কিঞ্চিৎ সুখী পাখিদের সংবেগ এবং আকাশে থমকিয়ে থাকা মেঘ …
আমি বুঝে গেছি যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ‘সংস্কৃতি’ উন্নত চলচ্চিত্রবোধ দিয়ে তৈরি হবে না। একদা ‘উন্নত চলচ্চিত্রবোধ’-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল রাজনৈতিক বোধ। আসলে উন্নত চলচ্চিত্রবোধ ছিল উন্নত মানবজীবন, উন্নত মানবসমাজ, উন্নত চেতনার দ্যোতক। আর যাই হোক, সেই উন্নতি আর ‘উন্নয়ন’ এক ছিল না, এবং উচ্চমানের মানবজীবনের সঙ্গে কালচার-ইন্ডাস্ট্রির যোগ ছিল না। সেই চাহিদা এখন তামাদি হয়ে গেছে। সেইজন্যই পঁচিশ বছর আগে চলচ্চিত্রবোধ নিয়ে তৈরি অনেক ‘সাধ’ এখন, অন্তত আমার কাছে, খানিক অবদমিত নিউরোসিসেরই দ্যোতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সাধ অবদমিত হতে বাধ্য, তা তো নিউরোসিসের জন্ম দেবেই।
জীবনে যে নিউরোসিসের ব্যক্ত হওয়ার সাধ্যি নেই, গল্পে তাকে ব্যক্ত হতে দেখলে আশ্বস্ত লাগে। ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ যদি দেখতাম – মানিকবাবু তার একাকিত্বের গলা টিপে দেওয়া পারিপার্শ্বিক নিয়ে, সমাজ নিয়ে ক্ষিপ্ত হিস্টেরিক হয়ে যাচ্ছেন, তার জরদ্গব পিতার বেতালসম ওজন বাঙালির অবসোলিট ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রূপকধর্মিতা পাচ্ছে, তারপর পিতার মৃত্যুর পর মেঘের সন্ধান পেয়ে সবকিছু উলটে গিয়ে একটি দিশাহীন নিউরোটিক সমাজে তিনি নির্ভার সাবলাইম শান্ত প্রেমিক হয়ে যাচ্ছেন – স্বস্তি পেতাম যে তিনি আমার কষ্টটা বোঝেন। গল্পে একটা চরিত্রের আর্ক লাগে। লার্স ভন ত্রায়ারের ‘মেলানকোলিয়া’ মনে পড়ে – ছবির শুরুতে নায়িকা হিস্টেরিক, প্রায় মানসিক ভঙ্গুরতার খাদের কাছে দাঁড়ানো একজন মানুষ; ডগমে শৈলী স্মরণ করে ছবির ফর্মও অস্থির। এইবার শোনা যায় পৃথিবী ধ্বংসের সম্মুখীন; সেই বিপন্নতায় সমাজ যত উন্মাদ হিস্টেরিক হয়ে যায়, নায়িকা হয়ে যায় শান্ত। ছবির আঙ্গিকও হয়ে যায় শুধু স্থিতধী নয়, ধ্বংসের সম্মুখে অদ্ভুত সুন্দর! কেন নায়িকা শান্ত হয়ে যায়? কারণ অস্তিত্ত্বের বিপন্নতায় সে দৈনন্দিন অভ্যস্থ ছিল …।
‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ চরিত্র বা আঙ্গিকের সেরকম কোনও আর্ক নেই; নেই সমসাময়িক ইতিহাসের তেমন কোনও ভার। সিনেমাটোগ্রাফি শুরুতেও নান্দনিক সুন্দর, শেষেও তাই। চন্দন সেনের অভিনয়ে যে ‘সত্য’ আছে, ছবিতে তার সন্ধান নেই। ছবিটি মানিকবাবুর নিউরোসিসকে বাইরে থেকে দ্যাখে; আঙ্গিকগত ভাবে একাত্ম হলে সমসময় নিয়ে ক্ষ্যাপামি করতে পারত। কিন্তু ক্ষ্যাপামি ছবিটির অভিব্যক্তি নয়, ছবিটির ‘অবজেক্ট’।
আমার ছবিটিকে নিয়ে একটি আপত্তি আছে। আপত্তিটি ব্যক্তিগত; আমি জানি বেশিরভাগ পাঠকের কাছেই তা গ্রাহ্য হবে না। ছবিটি একধরণের ছবি হতে চায়না, সেখানেই আপত্তি। মৃদু আপত্তি, অভিযোগ নয়। আশা করি সেই আপত্তিটা বোঝালে আগের দুই কিস্তির অনেকগুলি প্রসঙ্গতে পূণরায় আলোকপাত করা যাবে। মানিকবাবুর আত্মীয় বাঙালির কল্পনায় আছে। কিন্তু ‘মানিকবাবুর মেঘ’ সেই আত্মীয়তাকে অস্বীকার করে। তারা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’-র বঙ্কুবাবু বা ‘হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক’-এর