ছিল সিংহ হয়ে গেল বেড়াল: অ্যাগনেস ভার্দার অবস্থান্তর ও উন্মোচনের সিনেমা

একটি নির্দিষ্ট শব্দসংখ্যার লেখার মধ্যে যেকোনও বড় মাপের শিল্পী বা তাঁর কাজের মূল্যায়ন করা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। আর অ্যাগনেস ভার্দার ক্ষেত্রে এই কাজ এক কথায় অসম্ভব। তার বিভিন্ন কারণ আছে। প্রথমত, ফিল্মমেকার হিসাবে ভার্দার কর্মজীবন সাড়ে ছয় দশক জুড়ে বিস্তৃত ফলত তাঁর কাজের পরিমাণও বিপুল। এই কাজের যথাযথ এবং সামগ্রিক মূল্যায়ন যে সময় ও ব্যুৎপত্তির দাবী রাখে, তা একমাত্র একাধিক খণ্ডের পূর্ণদৈর্ঘ্যের বই পূরণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শিল্পী হিসাবে অ্যাগনেস ভার্দা নিজেকে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র মাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর শিল্পীজীবনের সূচনা ঘটে ফটোগ্রাফির হাত ধরে এবং চলচ্চিত্রকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও খ্যাতিলাভের পরেও তিনি ফটোগ্রাফির চর্চা শুধু চালিয়েই যাননি, তাঁর সার্বিক শিল্পকর্ম ও শিল্পীসত্তার মধ্যে এই চর্চার প্রভাব নানাভাবে সুস্পষ্ট থেকেছে। আবার ফটোগ্রাফি ও সিনেমার সাথে দীর্ঘ পথচলার পরে শেষজীবনে প্রায় আচমকাই তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ভিডিও ইন্সটলেশন আর্টিস্ট হিসাবে। সেই চর্চাও তিনি তাঁর জীবনের শেষ দশক জুড়ে টানা নিয়মিতভাবে চালিয়ে গেছেন। অর্থাৎ অ্যাগনেস ভার্দার শৈল্পিক মূল্যায়ন সদর্থে করতে গেলে, বিবিধ শিল্পমাধ্যম, তাদের চর্চার ইতিহাস, এবং এই সবের মধ্যে দিয়ে ভার্দার অনায়াস যাতায়াতকে পাঠ করতে হবে উপযুক্ত ভাবনার ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে। পরিশেষে, এই ফ্রেমওয়ার্কের প্রসঙ্গেই অ্যাগনেস ভার্দা বিষয়ক আলোচনার জটিলতা বেশ কিছু মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে তাঁর বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে সংগঠিত বিবিধ কাজের সামগ্রিকতাকে মাথায় রেখেও, অ্যাগনেস ভার্দাকে পাঠ করা কীভাবে সম্ভব? একজন ইন্টারমিডিয়াল আর্টিস্ট হিসাবে? সিনেম্যাটিক মডার্নিজমের নিরিখে? নারীবাদী অ্যাক্টিভিজমের অনুষঙ্গ ধরে একজন মহিলা শিল্পী হিসাবে? নাকি, ফরাসী নবতরঙ্গের প্রবাদপ্রতিম মুহূর্তের অন্যতম পুরোধারূপে, যা গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে গড়ে ওঠা গোদার-ত্রুফো ও কাহিয়ে পত্রিকা-কেন্দ্রিক যেই ইতিহাস চর্চা, তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে?

