্শকদের বাংলা ছবি দরকার নেই।

‘কাউন্টারশট পডকাস্ট’-এ লুব্ধক চ্যাটার্জিকে খুব আশাবাদী একজন মানুষ মনে হল। তাঁর কথা আশ্বাস দেয়, শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু যাঁরা আশা হারাচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন মুম্বই বা অন্যত্র এটা বুঝে যে এখানে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তাঁদের নেতিবাচনকেও তো মন দিয়ে শোনা প্রয়োজন, তাঁদের যেটা প্রতিবন্ধকতা মনে করা হচ্ছে তার সুরাহা ভাবা প্রয়োজন। সমস্যাটা এই নয় যে ‘ভিন্নধর্মী’ কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে বাংলায়, সমস্যাটা এখানেও যে মূলধারার ছবিরও কোনও সুস্থির আকার নেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে।

এবং এই ‘সুস্থিরতা’-র ভিত হল এক এবং একমাত্র যদি দর্শকদের ধারণা থাকে যে তাঁরা এই দুই ধরনের ছবির কাছ থেকে ঠিক কী চাইছেন। আমরা যে সময়ে আছি, তখন দর্শকদেরও সেই ধারণা অস্পষ্ট। অথচ তাঁদের ছবি দেখার অভিজ্ঞতা কিন্তু তিরিশ বছর আগের মত সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা ওটিটি-তে সুনির্মিত একটা ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় ক্রাইম-ড্রামা দেখেও পানসে বাংলা ডিটেকটিভ গল্পকে হিট করিয়ে দেন। যুবসম্প্রদায়ের কমার্শিয়াল ছবির কাছে যে চাহিদা তৈরি হয়েছে (যেখানে স্ট্যান্ডার্ড রেফারেন্স হল দক্ষিণের ছবি) সেই স্কিল, কারিগরি উৎকর্ষ এবং পুঁজির স্থাপত্য বাংলা সিনেমা তার নিয়ত ছোট হতে থাকা বাজারে কোনওদিনও মেটাতে পারবে না। বাংলা মূলধারার ছবির আর কোনও নির্দিষ্ট আকৃতি-প্রকৃতি নেই যা হলে মানুষকে টেনে আনতে পারে। কেবল আবার একটা সেকেলে ধরনের (একেলে বিষয়ের হলেও) গোয়েন্দা গল্প, আবার নস্টালজিয়া-পণ্য বা বয়োজ্যেষ্ঠ-কেন্দ্রিক পারিবারিক গল্প ছাড়া আর কিছুতে দর্শকের ন্যূনতম উৎসাহ আছে বলে মনে হয় না। বাংলা ভিন্নধর্মী ছবির একমাত্র মূল্য হল হৃদয়ে আলোড়ন তোলা সহজপাচ্য পেলব সেন্টিমেন্টালিজম, যা অবধারিত একরকম বিগতর ব্যথা নান্দনিক ভাবে উদ্রেক করে। ভেবে দেখুন, আখেরে দুই ধরনের ছবিরই বিষয়-বস্তু এক; অতএব দুই ধরনের ছবিতেই যে সম্ভাবনার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটা হল ‘নতুনত্বের’; দুই ধরনের ছবিই আমাদের যা টিমটিম করে আছে, বা যা হারিয়েছে তা নিয়ে ব্যস্ত। অতএব, সংকট আছে দুই ধরনের ছবিতেই।

মূলধারার (‘কমার্শিয়াল’ শব্দটা নিয়ে অসুবিধে হয়) এবং বিকল্প বাংলা ছবি – দুই ধরনের ছবিতেই যে একধরণের সংকট আছে, সেটা না স্বীকার করলে এগোনো যাবেনা। সংকটের নিরিখে বাংলা সিনেমায় কমার্শিয়াল, আর্ট ইত্যাদি বিভাজন কার্যকরী থাকে না।

