স্মৃতির দ্বিখন্ডিত শরীর 

শরীর, শব্দ

I’ll wait up in the dark for you to speak to me
I’ll open up

Pearl Jam

একটি ঘর – জানলা দিয়ে গলে আসছে ভোররাতের আলো – ঘরের ভিতর আলো আঁধারি। ঘুমিয়ে আছে জেসিকা – তার হাতের কনুইটুকু ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে। একটা শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় জেসিকার, অতিকষ্টে ওঠে বিছানা থেকে (ছবি ১)। তখন তাকে ছেড়ে ক্যামেরা প্যান করতে থাকে, ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। ধীর গতির এই প্যানিং চলার সময় আচমকা ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা আলোর চৌখুপি ফুটে ওঠে, ঠিক যেন একটা দরজা…তার মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি ভেসে উঠেছে, প্রায় জম্বির মত বেঁকে চুরে টলোমলো পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে সে (ছবি ২ ও ৩)। কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়েই সে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ক্যামেরা প্যান করে চলে। ক্যামেরার এই নিরুত্তাপ প্যানিং দেখে আমরা যখন উৎকন্ঠায় ফেটে পড়ছি, ঠিক তখনই, ফোরগ্রাউন্ডে ঘন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে জেসিকা, তার দুটো হাত এগিয়ে যায় বাঁদিকের একটা দরজার পাল্লা লক্ষ্য করে (ছবি ৪)। দরজা খোলে, এবং কাট।

ছবি ১

ছবি ২

ছবি ৩

ছবি ৪

আপিচাতপং উইরাসেথাকুলের মেমোরিয়া (২০২১) ছবির প্রথম শট এটা। বোঝাই যাচ্ছে, ক্যামেরা প্যান করার সময় যাকে দরজা মনে হয়েছিল সেটি আসলে একটি আয়না; আর উল্টোদিক থেকে আসা ভয়ানক ছায়ামূর্তিটি আর কেউ নয়, স্বয়ং জেসিকার প্রতিবিম্ব। ব্যাপারটা শুরুতে কোনো ভূমিকা ছাড়াই এমন আচমকা ঘটে, যে জেসিকা/ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টনের ছায়ামূর্তিকে একই শটে দুবার দুই ভিন্ন শরীরে দেখে আমরা ক্ষণিকের জন্য হলেও উদভ্রান্ত হয়ে যাই। হঠাৎ মনে হয় রক্তমাংসের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা প্রেতশরীর উল্টোদিকে হেঁটে গেল, বা আরেকটি শরীর ফ্রেমের মধ্যে দেখা দিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল বুঝি। ছবিতে এরকম দ্বিত্ব বা doubling মাঝে মধ্যেই নজরে পড়ে– আয়না বা কাচে ঘেরা শহুরে পরিসরে দুফালি হয়ে যায় শরীর। চকচকে দেয়ালে, জানলার শার্সিতে, দরজার পাল্লায় বা আয়নায় ফুটে ওঠে শরীর। শুধু আয়না নয়, ছবির মধ্যে অন্য ছবিতেও লেপটে থাকে চেনা শরীরের আদল (ছবি ৫)। 

ছবি ৫

শরীরের এই নিয়ত দ্বিত্ব, একক অখন্ড অস্তিত্ব ভেঙে ফ্রেমের মধ্যেই দুটো প্রতিসম বা সিমেট্রিকাল ভাগে টুকরো হয়ে যাওয়া (কোশবিভাজনের মত), এবং কিছুক্ষেত্রে প্রায় স্লিপ করে একটি সমান্তরাল অস্তিত্বের জগতে চলে যাওয়া, এই বিষয়টি মোটিফ হিসেবে গোটা ছবি জুড়ে বারবার ফিরে ফিরে আসে, ফলে একটি ছন্দময় চলন তৈরি হয়। বিশ্বপ্রকৃতির সাপেক্ষে মানবশরীরের অখন্ডতা ও স্বাতন্ত্র্যের যে তত্ত্ব– যার ওপর পাশ্চাত্যদর্শন ও আধুনিক বিশ্ববীক্ষার একটি বড় ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে – ছবিটা যেমন তাকে নাকচ করে, তেমনি শরীরের এই অস্থিরতা ও ভঙ্গুর প্রকৃতির মধ্যে আরেকটা সম্ভাবনাও লুকিয়ে আছে– তা হল শরীরকে জগতের সমস্ত অনুভূতি, স্মৃতি ও জড়পদার্থের সামনে উজাড় করে দেওয়া– যতক্ষণ না সেটা সাদা কাগজের মত হয়ে উঠছে– যার ওপর ইচ্ছে মত আঁকিবুঁকি কেটে যেতে পারে বাইরের জগৎ।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে এরকম শরীরী বিশেষত্বের একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে ঋত্বিক ঘটকের লেখা প্রেম ছোটগল্পে (ব্রাউনিঙের ‘পরফিরিয়া’স লাভার’ কবিতার ছায়ানুসারে রচিত)। গল্পে শীতের এক ভয়াল সন্ধ্যায় পদ্মার ওপর আছড়ে পড়ছে প্রচন্ড তুফান, নদীর পাড়ে ধ্বস। ঝোড়ো হাওয়ার তোড়ে চারপাশে গাছগাছালির উন্মত্ত আস্ফালন শুরু হয়েছে। এই সব অঘটন আলোড়ন তুলেছে ডাঙায় বসে থাকা পুরুষের মনে, মত্ত প্রকৃতির মাঝে বসে থাকতে থাকতে তার শরীর-মনে সঞ্চারিত হচ্ছে এক দুর্দম আবেগ। মাত্র দেড় পাতার ছোট্ট গল্পটার শেষে ঐ পুরুষ তার প্রেমিকাকে নিজের হাতে খুন করে বসে, আর তার ঠিক পরেই, গল্পের শেষ বাক্যে আসে সমাধিফলকের মত হিমশীতল উচ্চারণ, “ঝড় পড়ে এলো।” 