প্রবন্ধের গোড়াতেই বিস্তৃতি ও জটিলতা নিয়ে এতটা আলোচনা করার উদ্দেশ্য মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, শুরুতেই পরিষ্কারভাবে বলে নেওয়া যে এই লেখায় উপরে আলোচিত কোনও ফ্রেমওয়ার্ক বা মেথডের প্রচেষ্টা করা হবেনা। অর্থাৎ এই প্রবন্ধে কোনও ধরণের সর্বাত্মক তত্ত্ব খাড়া করার কোনও উদ্দেশ্য নেই। বরং দু’একটি ভাবনা ও ধারণার সূত্র ধরে কিছু আলোচনা করা হবে, যার দ্বারা হয়তো অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমার নান্দনিক ও দার্শনিক জগতে প্রবেশ করার কিছু প্রাথমিক অভিমুখ পাওয়া যেতে পারে। এই লেখা সেই অর্থে পোলেমিকাল; এখানে তত্ত্বের নৈর্ব্যক্তিকতা অন্বেষণ না করাই শ্রেয়। এই কথার সূত্রেই উপরোক্ত দ্বিতীয় কারণটি ব্যক্ত করা যেতে পারে। মূলত সিনেমার আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও, এই প্রবন্ধে কোনোভাবেই ভার্দার সব ছবির উল্লেখ বা আলোচনা করা যাবে না, এবং এখানে আলোচ্য কোনও ভাবনার সূত্রই সম্ভবত তাঁর সব ছবির ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হবে না।

২০১৯ সালের ২৯ মার্চ অ্যাগনেস ভার্দার মৃত্যুর দশ দিন আগে মুক্তি পায় তাঁর শেষ ছবি, ভার্দা বাই অ্যাগনেস। অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে একটি মাস্টার ক্লাসের আকারে এই ছবিজুড়ে আছে অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমা ও ইমেজ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা, তাঁর নিকট সহকর্মীদের সাথে কথোপকথন, এবং তাঁর বিবিধ কাজকে ফিরে দেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর সিনেমা বিষয়ক ভাবনাচিন্তা ও দার্শনিক প্রতিফলন। বলা যেতে পারে তাঁর শৈল্পিক আত্মজীবনীর কাছাকাছি একটি আখ্যান। এই আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে ১৯৬২-তে মুক্তি পাওয়া ক্লিও ফাইভ টু সেভেন-এর প্রসঙ্গ, যা বহু সমালোচক ও দর্শকের কাছে ভার্দার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় ছবি। বহুচর্চিত এই ছবি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছ। কখনও বাস্তববাদের প্রসঙ্গে, বা কখনও সিনেমায় সময়ের চলনের নিরিখে, এবং সর্বোপরি ছবির ন্যারেটিভে, ফর্মে, ও ছবি তৈরির প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান ও এজেন্সির প্রশ্নে চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছবি ক্লিও ফাইভ টু সেভেন। ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথোপকথনে এই ছবির প্রসঙ্গে ভার্দা বলেন যে ছবির মূল সূত্র এক ধরণের অবস্থান্তরের (Transformation)। নির্ভুল জ্যামিতির মতো দুই ভাগে বিভক্ত এই ছবিতে পপস্টার নায়িকা ক্লিওর সার্বিক অবস্থান্তর লক্ষ করা যায়। অ্যালবাম কভার বা পোস্টারজুড়ে ছেয়ে থাকা ক্লিও, অন্যের দেখার ও কামনার লক্ষ্যবস্তু থেকে ক্রমে নিজে তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা অবলোকনে সক্ষম হয়। এই অবস্থান্তরের ধারণা অ্যাগনেস ভার্দার বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন রূপে চেনা মোটিফের মতো ফিরে ফিরে আসে। শুধুমাত্র আখ্যানের চরিত্র নয়, ভার্দার ছবিতে বস্তু, স্পেস, শরীর, সবকিছুরই অবস্থান্তর ঘটে, এবং পালাক্রমে এই অবস্থান্তরের কারণে ছবির পরতে পরতে অর্থনির্মাণের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

চিত্র ১ – ক্লিও ফাইভ টু সেভেন: ছবির মাঝামাঝি নায়িকার নিজেকে ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবকে দেখা