তবে, বিভাজনটা বললেই চলে যাবে না; থাকবেই। কারণ কিছু কিছু ছবি যদি পর্যাপ্ত সংখ্যার দর্শকের আশীর্বাদ না পায় তবে তাকে ফেস্টিভাল সার্কিটের ওপর নির্ভর করতে হবে, এমনকি বিদেশি দর্শকদের ওপরও। এটা প্রযোজনার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। কিছু ছবি প্রযোজকদেরই পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না, তখন তাকে হয় কর্পোরেট নয় বিদেশি ফান্ডের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। এই ফান্ডগুলোর সঙ্গেও আসে শর্তাবলি। বেশিরভাগ ইউরোপীয় ফান্ডই রাষ্ট্রীয় ফান্ড, তাদের কলাকুশলীদের জীবিকা তৈরি করার জন্য (কারণ ইউরোপে নিজেদের মূলধারার ছবির বাজার খুব খারাপ)। তাই তাদের টেকনিশিয়ান নিতে হয়। তাদের নান্দনিক শর্তাবলিও থাকে। এবং অবধারিত যে জিনিসটা কমতে থাকবে এহেন, সেটা হল পরিচালকের নিজের ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে জাত নিজস্ব vision – বিশ্ববাজারে একরকম ভারতবর্ষের ধারণা, একধরনের ইমেজ ও সাউন্ডের গঠন, একধরনের ethnographic exotica ছবির ওপর আরোপিত হতে থাকবে, বা থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। এই ছবিগুলিকেই বলা হয় ‘আর্টহাউজ সিনেমা’।

এটা মানলে ভাল, নয়ত ডিনায়ালে থাকতে হবে যে ফেস্টিভালের ইউরোপের ম্যাপে আমরা আর exist করিনা, সেখানে আমরা মুছে গেছি, অতএব সেখানে আমরা সবসময়েই বিগতর স্পেসিমেন, ঈষৎ বিচিত্র, ডেটা ক্যাপিটালিজমের যুগে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজমের মিউজিয়াম। আমি ইউরোপীয় ফেস্টিভাল সার্কিটে বাংলা সিনেমা নিয়ে আর উৎসাহী নই এই কারণেই, কারণ আমরা ওদের কাছে ethnographic curiosity বই আর কিছু নই। যা সমসময়ে, যে আধুনিকতায় আছি সেই আধুনিকতায় এনগেজ করবে – বৃহত্তর বিশ্বসিনেমা বাংলা সিনেমার কাছে এমন ছবি প্রত্যাশা করা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ আমরা সেই বিপন্ন অস্তিত্বের জন্তু যারা নিজেদের সংস্কৃতির স্যাংচুয়ারি নিজেরাই বানাচ্ছি।

আর্ট সিনেমা আর আর্টহাউজ সিনেমা কি একই জিনিস?

বাংলা আর্ট সিনেমা যখন তার শ্রেষ্ঠ মুহূর্তে ছিল তখন আন্তর্জাতিক ভিন্ন সিনেমার ক্ষেত্রে তার কিছু অবদান ছিল। শতবর্ষে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক নিয়ে ভাবা, লেখার সময়ে বুঝতে পারছি এঁরা ঔপনিবেশিক এবং পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিকতার উত্থান এবং মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে ক্রমাগত ভেবে গেছেন, যেভাবে ভাবা ঠিক পাশ্চাত্যের অগ্রগণ্য দেশগুলির পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইতিহাসের মৌলিকতার দিকে এই শিল্পীদের পাখির চোখের দৃষ্টি ছিল। অতএব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের নির্দিষ্ট কিছু বলার ছিল। এবং সেই বলার জন্য তাঁরা নতুন কিছু ফর্মের সন্ধান করে গেছেন। যেমন, সত্যজিৎ ভেবেছেন বাস্তববাদের রকমফের নিয়ে, ঋত্বিক একধরনের আধুনিকতাবাদী মেলোড্রামার ব্যবহার নিয়ে, মৃণাল সেন ব্রেখটীয় ফর্ম নিয়ে, নাটক এবং সিনেমার সংশ্লেষ নিয়ে। সেই সময়ে বিকল্প এবং মূলধারার মধ্যে ফারাকও কম ছিল। বাংলা সিনেমা সেই সময়ে নানাবিধ ‘মডেল’ দিয়ে গেছে অন্যান্য আঞ্চলিক, এমনকি হিন্দি ছবির ইন্ডাস্ট্রিকেও। এখন সে দেশের এবং বিশ্বের পশ্চিমের দিকে মুখ হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে মডেলের আশায়।