খুন আর ঝড়ের থিতিয়ে পড়ার এই সমাপতন বুঝিয়ে দেয় যে, গল্পকার ঋত্বিক ঘটকের কল্পনায় মানুষ কিন্তু নিসর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো অখন্ডমন্ডলাকার বস্তু নয়। বরং যা কিছু বহির্জগতের, তার সামনে সে শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সাদা খাতার মত খুলে দিচ্ছে। বাহিরের ভিতর হয়ে ওঠা ও ভিতরের বাহির- এই দুয়ের মধ্যেই গল্পটা পাক খায়। 

মেমোরিয়ার অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টন তাঁর অভিনীত চরিত্র জেসিকার সম্বন্ধে জানান: I don’t think of her (জেসিকা) as a character, I think of her as a predicament…It wasn’t to do with building a character, it was to do with finding an environment in which she could be as dislocated and as connected…meaning that she was completely connected with the nature. বস্তুত এরকম পরিস্থিতিতে, যেখানে বাইরের জগতের সাথে শরীরী অস্তিত্ব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে, সেখানে চরিত্রের অন্তর্বস্তু বা ইন্টিরিয়রিটি বলে আলাদা করে এমন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না – যা দিয়ে শরীরকে একটি সংহত মনস্তাত্ত্বিক চরিত্রের নিরেট গড়ন হিসেবে কল্পনা করা সম্ভব। ফলে, শরীর হয়ে ওঠে একটা ট্রানজিস্টারের মত, কিম্বা সিসমোগ্রাফের মত (বা, এই ছবিতে সতত ব্লিংক করতে থাকা গাড়িগুলোর মত)– অর্থাৎ বাইরে তরঙ্গ উঠলে তার অভিঘাতকে নিজের মধ্যে দিয়ে বাহিত না করলে সে থাকতে পারে না। তার পাশাপাশি শরীর এই ছবিতে স্মৃতির আধারও বটে। সৃষ্টির আদি হতে যুগযুগান্তব্যাপী পালাবদলের অনুরণন জমাট বেঁধে থাকে তার মজ্জায় মজ্জায়, প্রতিটি দেহকোশে। সঠিক বোতাম টেপার মত ঠিক ঠিক জায়গায় স্পর্শ করলে, উদ্দীপনা ছড়ালে- সেই স্মৃতির দুয়ার যায় খুলে। সালতারিখবিহীন অতীতের লীন হয়ে যাওয়া স্মৃতি থেকে ভেসে আসে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন দলাপাকানো শব্দ। সেই শব্দ আলোআঁধারির মাঝে চেতনার দ্বারে কড়া নেড়ে শরীরকে জাগিয়ে দেয় – তা দর্শক শুনতে পায়, আর পায় ছবির মুখ্যচরিত্র জেসিকা, শব্দের আসা যাওয়া যার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। হরর ছবির প্লটের মত ওই অস্বাভাবিক আওয়াজ হানা দেয় আচম্বিতে। জেসিকার রোগে ভোগা শীর্ণ শরীর, আর তার সাথে সাথে এই ফিল্মের শরীর, হয়ে ওঠে শব্দের যুগ্ম আধার, এই দুইয়ের মধ্যেই সেই ভোঁতা বাড়ি দেওয়ার মত জোরালো আওয়াজটা ঘুরপাক খায়, প্রতিধ্বনি তোলে। ছবির অন্যান্য মানুষ সেই প্রতিধ্বনির পরিধির ভিতরে থেকেও নেই, অনাহুত শব্দের উপদ্রব থেকে তারা মুক্ত। জেসিকা ছাড়া ছবিতে ঐ আধিভৌতিক শব্দের উপস্থিতি সরাসরি টের পায় কেবল দুজন; এক, হেরনান নামের একজন সাউন্ড ডিসাইনার, যে ফিল্মের সাউন্ড এফেক্টের আর্কাইভ ঘেঁটে বিভিন্ন স্যাম্পল জোগাড় করে, তাদের শব্দগ্রামের চাপানউতোর করে জেসিকার (এবং আমাদের) শোনা শব্দটার ডিজিটাল প্রতিরূপ তৈরি করেছে– অনেক চেষ্টার ফসল সেই অডিও ফাইলটা হেরনানের সাউন্ড সিস্টেমে অবিকল একই রকম শোনায়। একটু একটু করে শব্দের মাত্রাভেদ করে, তার ঘনত্ব, গাঢ়ত্ব, তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে কমিয়ে হেরনান জেসিকার স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে সেই শব্দ। জেসিকা ও আমরা সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার সাক্ষী। কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে কিবোর্ডের বোতাম টিপতে টিপতে ভোঁতা আঘাতের মত হাড়হিম করা শব্দটার কাছাকাছি চলে যায় হেরনান, ক্রমশ বাড়তে থাকা শব্দের অভিঘাতে আমাদের বুক ধড়াস করে ওঠে– শরীর শিউরে উঠে সাড়া দিয়ে ফেলে তাতে। এমন এক শব্দ, ছবির শেষ পর্বের আগে যার উৎসকে ছবির দৃশ্যপটে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না- ফিল্মের তাত্ত্বিক পরিভাষায় যাকে বলে অ্যাকুসমেতর– অশরীরী এই শব্দ থেকে থেকে হানা দেয় ছবির শরীরে- যেন আরেকটা শরীর কোথাও রয়েছে, পর্দার আড়ালে, যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না, অথচ তার উপস্থিতি আঁচ করা যায় সর্বক্ষণ। লেখার শেষে এই প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসতে হবে।