আমরা যদি অ্যাগনেস ভার্দার প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে, চলচ্চিত্র মাধ্যমটির প্রাথমিক ভিত্তি হিসাবে ফটোগ্রাফির কথা বিবেচনা করে দেখি, তাহলে লক্ষ করা যেতে পারে যে একধরণের অবস্থান্তরের ধারণা সেখানে অন্তর্নিহিত। ফটোগ্রাফি বাস্তবের প্রত্যেক মুহূর্তকে রূপান্তরিত করে একটি জমাট-বাঁধা স্থির ইমেজে। স্থানকালের মধ্যে দিয়ে বহমান ইতিহাসের ধারাকে এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থামিয়ে দিয়ে, তাকে রূপান্তরিত করে একটি স্পৃশ্য বস্তুতে (উল্লেখ্য, এখানে অবশ্যই ফটোগ্রাফির ইতিহাস ও অ্যাগনেস ভার্দার জীবনের সিংহভাগজুড়ে থাকা অ্যানালগ প্রক্রিয়ার কথাই আলোচনা হচ্ছে; ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমনে এই অনেক ধারণাই বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবে)। শেষ অবধি সেই ফটোগ্রাফের স্থান দেওয়ালে, খবরের কাগজের পাতায়, পারিবারিক অ্যালবামে, বা কোনও নিকটজনের বুকপকেটে, যেখানেই হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাস্তবের স্থানান্তর ও অবস্থান্তর লক্ষ্য করা যায়। এই অবস্থান্তর আবার পালাক্রমে এক অদ্ভুত অভিন্নতাও তৈরি করে। প্রত্যেক ঘটনা, আচরণ, শরীর, অভিজ্ঞতা ক্যামেরার সম্মুখীন হয়ে শাটারের চাপে আচমকাই স্থির ও বিমূর্ত হয়ে ঠাঁই পায় চতুষ্কোণ ফ্রেমের অভিন্নতায়। সুজ্যান সনট্যাগের মতে, এই আরোপিত অভিন্নতায় যা হারিয়ে যায় তা হল এই সকল মুহূর্তের নির্দিষ্ট অর্থ। তাঁর ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত বই অন ফটোগ্রাফি থেকে এই উদ্ধৃতিটি এখানে উল্লেখযোগ্য,

“Taking photographs has set up a chronic voyeuristic relation to the world which levels the meaning of all events”.

এই প্রসঙ্গে বিবেচনা করে দেখলে, ফিল্মমেকার হিসাবে অ্যাগনেস ভার্দার ভূমিকা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফ্রেমবন্দী ইমেজের এই আপাত অভিন্নতা, তাঁর সচেতন মধ্যবর্তিতার ফলে নতুন নতুন সম্ভাব্য অর্থনির্মাণের স্বকীয়তা লাভ করে। বলা যেতে পারে, সিনেমা যে চলনের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাকে ভার্দা সচেতনভাবে ব্যবহার করেন ইমেজের স্থিতাবস্থাকে স্বাধীনতা প্রদানে। অর্থাৎ তাঁর ছবির ন্যারেটিভ একটি দ্বিতীয় পর্যায়ের অবস্থান্তর সাধনে সক্ষম। একজাতীয় ফ্রি অ্যাসোসিয়েশনের বিস্তীর্ণ যুক্তিতে ভার্দার ছবির প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ইমেজে, প্রতিটি উপাদান সর্বদাই নতুন অনুষঙ্গ খুঁজে নিয়ে অর্থনির্মাণের প্রক্রিয়ায় লিপ্ত। সেই ফ্রী অ্যাসোসিয়েশনের যুক্তি কখনও গ্রাফিক, কখনও শব্দগত বা আক্ষরিক, আবার কখনও ঐতিহাসিক। এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে গর্ভাবস্থার উদ্বেগ নিয়ে তৈরি ডায়েরি অফ আ প্রেগন্যান্ট উওম্যান (১৯৫৮) ছবিতে পর পর দুই দৃশ্য- যেখানে গর্ভবতী নারীর পেটের কিছু ‘নান্দনিক’ ইমেজ থেকে কাট হয়ে পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায় একই রকম আকৃতির একটি কুমড়োকে ধারালো ছুড়ি দিয়ে কাটার ইমেজ। বিংশ শতাব্দীর আভাঁ গার্দ চর্চার অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে লুই বুনুয়েল ও সালভাদোর দালির আঁ শিয়েন আন্দালু (১৯২৯) ছবির সেই কিংবদন্তী প্রথম দৃশ্যের প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমা এবং সুররিয়ালিজম, যেখানে ফটোগ্রাফির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, নিঃসন্দেহে দীর্ঘ গবেষণা ও আলাদাভাবে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। 