গত তিরিশ বছরের বাংলা আর্ট সিনেমা নতুন ফর্ম নিয়ে কী ভেবেছে? ফিল্মমেকাররা আর্টহাউজ সার্কিটের কিছু ফর্ম নিয়ে এনে অ্যাপ্লাই করছেন মাত্র, তাতে স্বকীয় কিছু মোচড় না দিয়ে। যেমন, যখন ‘স্লো সিনেমা’ ফেস্টিভাল সার্কিটে প্রায় তামাদি হওয়ার জোগাড় তখন ‘স্লো সিনেমা’-কে আবিষ্কার করা কি রিপ-ভ্যান-উইঙ্কিলিজম নয়? নতুন ফর্মের সন্ধান করার বদলে যা আর্টবাজারে চলে তার সারসংক্ষেপ পেশ করে লাভ কি? সেভাবেই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজমের যুগে আধুনিকতা নিয়ে ক্ষুরধার ভাবনা রেখে গেছেন পথিকৃৎ-রা; আমরা ক্যাপিটালিজমের একদম ভিন্ন পর্যায়ে থেকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়ে সেরকম কি ভাবতে পারছি? আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতাও তো পাল্টেছে। সেখানে বিগততে যা ছিল তাকে গ্যালারিতে সংরক্ষণ করার বদলে পরিবর্তনকে কীভাবে বুঝছি আমরা? উত্তর কলকাতার রঙিন ছবি তুলে তা কালার-কারেক্ট করলে বিজ্ঞাপন হয়; তাকে সাদা-কালো করে তুললে গ্যালারিতে ফোটো-এক্সিবিশন হয়। অন্তত সেই পরিসরে যাদের দিন আনা দিন খাওয়া যাপন তাদের সঙ্গে সংযোগ হয়না।

কিছুদিন আগে (বোধ করি বাংলাদেশে অধুনার টালমাটাল অবস্থার আগে রেকর্ড করা, কারণ উনি বলছেন বাংলাদেশে একধরনের ‘ফ্যাসিস্ট’ আবহে র‍্যাডিকাল পলিটিকাল ছবি করা কীভাবে অসম্ভব) পেশ করা একটি ইউটিউব সাক্ষাৎকারে অমিতাভ রেজা চৌধুরী বুঝিয়েছেন যে আর্ট ফিল্ম সার্কিট আসলে একধরনের বাজার ছাড়া কিছুই নয়, এবং সেখানকার মতই তাতে বাজারি ছবি হয়, যাতে তাঁর আগ্রহ নেই তেমন। আমি একদম সেই মুহূর্তে লিংক দিয়ে দিলাম, আপনারা শুনতে পারেন। অর্থাৎ, একজন আর্টহাউজ সিনেমায় অংশগ্রহণ করবেন কি করবেন না, সেগুলোও রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তের কিছুক্ষণ আগেই উনি বলছিলেন যে কীভাবে পুঁজির একধরনের রমরমার ফলে বাংলাদেশে একধরনের আন্তর্জাতিক ছবি করার সম্ভাবনা এখনই, নয়তো সেটা ফসকে যাবে (হয়তো গত সপ্তাহের ঘটনা এই নিরিখে একটা বড় সেটব্যাকে ফেলবে বাংলাদেশের ছবিকে)। অমিতাভ নতুন ছবিকেও ইন্ডাস্ট্রি বা ব্যবসার ‘গ্রোথ’-এর নিরিখেই দেখছেন; এবং সেভাবে দেখছেন মানে তার শিল্পমূল্যকে অবহেলা করছেন না।

বোঝা উচিত, ঠিক এইভাবেই, পশ্চিমবঙ্গের ছবি কিন্তু তথাকথিত আন্তর্জাতিক, এবং অধুনা কর্পোরেট, ‘আর্টহাউজ বাজার’ থেকে ফসকে গেছে। সেই বাজারে, সেই পুঁজিতে তার ‘অ্যাক্সেস’ নেই আর। তার কারণ বিবিধ এবং জটিল। এমনও হতে পারে, সেখানে ইন্টারেস্টিং এবং সময়োপযোগী কোনো ফর্ম বা আধুনিক অভিজ্ঞতার দলিল পশ্চিমবঙ্গের ছবির পক্ষে পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, সেটা সন্ধান করতে হলে আগে স্বীকার করতে হবে যে সেই বাজারে উপস্থিতি আমরা হারিয়েছি।