ছবি ৬

এর পরেই ছবির গল্পে একটা আচমকা মোড়বদল হয় – সাউন্ড ডিসাইনার হেরনান ছবির মাঝখানে হঠাৎ না-বলে-কয়ে উধাও হয়ে যায়–খোঁজ করতে গিয়ে জেসিকা দেখে যে শহর থেকে নামগন্ধ মুছে গেছে তার। হেরনানের সাথে শেষবারের মত বেরিয়ে জেসিকা গিয়েছিল শহরের বাজার এলাকায়; তার ফুলের গাছকে ব্যাক্টিরিয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক বিশেষ ধরণের কোল্ড স্টোরেজ খুঁজছিল সে। শোরুমে তাকে একটি বিশেষ মডেল দেখিয়ে বলা হয়, যে এখানে গাছ রাখলে পোকামাকড়ের হাত থেকে একেবারে নিশ্চিন্ত, কারণ এর বজ্র আঁটুনি দিয়ে হাওয়া গলার জো নেই। তার সাথে দোকানি জুড়ে দেয়, ‘এখানে সময় থমকে যায়’ (ছবি ৭)– সময়ের না-বদলানো, একটি মুহূর্তে থিতু হয়ে যাওয়া, এ যেন ঘড়ির কাঁটার নিয়মে যে সময়কে আমরা মাপতে শিখেছি তার ঠিক উল্টো মেরুতে অবস্থান। গোটা ছবিতেই এমন অনেক শট রয়েছে, যা দেখলে মনে হবে পরিচালক যেন সময়কে থমকে দিয়ে সিনেমাকে স্থিরচিত্রের কাছে নিয়ে যেতে চাইছেন। অবশ্যই ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা ও গাণিতিক নিয়মে গতিশীল যে সময়– ইস্কুলে ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দিয়ে যে সময় মাপতে শেখানো হয়– একাদিক্রমে আসা টুকরোটুকরো মুহূর্তের পরম্পরায় সাজানো সেই সময়ের ধারণার বিরুদ্ধাচরণ করাই এই ছবির মুখ্য বিষয়– ‘স্লো সিনেমা’র রাজনৈতিক দর্শন অংশত সময়ের সাথে এই নতুন সম্পর্কস্থাপনের  সাথে জড়িয়ে। এই প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে অনেকেই আলোচনা করেছেন। আমি বরং কথা বলব সময়ের ধারণা এবং তার সাথে সাথে স্মরণের প্রক্রিয়ার দিকে মন দিতে গিয়ে ছবির শরীরে যেসমস্ত বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেই নিয়ে।

ছবি ৭

ইতিহাসের গাছপাথর

We feel the pull in the land of a thousand guilts
And poured cement, lamented and assured
To the lights and towns below