চিত্র ২ – ডায়েরি অফ আ প্রেগন্যান্ট উওম্যান: ফিল্মমেকারের চোখে অবস্থান্তরিত বাস্তব

তবে ভার্দার ছবিজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এইরকম ফ্রি অ্যাসোসিয়েশনের অজস্র নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর শেষের দিকে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি দ্য থ্রি বাটনস (২০১৫)। সিন্ডেরেলার কাহিনির ছায়াবলম্বনে তৈরি এই ছবি রূপকথার কাঠামো থেকে বেরিয়ে আবারও এজেন্সির প্রশ্নে ফিরে যায়। ছবির নায়িকার কাছে জাদুবলে এসে পৌঁছানো গাউন দেখে প্রাথমিকভাবে মোহিত হলেও, তার মনের প্রশ্ন তাকে এই গাউনের বহিরাভরণ ভেদ করে সক্ষম করে গাউনের ‘অভ্যন্তরে’ প্রবেশ করতে। ফলস্বরূপ উঠে আসে এক অন্য সত্য; খনির ভিতরের মতো একটি স্পেস এবং সেখানে পড়ে থাকা শ্রমিকদের ব্যবহার করা জামাকাপড়, লণ্ঠন, হেলমেট, ইত্যাদি (এখানে একটি সুন্দর শব্দের খেলাও পাওয়া যায় Miner (খনির শ্রমিক) এবং Minor (অপ্রাপ্তবয়স্ক)-এর মধ্যে)। এই ম্যাজিকের মতোই, অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমায় অবস্থান্তরের ধারণা কখনোই নিছকই আকস্মিক নয়। পারিপার্শ্বিক বাস্তব, দৈনন্দিনতায় ছড়িয়ে থাকা, বা আপাতভাবে অদৃশ্য হয়ে থাকা উপাদানের দিকে ভার্দার সিনেমা প্রাথমিকভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এবং সেই উপাদানের অবস্থান্তর বা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, উপাদানগুলির সুনির্দিষ্ট সামাজিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে, তাদের মধ্যে নিহিত অন্যান্য সম্ভাবনাগুলি উন্মোচন করেন।