আর্টহাউজ সিনেমা একধরণের আন্তর্জাতিক ব্যবসা-ব্যবস্থা; আর্ট সিনেমা কিন্তু একদম আঞ্চলিক আন্তর্জাতিকতার ফসল ছিল। ব্যাপারটা বোঝাই। আর্ট সিনেমার জন্ম হয় দু’ভাবে – এক, বিশ্বসিনেমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে বোঝা যায় যে সিনেমার কিছু ‘ধরণ’ স্থানীয় ইন্ডাস্ট্রিতে চর্চিত হচ্ছে না, সেগুলি তৈরি করার ইচ্ছে জাগে নবীন ফিল্মমেকারদের মধ্যে, আন্তর্জাতিক সিনেমায় তখন নতুন সিনেমার কিছু ধারা বহমান থাকলে তাতে অংশগ্রহণের ইচ্ছে তৈরি হয়। যেমন বিশ্বযুদ্ধের পর নিওরিয়ালিস্ট বা নবতরঙ্গের ধারা। দুই, স্থানীয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে কিছু শৈল্পিক-রাজনৈতিক চাহিদা তৈরি হয় ভিন্ন ছবির। অর্থাৎ এখানে নান্দনিক ধরনটি হয় একদম নিজস্ব, যেমন যুদ্ধপরবর্তী বিভিন্ন লাতিন আমেরিকান নতুন সিনেমার মুভমেন্ট। এই দু’রকম কারণও মিলে মিশে যেতে পারে।

অধুনার বাংলা সিনেমার সংকটটা এখানেই। বাঙালির আন্তর্জাতিক সিনেমার প্রতি এক্সপোজার দশ-বিশগুণ বেড়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক কিছু আঙ্গিকে তার স্থানীয় অভিজ্ঞতা কীভাবে বুনে দিতে হবে এই নিয়ে আমাদের ধারণা কমেছে। সহজ উদাহরণ, এই জন্যেই আমাদের নিজস্ব কল্পবিজ্ঞান সিনেমা নেই (পুঁজি এবং উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে লাভ নেই; কম বাজেটের কল্পবিজ্ঞান ছবিও হয়), নেই ফ্যান্টাসি সিনেমা। এ তো জঁরের উদাহরণ দিলাম শুধু, এই প্রসঙ্গে পরে আরো বলবো। যারা জানেন সাইফাই বা ফ্যান্টাসি (বা হরর বা সুপারন্যাচারাল) মানেই মূলত বিনোদন-ধর্মী ছবি, তার সঙ্গে আর্টহাউজের কী সম্পর্ক? তাদের আপাতত এটাই বলার – ভুল জানেন।

দ্বিতীয়ত, আর্ট সিনেমা সিভিল সোসাইটির চাহিদা ছাড়া হয়না। হয়ত কোনও ছবিই হয়না। অর্থাৎ, শুধুমাত্র মেকারদের ইচ্ছে যথেষ্ট নয়; দর্শককুলেরও ভিন্ন সিনেমাটিক অভিজ্ঞতার একটা চাহিদা, একটা খিদে প্রয়োজন হয়। কিন্তু শিল্প কি আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার মধ্যে পড়ে আর? শুধুই তো ছুটি পেলে কনজাম্পশনের জন্য সিনেমার কথা মনে আসে আমাদের। সেক্ষেত্রে আরো একটা পানসে ফেলুদাই ভোগ্য হবে আমাদের ভাগ্যে। কনজিউমার সত্তা ঠিক উন্নত শিল্পবোধের সহায়ক নয়, যদি না জাতিগত ভাবেই আমাদের শিল্পবোধ উন্নত হয়। বাঙালিদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আর সেরকম নেই, স্বীকার করে নেওয়া ভাল। আমরা যখন কনজিউমার-কালচারে নিমজ্জিত হলাম নতুন শতক আসার পর, তখন আমাদের চলচ্চিত্রবোধ তলানিতে ঠেকেছিল; তাই সিনেমার ক্ষেত্রে কোয়ালিটি-কনজাম্পশনের ঘটনাটা আমাদের আর ঘটে না।

(চলবে)