The Smashing Pumpkins

মেমোরিয়া ছবির প্রথমাংশে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা শহরের কিছু ল্যান্ডমার্ক বারবার ফিরে ফিরে আসে।  অত্যাধুনিক ছিমছাম শহরের আকাশছোঁয়া ঘরবাড়ির মাঝখানে একচিলতে জমিতে অতীতের অক্ষয় গৌরব অথবা অগৌরবের চিহ্নস্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকে স্প্যানিশ কনকিস্তাদোর, উপনিবেশের স্থাপক ও প্রশাসক বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ মহাপুরুষদের দৃপ্ত প্রতিকৃতি (ছবি ৭ ও ৮)।  একদিকে সভ্য সুরম্য নগরীর উত্থানপর্বে শুভানুধ্যায়ী সাদা মানুষদের অনুগ্রহকে গরিমান্বিত করা, অন্যদিকে তাদের তত্ত্বাবধানে ঘটে যাওয়া অন্যায় জবরদখল, উৎপীড়ন ও গণহত্যার যন্ত্রণাময় স্মরণ – দুইই চালু রাখে সে’ সব মূর্তি। তাদের স্থানুর শরীরে থমকে আছে অতীত – খোদাই করা রয়েছে সনতারিখ, উপনিবেশ দখলে ও প্রজাপালনে তাদের ভূমিকা। পাথরের সাথে অতীত ও স্মৃতিকে জুড়ে দেওয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত এটা – ছবির শেষভাগে এই মোটিফটা বারবার ফিরে আসতে থাকবে, তবে একটু অন্য সুরে।

ছবি ৮

ছবি ৯

কিছুকাল পরে জেসিকা কলম্বিয়ার উপজাতি অধ্যুষিত জংলা পার্বত্য এলাকায় পাড়ি দেয়, যেখানে স্থানীয় মানুষ নাকি বহুযুগ ধরে পশ্চিমী আধুনিকতা, শিল্পসভ্যতা আর শহুরে পরিকাঠামোকে ঠেকিয়ে রেখেছে তাদের অলৌকিক শক্তির জোরে। সেখানে গিয়ে জেসিকা আরেকজন মানুষের সন্ধান পায়, যে নিজেকে হেরনান বলে পরিচয় দিলেও, তার আদবকায়দা, চেহারা চরিত্রের সাথে পুরোনো হেরনানের কোনো মিল নেই। এই লোকটি তার আশ্চর্য ক্ষমতাবলে মাটিতে পড়ে থাকা নামগোত্রহীন নুড়ি পাথরকে ছুঁয়ে তাদের বিস্মৃত অতীত, তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষের গল্প, আর হিংসার পুরাকাহিনিকে স্মরণ করতে পারে- পাথর তার সাথে কথা বলে, তার মুখ দিয়ে গল্প বলে। এই পাথরের সাথে বোগোটার প্রস্তরমূ্র্তিগুলোর ফারাক রয়েছে: দুইই একধরণের স্মরণের ক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে, কিন্তু কনকিস্তাদরদের মূর্তিতে খোদাই করা সালতারিখ, তাদের গুণপনা, এ’সবই লিখিত ইতিহাস আর মহাফেজখানার ইতিহাসের প্রামাণ্যতার ওপর নির্ভরশীল। তারা সাম্রাজ্যের জয়পরাজয়ের গল্প বলে, স্থানীয় উপজাতিদের স্বদেশ হারানোর গল্প বলে, কিন্তু এক আরোপিত রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রকরণে- যে ভাষার শেকড় এদেশে নেই, তা আটলান্টিকের ওপার থেকে আমদানি করা হয়েছে। অন্য দিকে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা নুড়িকাঁকরের স্মৃতি কিন্তু সবার বোঝার জো নেই, তা কেবল হেরনানের আঙুলের স্পর্শেই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তাতে নিহিত অতীত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘মূক জনগণের ইতিহাস’, ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও যাবতীয় গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে তার ‘প্রতিস্মরণ’ যেন মুখর হয়ে ওঠে হেরনানের নিজস্ব বয়ানে; মহাফেজখানার নথিতে বর্ণিত সালতারিখ দিয়ে তার সত্যাসত্য বিচার করা যায় না, কেজো ইতিহাসের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত যে লোকায়ত জীবনৈশ্বর্য, তার মায়াস্পর্শ মেখে ইতস্তত অকিঞ্চিতের মত পড়ে থাকে তারা।

এই আশ্চর্য ক্ষমতাবলেই হেরনান জেসিকার হাতে হাত রেখে তার চেতনায় নিত্য হানা দেওয়া শব্দটা শুনতে পায়, প্রথম হেরনান যেমন পেয়েছিল তার কম্পিউটারে, সফটওয়্যারের সাহায্যে। জেসিকার সাথে হেরনানের স্মৃতির আদানপ্রদান হয়, তাদের বিচ্ছিন্ন শরীরের মাঝে ছড়িয়ে থাকা শূণ্যস্থান জুড়ে যেন সত্তা আর স্মৃতির শিরাউপশিরা ছড়িয়ে অদৃশ্য জট পেকে যায়, দুজন দুজনের অতীতকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। অনন্ত সময়ের পারাবারে বসে বসে শরীরী ব্যবধান ঘুঁচিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হেরনান ও জেসিকা পেরিয়ে যায় অন্তর/বাহির, অতীত/বর্তমান, জীবন/মৃত্যু, সৃষ্টি/লয়, এমনকি পার্থিব/অপার্থিবের ভেদাভেদ।