চিত্র ৩ – দ্য থ্রি বাটনস: ম্যাজিক, রূপান্তর, ও নতুন অর্থের সম্ভাবনা

যে আপাতভাবে অদৃশ্য উপাদানের কথা উপরে বলা হল, তার মধ্যে প্রায়শই অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমার কেন্দ্রে উঠে আসে শ্রমের ধারণা। তাঁর সিনেমায় ছবি তৈরির নেপথ্যে যে গোটা কর্মকান্ড ও নির্মাণপ্রক্রিয়া, তা মাঝেমাঝেই অনাবৃত হয়। মডার্নিজমের চর্চার ইতিহাসের অতিপরিচিত এই রিফ্লেক্সিভিটির ধারণা নিঃসন্দেহে সিনেমার আদি মুহুর্ত থেকেই মূলত হলিউডের হাত ধরে গড়ে ওঠা এক ধরণের ধ্রুপদী ন্যারেটিভ ছবির বিপরীতে এক প্রতিরোধী অবস্থান। কিন্তু ভার্দার সিনেমায় এই বিশেষ ইঙ্গিতটি আপাত ক্লাসিকাল আর্ট-মডার্ন আর্টের তর্কের বাইরে গিয়ে মূলত শ্রমের প্রশ্নের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিল্পচর্চায় চিরকালই অনুপ্রেরণা, শিল্পগুণ, নান্দনিকতা, ইত্যাদির প্রশ্নের প্রাধান্য ও কৌলিন্য বেশি, শ্রমের প্রশ্ন সেখানে সদাই ব্রাত্য। এই প্রসঙ্গে হানা আরেন্টের বক্তব্য মনে করা যেতে পারে, যেখানে তিনি বলছেন — কনজিউমার সোসাইটির যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, সেখানে প্রত্যেক কর্মরত মানুষই শ্রমিক কারণ তাদের প্রত্যেকের শ্রমের ফলই তাৎক্ষণিক কনজাম্পশন বা ভোগের জন্য নির্ধারিত। একজন পেশাদার ফিল্মমেকার বা শিল্পী হিসাবে ভার্দা স্পষ্টতই এই ধারণার সাথে একাত্মবোধ করেন। সাধারণ ডিটেলের প্রতি ভার্দার যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এবং তিনি যে দৈনন্দিন বাস্তবের উপাদানকেও খুঁটিয়ে দেখছেন, তার নিরিখে বলা যায় যে তিনি আবশ্যিকভাবেই সেই শ্রমের প্রশ্নের অনুসন্ধানে লিপ্ত, যে শ্রম মূলধারার ইতিহাসের ধারাবিবরণীতে অদৃশ্য। তাঁর সিনেমার সাথে কমবেশি পরিচিত সকল দর্শকই তাঁর অধিকাংশ ছবিতে হাতের ক্লোজ শটের সাথেও পরিচিত। হিচককের ক্যামিওর মতোই আলাদা করে নেওয়া হাতের ইমেজ অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমার নান্দনিক এবং রাজনৈতিক পরিচিতি। এই শ্রমের প্রশ্নের অনুসন্ধান প্রায়শই তাঁর সিনেমাকে টেনে নিয়ে যায় প্রান্তিকতায়; প্রান্তিক স্থানে, প্রান্তিক শরীরের কাছে, এবং প্রান্তিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে।

অবস্থান্তর, প্রান্তিকতা, ও শ্রমের ধারণাগুলি সম্ভবত সবচেয়ে পরিপূর্ণরূপে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই-এ। এই ছবিতে মূলত দুটি প্রেরণা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, অবশ্যই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে এই গ্লিনিং-এর প্রথাকে ঘিরে বর্তমানের বাজার অর্থনীতি, উৎপাদন, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, ও অপচয় বিষয়ক একটি বৃহত্তর ডিসকোর্স তৈরি করা। এর বাইরে ছবির আরেকটি তুলনামূলক অনুচ্চারিত অভীষ্ট হল, সেই সময় সদ্য আগত ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে সিনেমা নির্মাণের বিবিধ আঙ্গিকগুলির নতুন করে অন্বেষণ। দুটি আপাতভাবে ভিন্ন উদ্দেশ্য মনে হলেও, ছবিতে তারা একে অপরের পরিপূরক। ডিজিটাল প্রযুক্তির ফলে ইমেজের রেকর্ডিং-এর স্বাচ্ছন্দ্য, তার সংরক্ষণ, বা তার সম্পাদনা, প্রভৃতি সব দিকগুলিতেই আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা ছবি নির্মাণের চর্চা ও সিনেমার ফর্মের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে গ্লিনিং-এর প্রথা অ্যাগনেস ভার্দার এই সিনেমা চর্চাকে ঐতিহাসিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলে।