পরবর্তী পর্ব

4 thoughts on “বাংলা সিনেমার সংকট নিয়ে: প্রথম পর্ব

  1. ১. “এবং এই ‘সুস্থিরতা’-র ভিত হল এক এবং একমাত্র যদি দর্শকদের ধারণা থাকে যে তাঁরা এই দুই ধরনের ছবির কাছ থেকে ঠিক কী চাইছেন। আমরা যে সময়ে আছি, তখন দর্শকদেরও সেই ধারণা অস্পষ্ট।”

    খুবই অবাস্তব এবং utopic ধারণা। আমার জানা নেই পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কোন দর্শকমন্ডলীর কথা যারা একটানা সিনেমা দেখছেন সিনেমা থেকে কী চাইছেন সেটা জেনে। আপাতত দৃষ্টিতে ওরকম মনে হলেও ব্যাপারটা এভাবে ঘটে না।

    সাধারণভাবে দর্শক, নিজের কিছু preconceived bagage, মতাদর্শ এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা শিল্প মাধ্যমের কাছে যান। তারপরে তিনি দেখেন তার ধারণাটুকু মিলছে কিনা, কিংবা চরিত্রগুলো অন্তত তার পরিচিত সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে কিনা। সেটা নির্দেশক করতে পারলে তখন তাকে ভালো ছবি, আর করতে না পারলে খারাপ ছবির তকমা দেন।

    একজন সাধারণ দর্শক কোনদিনই জানেন না তিনি ছবি থেকে কী চাইছেন। এটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। যেটা দেখানো হয় তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা নিরিখে সেটাকে যাচাই করে‌ নেন।

    ২. “আমি ইউরোপীয় ফেস্টিভাল সার্কিটে বাংলা সিনেমা নিয়ে আর উৎসাহী নই এই কারণেই, কারণ আমরা ওদের কাছে ethnographic curiosity বই আর কিছু নই।”

    একদম ঠিক। তবে আমার মনে হয় না, এটা নতুন কোন বিষয়। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের কোন ছবিগুলো ইউরোপের ফেস্টিভালে সমাদর পেয়েছে? যেগুলো তাদের ethnographic curiousকে চাগাড় দিয়েছে, সেগুলোই। কিংবা বলা ভালো ওদের অনেক ছবিতে তারা এই element গুলো খুঁজে পেয়েছেন তাই তাদের ভালো লেগেছে। আপাতভাবে যতই মনে হোক ওঁদের ছবিতে কোন শৈল্পিক বিষয়বস্তু তারা খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু ব্যাপারটা মনে হয় সেরকম নয়। বরং আপনার তত্ত্বটা ওদের ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেই tradition সমানে চলেছে।

    অর্থাৎ, এটা নতুন কোন সংকট নয়।

    Like

    1. ১। তাই কি? “সাধারণভাবে দর্শক, নিজের কিছু preconceived bagage, মতাদর্শ এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা শিল্প মাধ্যমের কাছে যান” – এটাই তো উত্তর। এবং ইন্ডাস্ট্রিতে স্টেবিলিটি থাকলে এবং ছবির মান উন্নত থাকলে একরকম ফিল্ম-সেন্সের যোগ ঘটে। সমসাময়িক লেখা পড়লে জানা যায় যে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘ইন্টারভিউ’ যখন মুক্তি পেয়েছিল হলের বাইরে যুবকরা পিকেটিং করত, ছবিগুলির পক্ষে এবং বিপক্ষে। এইটাই সেরকম দৃষ্টান্ত। এখন যে কোনো বাঙালিকে জিগ্যেস করুন তিনি মূলধারার কাছে কি চান বা বিকল্প ধারার কাছে, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। এই অবস্থাটা সবসময়ে ছিল না।
      ২। Disagreeing. এই ছবিগুলির প্রেক্ষিতটা ভুলে গেছেন। ‘পথের পাঁচালী’-র সময়ে ফিল্ম ফেস্টিভাল, ফিল্ম সোসাইটি কেন্দ্রিক ‘আর্ট সিনেমা’-র চাহিদা এবং উৎসাহ সারা পৃথিবীতে বাড়ছিল। সেইখানে নতুন বাস্তববাদ একটা চাহিদার মত তৈরি হয়েছিল। যে চাহিদায় ছবিটি কনট্রিবিউট করেছিল। পুরোটাই থার্ড ওয়ার্ল্ড কেমন গরীব তা দেখার জন্য নয়। সেটা ‘স্লামডগ মিলিয়েনার’-এর সময়ে হবে।
      আর মৃণাল সেনের সত্তর দশকের ছবির সময়ে সারা পৃথিবীতেই অ্যান্টিকলোনিয়াল, নতুন রাজনৈতিক ছবির রীতিমত জোয়ার। প্রায় সমস্ত নিউ সিনেমা মুভমেন্ট ব্রেখটিয়ান সিনেমা প্র্যাক্টিস করছে। সেই জন্যই ওনার উপস্থিতি উজ্জ্বল ছিল।
      অর্থাৎ এনারা দুজনেই যখন বিশ্ব-আঙিনায় পৌঁছলেন – তখন emerging (dominant না হলেও) film sense এনাদের ছবির জন্য তৈরি ছিল। এনারা ‘বিচিত্র বিভিন্ন’ ছিলেন না। বরং ওনাদের ছবির মধ্যে identifiable cosmopolitanism ছিল। এখন এই জায়গাটাই সমস্যা। না আছে সেই কসমোপলিটানিজম, বা থাকলেও আমরা তাতে কিভাবে কন্ট্রিবিউট করব আমরা জানি না।