এভাবে ছবিতে শরীর, শব্দ আর পাথরের মোটিফের বিন্যাসকে সাজিয়ে পড়লে মনে হয় গোটা ছবিটাই দ্বিখন্ডিত – জেসিকার শহর আর অরণ্যে শব্দের উৎস সন্ধানে পরিক্রমা তার দুটি ভিন্ন পর্যায়। আবার ভিন্ন নয়ও – একে অপরের পরিপূরক তারা, একটি অপরটির প্রতিসৃত (refracted) চেহারা। আখ্যানের এই দ্বিখণ্ডিত গড়ন আপিচাতপঙের ছবিতে নতুন নয়- তার সবচেয়ে জোরালো ব্যবহার রয়েছে ট্রপিকাল ম্যালাডি-তে (২০০৪), সেখানে ছবির মাঝবরাবর একটি গল্প শেষ হয়ে আরেকটি শুরু হয়। তবে মেমোরিয়া র ক্ষেত্রে সেই খন্ডিত আখ্যান অন্যভাবে ইঙ্গিতবহ হয়ে উঠছে। 

সিনেমার স্মৃতি

Come doused in mud, soaked in bleach
As I want you to be
As a trend, as a friend
As an old

Memoria

Nirvana

মেমোরিয়া-য় আধুনিক বোগোটা শহরের কংক্রিটের জমিনে যে অনতিক্রম্য ভাষার আড়াল ছিল অতীতের সাথে, অরণ্যে এসে তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়- পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে যায় তারা। এখানে স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ নেই, বরং তাকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতিতে– জড়পদার্থ, উদ্ভিজ্জ ও মানুষের শরীরে। আপিচাতপং অবশ্যই একটি মানবোত্তর পৃথিবীর কল্পনা করছেন যা প্রগতিশীল মানুষের ক্রমোন্নতির ইতিহাসের খোঁটায় বাঁধা নয়, মানুষের বাইরেও জীব ও জড়পদার্থের যে সম্ভাবনাময় জগৎ, যা মনুষ্যপ্রজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিকথার বহু আগে থেকে বিদ্যমান, সভ্যতার সেই বিস্মৃত অপরকে তিনি ছবি আর শব্দে পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন – অন্তত এমনটাই মনে হবে। টিল্ডা সুইন্টনের কথা শিরোধার্য করলে মানতেই হয় যে মাতৃভূমি থেকে বহুদূর ভিনদেশি এক শহরে ঘুরে বেড়ানো, বিচ্ছিন্নতাবোধ আর অবসাদে ভোগা শ্বেতাঙ্গিনী জেসিকা তার আত্মার আত্মীয়দের খুঁজে পাবে শহর থেকে দূরে, কলম্বিয়ার অকৃত্রিম আরণ্য প্রদেশে, যা সাদা মানুষের সভ্যতার স্পর্শে এখনও মলিন হয়ে যায়নি, যেখানে পুরুষ ও প্রকৃতি এখনও পরস্পরে লীন। পৃথিবীতে আসন্ন প্রলয়ের আগে জগৎজোড়া না-মানুষের সংসারের সাথে যে সুরের বাঁধনে জড়িয়ে আছে হেরনান ও তার গ্রামের অন্যান্যরা, যাদের আধিদৈবিক অভিজ্ঞতাকে এক স্থানীয় ডাক্তার ‘হ্যালুসিনেশান’ বলে উড়িয়ে দেন, জেসিকা যেন তারই অংশ হয়ে ওঠে।

এ পর্যন্ত যা যা বলা হল, তার কিছুটা আপিচাতপঙের ছবিতে কম বেশি প্রত্যাশিত। কিন্তু একটা খটকা কি কোথাও থেকে যাচ্ছে না? পশ্চিম থেকে আসা জেসিকার এই একাত্মবোধ কোথাও কি পশ্চিমের দর্শকদের ইচ্ছেপূরণের সামিল হয়ে যাচ্ছে না, যা এখনও ঘটে চলা নিওকলোনিয়াল শোষণ, খনিজ সম্পদের খোঁজে নির্বিচারে আমাজনের জঙ্গল কাটা, স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্বাস্তু করে দেওয়া – এই সবকিছুকে পিছনে ঠেলে একটা কল্পিত একাত্মতার প্রলেপ দিয়ে ভুলিয়ে রাখে শ্বেতাঙ্গ দর্শকদের বিবেকদংশন? 