আধুনিক সিনেমার মাস্টারপিস হিসাবে স্বীকৃত এই ছবির সামগ্রিক মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয়ের নিরিখে এই ছবির শুরুর দৃশ্যাবলী অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। ভার্দার সিনেমার চিরপরিচিত ফ্রি অ্যাসোসিয়েশনের যুক্তিতে গ্লীনার শব্দের আভিধানিক অর্থ থেকে দৃশ্য এসে পৌঁছোয় জঁ ফ্রাঁসোয়া মিলের পেন্টিং-এ। ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী সময়ের এই শিল্পকর্মে চিত্রিত মহিলাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ভার্দা এই প্রথার ঐতিহাসিক প্রান্তিকতাকে আরেকবার মনে করিয়ে দেন। একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের পুরোনো ফিল্ম ক্লিপের হাত ধরে গ্লিনিং-এর স্মৃতি অয়েল পেন্টিং-এর প্রাক্-আধুনিক পরিসর থেকে বিংশ শতাব্দীতে এসে পৌঁছোয়। অবশেষে একটি আইকনিক দৃশ্যে, ভার্দা একজন একক গ্লেনেউস-এর (গ্লিনার-এর স্ত্রীরূপ) পেন্টিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে ক্যামেরা তুলে নেন। গ্লিনার (বা গ্লেনেউস) হিসাবে তাঁর একাত্মবোধ পরিপূর্ণতা লাভ করে। বাকি ছবি জুড়ে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষদের, এবং তাঁদের স্মৃতিচারণ ও অভিজ্ঞতার সাক্ষী হই। গ্লিনিং-এর প্রথাগত অর্থ থেকে বেরিয়ে ছবি খুঁজে বেড়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরণের খারিজ, বাতিল, উচ্ছিষ্ট উপাদান এবং সে-সবের উপর নির্ভরশীল অভাবী মানুষ, শিল্পী মানুষ, রাজনৈতিক মানুষ। তবে এই ছবি কখনোই দর্শকদের থেকে সহানুভূতি বা কৃপাভিক্ষা করে না, আবার প্রবল দায়িত্ববোধে জর্জরিত হয়ে নীতিশিক্ষাও দেয়না। এই ছবির প্রান্তিক মানুষেরা কোন সামাজিক ক্যাটাগরি নন, বরং ছবির নিজস্ব ছন্দ অনেক সময়ই তাঁদের ব্যক্তিগত কথা, তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ, তাঁদের মতামত, বা তাঁদের শখ ও খেয়ালের প্রতিও একইরকম যত্নশীল। এই প্রতিটি স্বতন্ত্র চরিত্র একটি সূত্রেই বাঁধা পড়ে: একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এঁদের মজুরিহীন শ্রম। এবং আপাতদৃষ্টিতে, গোটা ছবির আপাত যে অসম ফর্ম, তার মধ্যেও একমাত্র যোগসূত্র হল ভার্দার ফিল্মমেকার হিসাবে শ্রম, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি তাঁর যাতায়াত, বিভিন্ন দৃশ্যে তাঁর নানারকম কায়িক কার্যকলাপ, ইত্যাদি — যা পুনরায় মনে করিয়ে দেয় যে শিল্পজগৎ ও শৈল্পিকচর্চায় শ্রমের ধারণা প্রান্তিক ও অদৃশ্য। একটি অভিধানের পৃষ্ঠা থেকে একটি শব্দ এই ছবিতে অবস্থান্তরিত হয়ে ক্রমে ইতিহাসের এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের পরতে পরতে শ্রম ও প্রান্তিকতাকে উন্মোচিত করে।

চিত্র ৪ – দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই: শব্দ সংগ্রহ, অবশিষ্ট সংগ্রহ, ইমেজ সংগ্রহ

অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে সচেতনভাবে অ্যাগনেস ভার্দা যেভাবে ছবিজুড়ে নিজের শ্রমকে ‘ইমেজের জন্য গ্লিনিং’ হিসাবে আখ্যা দেন, তাতে ভার্দার সিনেমার যে বিবিধ পরিসরগুলি, যেমন ব্যক্তিগত বা গার্হস্থ্য, নান্দনিক বা শৈল্পিক, অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক, সবই একটি নির্দিষ্ট ধারণার অন্তর্গত হয়ে ওঠে। এই ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কনটেম্পোরারি ফিল্ম ডিরেক্টরস সিরিজের অ্যাগনেস ভার্দা শীর্ষক বইতে কেলি কনওয়ে লিখছেন,

“Figures that might be marginalized in another sort of documentary the homeless, the alcoholic, the poor—are elevated by the film’s insertion of them into a distinguished pictorial universe that includes the paintings of Millet, Jules Breton, Rembrandt van Rijn, and Rogier van der Weyden as well as the photographs of Etienne-Jules Marey.”