      Like

    2. আপনার বলা দুই নম্বর প্রসঙ্গ নিয়ে বলছিঃ

      “সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের কোন ছবিগুলো ইউরোপের ফেস্টিভালে সমাদর পেয়েছে? যেগুলো তাদের ethnographic curiousকে চাগাড় দিয়েছে, সেগুলোই। কিংবা বলা ভালো ওদের অনেক ছবিতে তারা এই element গুলো খুঁজে পেয়েছেন তাই তাদের ভালো লেগেছে। আপাতভাবে যতই মনে হোক ওঁদের ছবিতে কোন শৈল্পিক বিষয়বস্তু তারা খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু ব্যাপারটা মনে হয় সেরকম নয়। বরং আপনার তত্ত্বটা ওদের ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেই tradition সমানে চলেছে।”

      সম্পূর্ণ দ্বিমত। মতামত পরের কথা – ফ্যাক্ট ধরে চেক করলেই এটা বোঝা যাবে। সত্যজিৎ রায় – পথের পাঁচালী / অপরাজিত যদি ধরেও নিই এথনোগ্রাফিক কারণে সমাদৃত (আদৌ তা নয়, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত যুক্তি দিয়েছেন) তারপরে পরপর ছবি – রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্র (১৯৬১, লোকার্নো), মহানগর (১৯৬৩, বার্লিনে সিলভার বিয়ার ফর বেস্ট ডিরেকশন); চারুলতা (১৯৬৪ সিলভার বিয়ার ফর বেস্ট ডিরেকশন) [চারুলতায় কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই এথনোগ্রাফিক গেজ নেই – বরং বার্গম্যানের চেম্বার ড্রামার সঙ্গে মিল]; নায়ক (১৯৬৬, স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড, বার্লিন), গুগাবাবা (১৯৭০, সিল্ভার মেডেল, মেলবোর্ন); অশনি সংকেত (১৯৭৩, গোল্ডেন বিয়ার, বার্লিন)। এ ছাড়াও জলসাঘর নিয়ে ফরসীদের উচ্ছাস, কাহিয়ে দ্যু সিনেমায় লেখা, সাক্ষাৎকার – ইত্যাদি ছেড়েই দিলাম

      এবার এই কথাটা – “আপাতভাবে যতই মনে হোক ওঁদের ছবিতে কোন শৈল্পিক বিষয়বস্তু তারা খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু ব্যাপারটা মনে হয় সেরকম নয়।” তাই? সত্যজিতের কাজ নিয়ে বিদেশীদের লেখা পড়ে দেখতে পারেন। ঋত্বিক ঘটকের ছবি নিয়ে অ্যাড্রিয়ান মার্টিনের বক্তৃতা / প্রবন্ধ (https://www.springerprofessional.de/en/epilogue-five-minutes-and-fifteen-seconds-with-ritwik-ghatak/7294080), মেঘে ঢাকা তারা-র ডিটেইলড টেক্সচুয়াল অ্যানালিসিস করে রেমন্ড বেল্যুরের প্রবন্ধ (http://www.rouge.com.au/3/film.html) – এর প্রতিটাই শৈল্পিক আলোচনা।