আপিচাতপং ধুরন্ধর শিল্পী। তিনি জানেন তাঁর ফিল্মের উদ্দীষ্ট দর্শক কারা, এবং সেই ফেস্টিভালের ‘সিরিয়াস আর্ট’-এর দর্শক তাঁর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে। ফেস্টিভাল সার্কিটের এলিট দর্শকের পক্ষে আর্থিকভাবে অধোন্নত দেশ থেকে উঠে আসা ছবিকে সমর্থন করার নিগূঢ় রাজনৈতিক তাৎপর্য কী হতে পারে, সেও তাঁর ভালো করেই জানা। আপিচাতপং ও তাঁর সতীর্থদের তৈরি ছবিতে তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ঘটে চলা মিলিটারি শাসন ও হিংসার দিকে যে চোরাগোপ্তা দৃষ্টিপাত অহোরহ করা হয়, তাতে নিঃসন্দেহে আধুনিক গণতন্ত্রের পক্ষে একটা সম্মতি গড়ে ওঠে, লিবারাল দর্শক আর সমালোচকেরাও সহজেই ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাখঅ বিরোধিতাকে সায় দিতে পারে। না চাইতেই ছবিগুলি শ্বেতাঙ্গ দর্শককে তৃতীয় বিশ্বের সামরিক শাসনের সমালোচনা করার সুযোগ দিয়ে নৈতিকতার উচ্চাসনে বসায়, তার সাথে জোগায় একধরণের চোরা আত্মতৃপ্তি। এই আত্মতৃপ্তি না জোগালে ফেস্টিভাল সার্কিটে তাদের যে অভাবনীয় সাফল্য আজ প্রায় কিংবদন্তী হয়ে উঠেছে, তা আদপেই সম্ভব হত কিনা বলা মুশকিল। ফরাসি ফিল্ম তাত্ত্বিক জাক রঁসিয়ের-এর ভাষা ধার করে বলতে হয়, যে ফেস্টিভাল সার্কিটে স্লো সিনেমার একটি ‘fable’ গড়ে উঠেছে- অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের পরিচালক স্লো সিনেমা বানালে তার রাজনৈতিক অভিনিবেশ কী হবে, সে নিয়ে একধরণের প্রত্যাশা এবং ধাঁচা মোটামুটি দানা বেঁধেছে। এমতাবস্থায় একজন রাজনীতিসচেতন অভিজ্ঞ শিল্পী, যিনি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে সব ধরণের কনসিউমারিস্ট প্রত্যাশার বিরোধিতা করতে চান, তাঁর কী করণীয়?

আপিচাতপং একটি দিশা দেখিয়েছেন। ছবির একদম শেষে তিনি পর্দায় এনে ফেলেছেন একটা আস্ত স্পেসশিপ, জানিয়েছেন যে তার লঞ্চ করার ধপ্ ধপ্ শব্দই জেসিকা বারবার শুনতে পেত (ছবি ৯)। এই শটটি আশ্চর্যরকমের কিম্ভুত, ইংরেজিতে যাকে বলে বেশ bizarre। বাকি ছবি জুড়ে প্রায় প্রতিটা শটে পরিচালক ও তাঁর সহযোগীরা সযত্নে যে রহস্যের খাসমহল গড়ে তুলেছিলেন, তার সাথে এর প্রায় কোনো সাযুজ্য নেই। আপিচাতপং কোনো প্রকার আধিদৈবিক দার্শনিকতা বা আধ্যাত্মিকতার ধার না ধেরে একেবারে বাজারচলতি সায়েন্স ফিকশানের ট্রোপ টেনে এনে ফেলেন, ফলে একটু আগে সিরিয়াস আর্ট আর স্লো সিনেমার যে রাজনীতির অঙ্কের কথা বলা হল- তা পুরোপুরি বানচাল হয়ে যায়। যে ধরণের অস্পষ্ট, অমীমাংসিত উপসংহার পেলে তথাকথিত সিরিয়াস আর্ট সিনেমার দর্শক সন্তুষ্ট হন, তার পরিবর্তে আপিচাতপং খুব জোর দিয়েই রহস্যের আপাত-সমাধান করে দেন একেবারে গোদা গোদা অক্ষরে, কোনো ধোঁয়াশা না রেখে। দেখা যায়– যে শব্দটি এতক্ষণ জেসিকার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল, তা আদতে একটি এলিয়েন স্পেসশিপের লঞ্চ করার শব্দ। একটি লং শটে দেখা যায় স্পেসশিপটিকে উড়ান নিতে, বারবার ধপ্ ধপ্ শব্দ করে শেষমেশ পৃথিবীর মাটি ছেড়ে সেটি শূণ্যে ওঠে, তারপর বাতাসে সজোরে ধাক্কা মেরে তীরবেগে উড়ে যায় মহাকাশের দিকে। তার পিছনে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে রয়ে যাওয়া একটি উপবৃত্তাকার বাষ্পীয় কুন্ডলী ক্রমশ ফিকে হতে থাকে, কিছুক্ষণ পরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