এই উদ্ধৃতিতে “elevation” এবং “distinguished pictorial universe”-এর মতো শব্দবন্ধের ব্যবহারে যে প্রকট রক্ষণশীলতা আছে, তাকে সাময়িক উপেক্ষা করে তিনি যে ধারণাটি ব্যক্ত করার চেষ্টা করছেন, সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, যে আপাতভাবে সাযুজ্যহীন ইমেজের সারি একত্রিত হয়ে সঙ্গতি লাভ করছে শুধুমাত্র এক গ্লেনেউসের প্রচেষ্টার ফলে। চলচ্চিত্রকার হিসাবে এই বৃত্তি মনে করিয়ে দেয় ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের সংগ্রাহকের (collector) ধারণাকে। বেনিয়ামিনের মতে একমাত্র সংগ্রাহকের হাতেই সংগ্রহের উপাদান, তার বাজারদর বা ব্যবহারিক মূল্যের পরিসর থেকে মুক্তি পায়। সংগ্রহের উপাদান ও সংগ্রাহকের সম্পর্ক সেখানে একান্তই ব্যক্তিগত; সংগ্রাহকের অভ্যাস ব্যতীত সেখানে আর কোনও অনুক্রমের যুক্তি খাটে না। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে, ভার্দার হাতে সিনেমার সেই দিগন্ত উন্মোচিত হয়, যেখানে ইমেজ এবং ইমেজ সংগ্রাহকের সম্পর্ক সত্যিই ব্যক্তিগত। বেনিয়ামিনের সংগ্রহের মতোই ভার্দার ‘গ্লিন’ করা ইমেজে নির্মিত ছবিতে ছবির যেকোনও উপাদান, যেমন আখ্যান, চরিত্র, সংলাপ, ক্যামেরার কাজ, সম্পাদনা, ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই তাদের সুনির্দিষ্ট অনুষঙ্গের থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। সেই কারণেই হয়তো অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমায় তিনি সেই দৃষ্টিকে গুরুত্ব দেন, যা দিয়ে প্যারিসের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী সিংহের ভাস্কর্য মুহূর্তেইবদলে যেতে পারে এক সুবিশাল মার্জারে। ২০০৩ সালে তৈরি শর্টফিল্ম দ্য ভ্যানিশিং লায়ন-এর শেষ দৃশ্যে ভার্দার পোষ্য গুগুর (Zgougou) আবির্ভাব যেমন ম্যাজিক আবার তেমনই দৈনন্দিন ইমেজের উপাদানের মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাকে সিনেমায় উন্মোচিত করাও বটে। কেউ বলতে পারেন ব্যক্তিগত দ্বারা রাজনৈতিক পরিসরকে প্রতিস্থাপন করা। কিন্তু সে তো কেবল এই ছবি নয়; অ্যাগনেস ভার্দার সব ছবিই রাজনৈতিক কারণ সেগুলি সবই একান্ত ব্যক্তিগত।

চিত্র ৫ – দ্য ভ্যানিশিং লায়ন: ছিল সিংহ হয়ে গেল বেড়াল

উল্লেখপঞ্জি

1. Sontag, Susan, 2011. On Photography. Picador, New York. eBook Edition

2. Arendt, Hannah, 1998. The Human Condition. The University of Chicago Press, Ltd., London. 2nd Edition

3. Benjamin, Walter, 2007. Illuminations: Essays and Reflections. Schocken Books, New York. 1968 Reprint

4. Conway, Kelley, 2015. Agnès Varda. University of Illinois Press, Urbana, Chicago, and Springfield. 1st Edition

(লেখাটি এর আগে বামা পত্রিকায় ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন অনলাইনে শুধুমাত্র এই লিংকেই পড়া যাবে)

One thought on “ছিল সিংহ হয়ে গেল বেড়াল: অ্যাগনেস ভার্দার অবস্থান্তর ও উন্মোচনের সিনেমা

Leave a reply to Asmita Karmakar Cancel reply