      এখনও কিছু কিছু ছবি ফেস্টিভ্যালে স্বীকৃতি পাচ্ছে, যা এথনোগ্রাফিক গেজের বাইরে। যেমন ধরা যাক গুরবিন্দর সিং-এর ছবি ‘চৌথি কুট’। কানু বেহলের ছবি ‘আগ্রা’। সানাল কুমার শশীধরণের ‘সেক্সি দুর্গা’ ইত্যাদি।

      তাই আপনি যে ক্রাইসিসের কথা সর্বকালের হিসেবে বলছেন, বোধহয় ব্যাপারটা ওরকম নয়।

      Like

      1. যদিও উত্তরটা অনিন্দ্যবাবু এবং তোমাকে দুজনকেই দেওয়া, তাও‌ এখানে লিখছি।

        আমি যেটা বলতে চেয়েছি, সেটা বুঝতে গেলে অবশ্য ফিল্মের বাইরেও‌ কিছু পড়াশোনা প্রয়োজন, বিশেষ করে শিল্পসমালোচনার মনস্তাত্ত্বিক দিকটা নিয়ে। তাও, আবার লিখি।

        একটা সিনেমার কোন ফেস্টিভলে দেখানো হল, সেটা নিয়ে কী কী বললেন বা‌ লিখলেন তখনকার বা এখনকার সমালোচকরা- তার থেকেও যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে সেটাকে কীভাবে মনে রাখা হল বা একটু সময়ের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখা হল। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি না। যারা মাধ্যমটা বোঝেন, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে মনে রাখলেন – তার কথা বলছি। কেন? কারণ সেটা দিয়েই বোঝা যায়, বিষয়টা‌ নিয়ে যাই লেখা হয়ে থাকুক, যখন ‌একটা সিনেমা বা কোন শিল্পমাধ্যম নিয়ে বন্ধুবৃত্ত বা পরিবারের মধ্যে আলোচনা হয় – তখন আলোচনার মধ্যে কোন কোন দিকগুলো উঠে আসে।

        কাজের সূত্রের বহু ফরাসি বন্ধু এবং সায়ন্তন যে প্রদেশের সিনেমাগুলোর নাম করেছে‌ সেখানে থাকার সূত্রে বুঝতে পেরেছি, যারা সিনেমাগুলো নিয়ে সিরিয়াসলি কথা বলছেন, তারাও আসলে সিনেমাতে খুঁজছেন ঐ ethnographic elementগুলোই। জলসাঘরের‌ শৈল্পিক element নিয়ে আলোচনা হয় না তা নয়, কিন্তু সেটা হয় কারণ সেটা আসলে একটা exotic east-র একটা সামন্ততান্ত্রিক জৌলুস হারিয়ে যাওয়ার গল্প। এই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ইম্পর্টেন্ট। অযান্ত্রিক নিয়ে কথা হয়, বা বলা ভালো কথা শুরুর ইচ্ছে হয় ওদের সেই কারণেই, তারপরে কথা প্রসঙ্গে সেটা কতটা শিল্পসম্মত তার আলোচনা উঠে আসে।

        অনিন্দ্যবাবুর প্রথম পয়েন্টের‌ সাথে আমি একমত। সেটাই তো বলতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রেক্ষিতটা যে সময়ের, তখন দ্বন্দ্বটা ছিল হচ্ছে বাইরে, এখন দ্বন্দ্বটা ভেতরের। সমস্যা হচ্ছে যখন দ্বন্দ্বটা ভেতরে, তখন অনেক দর্শককে গুছিয়ে বলতে পারেন না যে দ্বন্দ্বটা কোথায়। অর্থাৎ, কোন কোন preconceived bagageকে বড়পর্দায় দেখতে পেলে তিনি খুশি হবেন। একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার এই দিক গুলো দেখতে চাই, আর আমার বা আমাদের‌ collective consciousness-র ভেতরে এই বিশেষ অস্বস্তিগুলো চলছে, সেগুলো গুছিয়ে বলা এবং সিনেমার পর্দায় দেখতে চাই – এই দুটো বলার মধ্যে পার্থক্য আছে।

        সমস্যাটা এখানে। বলতে না পারার কারণটা এখানে।

        Like

Leave a reply to সায়ন্তন দত্ত Cancel reply