ছবি ১০

দর্শকের প্রত্যাশা অনুযায়ী জেসিকার অনুসন্ধানের একটি যাত্রাপথ রচনা করা হয়েছে ছবির আদ্যন্ত, কিন্তু তার সাথে সাথে তাকে নিয়ে রগড়ও কম করা হয়নি, যদিও সেই রসিকতা খুবই নিম্নগ্রামের, ঠারে ঠারে, তাকে সোচ্চারে জাহির করার বিশেষ কোনো চেষ্টা নেই। যেমন ধরা যাক আর্ট একজিবিশানে কিউরেটরদের নজর এড়িয়ে জেসিকা যখন ফোনের ক্যামেরায় পেন্টিঙের ছবি তোলে, তখন হঠাৎই তার মাথার ওপর একটা আলো দপ দপ করে উঠে নিভে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়- যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তার ওপর নজর রাখছিল। দৃশ্যটি যেমন অস্বস্তিকরভাবে সার্ভেলেন্সের কথা মনে করায়, তেমনি মৃদু হাস্যরসও লেগে থাকে তাতে। একই জিনিস মনে হয় একটা নিরীহ কুকুরকে পিছু পিছু আসতে দেখে জেসিকার ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে, বা চোখ খুলে ঘুমোতে যাওয়া (নাকি মৃত) হেরনানের ওপর দীর্ঘ স্ট্যাটিক শটে। গোটা ছবিতেই সাবলিমিটি, হরর, সিরিয়াসনেস, এই সবের ওপর একটা পাতলা রসিকতার পরত রয়েছে, যা প্রত্যাশিত ভারিক্কি মেজাজের সাথে যায় না, বরং মাঝে মাঝেই তাতে হাসির হুল ফুটিয়ে দেয়, বা অস্বস্তিতে ফেলে, আর এই চাপানউতোর তুঙ্গপর্যায়ে পৌঁছয় ছবির শেষে এলিয়েন স্পেসশিপের শটে।

ছবির শেষে যে এলিয়েন স্পেসশিপটিকে উড়ান নিতে দেখা যায়, তা আশ্চর্যভাবে মনে করায় ষাট-সত্তরের দশকে জনপ্রিয় হওয়া এরিক ফন দানিকেনের গাঁজাখুরি থিওরি। দানিকেন দক্ষিণ আমেরিকা এবং অন্যান্য মহাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি আর মিথের এক বিটকেল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল এই, যে মানুষের আসল সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে ভিনগ্রহ থেকে আসা উন্নততর প্রাণী, মানুষ জাতিধর্মকৌমনির্বিশেষে নিজেদের মত করে সেই ভিনগ্রহীদেরকে দেবদবী হিসেবে পুজো করে আসছে, আর তাদের তর্পণ করার জন্য আদিম যুগে নির্মাণ করা হয়েছিল প্রকান্ড সব স্থাপত্য, যেমন মিশরের পিরামিড, ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ, ইস্টার আইল্যান্ডের পাথুরে মূর্তি ইত্যাদি। এমনকি বাইবেল ও রামায়ণের মত বিভিন্ন আদিগ্রন্থ ও মহাকাব্যেও নাকি এসব নভোচারী দেবতাদের বর্ণনা করা হয়েছে (পুষ্পক রথ হল গ্রহচারীদের স্পেসশিপ)। এই উদ্ভট তত্ত্ব যে আগাগোড়া গোঁজামিলে ভরা সেটা প্রমাণ করতে বিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মোটেই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু গ্রহান্তরের এমন প্রাণীও রয়েছে যারা প্রযুক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে অতি উন্নত এবং মানুষ জন্মসূত্রে সেই ভিনগ্রহীদের লতায় পাতায় সম্বন্ধী – মহাকাশ অভিযানের প্রথম যুগে এ কথাটা সাগ্রহে মেনে নিয়েছিল অনেকেই, দানিকেনের লেখা বইগুলোর কাটতিও হয়েছিল ভালো। বোধহয় ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে পশ্চিমি দুনিয়া আর ইস্টার্ন ব্লকের টানাপোড়েনে অতিষ্ঠ মানুষের কাছে এই বিকল্প সলিডারিটির কল্পনা অনেক মনোরম ছিল। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতে হতে, তার সাথে পপুলার সাহিত্য ও সিনেমার মাধ্যমে সেই তত্ত্ব ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রথম বিশ্বের বাইরে। সত্যজিৎ রায় প্রোফেসর শঙ্কু সিরিজের একটি গল্পে দানিকেনের তত্ত্বকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছিলেন। সম্প্রতি রিডলি স্কটের প্রমিথিউস (২০১২-১৭) আর লুকাস/ স্পিলবার্গের ইন্ডিয়ানা জোনস সিরিসেও (২০০৮-এর ছবি দা কিংডম অফ দা ক্রিস্টাল স্কালে) তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। পাঠকের আরো মনে পড়বে, যে ওই একই সময়ে জনসংস্কৃতিতে প্যারাসাইকোলজি, সাইকোকাইনেসিস, টেলিপ্যাথি, পাইরোকাইনেসিস প্রভৃতি নিয়ে আগ্রহ মাথা চাড়া দিয়েছিল। স্টিফেন কিঙের ফায়ারস্টার্টার (১৯৮০) জাতীয় উপন্যাস, সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা (১৯৭৪), ব্রায়ান ডে পালমার ক্যারি (১৯৭৬), দা ফিউরি (১৯৭৮), এমনকি তারকভস্কির স্টকার (১৯৭৯)-এর মত উচ্চমার্গের ছবিতেও এই কল্পনার ছাপ রয়েছে। 

আপিচাতপঙের ছবির শেষ ভাগে দক্ষিণ আমেরিকার পটভূমিতে একটি উড়ুক্কু স্পেসশিপ দেখানো মাত্র এই সব আজগুবি কল্পনাগুলো ফিরে আসে। তাদেরকে ফিরিয়ে এনে আপিচাতপং শুধু যে সিনেফিল-সুলভ ট্রিবিউট দিচ্ছেন তাই নয় (যেমন তিনি আঙ্কল বুনমি… (২০১০)-তে করেছেন, টেলিভিশান শো আর কমিক্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে), তার সাথে সাথে স্লো সিনেমার সিরিয়াস দর্শকদের টগবগে প্রত্যাশায় খানিকটা ঠান্ডাজলও ঢেলে দিচ্ছেন। এককালে যা কলোনি ছিল, পশ্চিম থেকে আসা খ্রিস্টান মিশনারি, অর্থলোভী কনকিস্তাদরদের হাতে যেখানকার ভূমিজদের নিপীড়নের সূত্রপাত- যা এখনও নানা চেহারায় বিদ্যমান- সে’ দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সাদা মানুষ তথা জেসিকার আত্মানুসন্ধান– তার নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আকুল প্রচেষ্টার কোনো সন্তোষজনক ভাবগম্ভীর নিষ্পত্তি তো এখানে করা হয়ই নি, উপরন্তু সেই প্রচেষ্টাকে অবলীলায় নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে গ্রহণ করাকেই যেন একধাক্কায় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ঐ বিলম্বিত পাঞ্চলাইনে। 


এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েই আবার ফিরে আসতে হয় শব্দে। মিশেল শিয়ঁ – যাকে অশরীরী অদৃশ্য শব্দ (বা অ্যাকুসমেতর)-এর অগ্রগণ্য তাত্ত্বিক বলা হয় – তাঁর মতে, এই ধরণের শব্দ যে শরীর থেকে উৎসারিত হয়, তা ছবির সিংহভাগ জুড়ে থাকে পর্দার আড়ালে – ফলে দর্শকের কল্পনাশক্তি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণত ছবির শেষেই বোঝা যায়, ঠিক কোথা থেকে শব্দটি আসছিল, অথবা কোন অদৃশ্য ব্যক্তির কন্ঠস্বর এতক্ষণ কানে আসছিল। যখনই শব্দের উৎসটি সমক্ষে আসে, তৎক্ষণাৎ যেটা হয়, তাকে শিয়ঁ বলছেন- loss of imagined power. দর্শকের মানসচক্ষুতে এতক্ষণ ঐ অশরীরী শব্দ যে ব্যাপক ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে এসেছিল, তা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। যে অজ্ঞতার আঁধারে বসে আমরা অদৃশ্য শব্দকে ভয় ও সম্ভ্রম করছিলাম, পর্দায় শব্দের দৃষ্টিগ্রাহ্য অবয়ব ফুটে ওঠা মাত্র সেটা ঘুঁচে যায় – তার পরিবর্তে আসে নিশ্চিন্তি, সব জেনে যাওয়ার জন্য দারুণ আত্মপ্রত্যয়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, মেমোরিয়াতে শব্দের কবর খুঁড়তে গিয়ে উঠে আসে শুধুই অন্য শরীরের ছবি, যা কোনো অর্থ, তাৎপর্য, বা দ্যোতনা দিয়ে জ্ঞানের ফাঁকফোঁকড়গুলোকে বুজিয়ে দেয় না। বরং খুলে দেয় অন্য স্মৃতির ভাঁড়ার। জেসিকা আর হেরনান যেমন পরস্পরের শরীর ছুঁয়ে তাদের স্মৃতি ও অসুখ – দুইই চারিয়ে দেয় অন্যের মধ্যে…আপিচাতপঙের ছবির মধ্যে ঐ মহাকাশযানও তেমনই আমাদের নিয়ে যায় এক লুকোনো স্মৃতির ভুবনে, যা শুধুই সিনেমার। সেখানে জেসিকার অসুখের কোনো নিরাময় নেই, নেই তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা। এই সব প্রশ্নকে তুড়ি মেরে, ছবির শেষে পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়ে এক আদর্শায়িত সিনেমার ভুবন, সে আবিষ্ট করে ফেলে দর্শকের শরীর ও মন…সেই ভুবনে পড়ে থাকে কেবল শিল্পী আর দর্শক, এবং সেখানেই অন্তরঙ্গ আদান প্রদান চলে সিনেমার স্মৃতি ও স্মৃতির সিনেমার মধ্যে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s