হরিপদ (অঞ্জন দত্তের গানটির সূত্র ছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র একটি গানে। কিন্তু তাদের মত মানিকবাবু তো ইউএফও পাবেন না, মেঘই পাবেন। কারণ ইউএফও দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কালচার হয় না, মেঘ দিয়ে হয়। জঁর দিয়ে বাঙালির কালচার হয় না। তাই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ সাইফাই হতে চাইলো না, এই না-চাওয়াটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্কুবাবু বা হরিপদ আধুনিক মানুষ ছিলেন; মানিকবাবুকে ‘অনাধুনিক সারল্য’ পারফর্ম করতে হয়। ইউএফও একটি আধুনিক কল্পনা; মেঘ টেনে আনলে মেঘদূতম্ টানা যায়, ধ্রুপদীয়ানা হয়। মানিকবাবু সুকুমার রায় পড়েন নির্মাতাদের অ্যাবসার্ডিটির তত্ত্ব দিতে, কারণ সুকুমার রায় আমাদের সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবে পরিচিত। তিনি কার্ল সাগান বা দানিকেনও পড়তে পারতেন, বা হুইটলি স্ট্রাইবার। কিন্তু তাহলে তো প্যান্ডেমিকের সময় থেকে সারা পৃথিবীতে হিস্টেরিয়ার মত বাড়তে থাকা ইউএফও-উৎসাহের অংশীদার হয়ে তিনি সমসাময়িক হয়ে যেতেন! সমসাময়িক অথচ উন্মাদ – এই আত্ম নিয়ে ছবিটি ইন্টারেস্টেড নয়। একটা বাংলা শর্ট ফিল্ম আছে, উজ্জ্বল পাল পরিচালিত, নাম ‘ক্লার্ক’, একই বিষয় নিয়ে, একইরকম চরিত্র নিয়ে। ছবির ধরনটাও প্রায় এক। কিন্তু সেখানে মেঘের বদলে কী আছে, কীভাবে আছে, এবং কীরকম চমকপ্রদভাবে আছে, সেটাই দেখার। এই ছবিটি অস্বীকার করে না যে অমিত সাহা অভিনীত তার প্রধান চরিত্রটি ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ বা ‘হরিপদ’-র আত্মীয়।
অথচ যে ছবি আমার পাওয়ার ইচ্ছে, তার সম্ভাবনাটা কিন্তু ছবিটাই তৈরি করেছিল, কিন্তু আরোপিত হল নান্দনিকতা। মানিকবাবু বেশি কথা বললেন না, তাই তিনি হিস্টেরিক হলেন না ছবির প্রথমার্ধে। হলে তিনি আমাদের অবদমিত কন্ঠ হতে পারতেন, এই সময় নিয়ে তিনি হয়ত অর্থহীনভাবেই সরব হতে পারতেন (অর্থময় সরবতা তো অনেক শুনলাম; জ্ঞান দেওয়া ভিন্ন কিছু হয়না)। তার ছাদের গাছের সবুজ রঙ দেখাটা আমার দরকার ছিল, যে সবুজ তল্লাটে আর কোথাও নেই, মানিকবাবুর লালনে আছে। ‘অশনি সংকেত’ সত্যজিৎ কেন কালারে করেছিলেন, তখনকার বামপন্থী ক্রিটিকরা বুঝতে পারেননি। সত্যজিৎ সৌন্দর্য আরোপ করেছেন আকালের ছবিতে, তারা অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎ দেখাতে চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশ সুজলা সুফলা হয়েও আকালে আছে, অর্থাৎ এই আকাল মানুষের তৈরি, প্রকৃতির নয়। ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ আরোপিত হল সাদা-কালো। সেই সবুজের রকমফের এক্সপ্রেসিভ হতে পারত ছবির মুড অনুযায়ী, বা মানিকবাবুর মুড অনুযায়ী। মেঘ আসার পর সেই সবুজ অভিমানী হতে পারত স্রেফ রঙের রকমফেরে, মেঘ-মানিকবাবু-গাছের ত্রিকোণ-প্রেম তৈরি হতে পারতো ‘অযান্ত্রিক’-এর মত – হল না, আরোপিত হল সাদা-কালো। বললাম না, ছবিটা মানিকবাবুকে বাইরে থেকে দেখছে; যেন মানিকবাবু ছবির শিশিতে ভরা একজন বাতিল মানুষ, ছবিটির তার মত বাতিল ছবি হওয়ার সাহস নেই। বাতিল মানুষের সঙ্গে আঙ্গিকগত ভাবে একাত্ম হওয়ার বাতিল ছবির ফর্ম দেখতে চাইলে খুঁজুন পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘শুভ কেমন আছো’।
‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর উদ্দিষ্ট দর্শক যদি মস্কোর ফেস্টিভালের দর্শক হয় তাহলে ছবিটির অনেক রেফারেন্সে subtle হতে পারবে না, তারা তো এই বাস্তবতা চেনে না। আর কলকাতায় যারা চেনে তাদের যদি দেখলে জমিয়ে কাব্য ও কালচার হবে সেই আশ্বাস দেওয়া না যায়, তারা দেখবে না। যারা পর্দায় মানিকবাবুকে দেখে “আহা আটপৌরে সাধারণ জীবন!” বলেন তাঁরা সেই জীবনের উর্দ্ধে উঠে গেছেন বলে বলেন; যেমন যারা এখন “আহা অপু দুর্গা!” বলে তাদের বাড়িতে কন্যাসন্তান সুচিকিৎসার আর সুষম খাদ্যের অভাবে নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যায় না। অতএব, যদি এমন হয় যে এই ফর্মের ছবি শুধুই এরাই দেখবে, তাহলে বানানো একরকম হবে। হয়ত সেটা এরকমই।
বাস্তববাদী ছবির সবচাইতে জোরের জায়গা কোথায়? যেহেতু ঐতিহাসিক বাস্তব সদাপরিবর্তনশীল, তাই সবসময় পুঁজিবাদের রকমফেরে নতুন নতুন বাস্তবতার ভাঁজ তৈরি হচ্ছে। এখন যারা নিম্নমধ্যবিত্ত, তাদের আয়ের পথ ২০ বছর আগের নিম্নমধ্যবিত্তের চাইতে আলাদা। তাদের সেভিংস-এর ধরনও আলাদা (হয়তো তারা লক্ষ্মীর ভাঁড় ব্যবহার করে না), তাদের বিপন্নতার ধরন আলাদা, তাদের নৈতিকতাও আলাদা। অতএব, বাস্তববাদকে ফলপ্রসূ থাকতে হলে এই ঐতিহাসিক বাস্তবের খুব সূক্ষ্ম বদল, ফারাক, তারতম্যগুলোকে দেখতে শিখতে হয়। এর সঙ্গেই একটা জিনিস যুগপৎ চলতে থাকে, সংস্কৃতি নিজের ‘কৃত্রিম বাস্তবতা’ বানায়। হরিপদ কেরানির জগত যতটাই প্রামাণ্য, ততটাই কালচারাল চিহ্নসমষ্টি, অর্থাৎ অনেকটাই শিল্প ও সংস্কৃতি থেকে কুড়িয়ে নেওয়া বা সোজা কথায় ক্লিশে দ্বারা নির্মিত একটা জগত। সেটা যতটা না উত্তর কলকাতার বাস্তব তার চাইতেও কবিতা, গান, গল্প থেকে তৈরি করা বাস্তব। আগের প্রক্রিয়াটা হল বাস্তবে কী কী বদল হচ্ছে তা দেখা, কোনটা নতুন বা ধারাবাহিকতা ভাঙলো তা খেয়ালে রাখা, আর পরেরটার কাজ হল representation-এ continuous বা consistent-কে দেখা। দ্বিতীয় পন্থাটা আমার কাছে আদপেই ব্রাত্য নয়, যদি সেটা সমসময়ের উৎস হতে ভিন্ন আলোর উৎসারণ ঘটায়, বাইরে থেকে আলো ফেলার বদলে। আর যদি সেই পন্থা নিজের কৃত্রিমতা নিয়ে সচেতন থাকে।
অর্থাৎ এমনও তো হতে পারে যে সিনেমা এমন এক সিন্থেটিক জগৎ দেখালো যেটা আসলে কোথাও নেই, যেটা আসলে বাঙালির ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে কিছু কোলাজ বানিয়ে গড়া একটা ‘সিনেমাটিক বাস্তব’, যেখানে একলা হরিপদর বাড়িতে যে ইউএফও আসে তাই নয়, ওর তিন পুরুষ ধরে এসেছে! ওর প্রতি প্রজন্মই ইউএফও-য় হাপিশ হয়ে গেছে। ইউএফও-ই আবার একদিন আরেক প্রজন্মকে ওই বাড়ির ছাদে নামিয়ে দিয়ে যায়। বাড়ির চাকর-বাকর কেয়ারটেকাররা সেটা জানে, তারা আবার ওর দেখভাল করে, হরিপদরা আবার কেরানি হয়ে যায়।
এমনটা না চাইলে, বাস্তববাদ ব্যবহার করলে, দৃশ্য-শব্দ-ডিটেলের উপাদান হিসেবে ব্যবহার না করে অস্তিত্বের বাস্তববাদ ব্যক্ত হোক। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। সেই লেখাগুলো পড়েই বোঝা যাচ্ছে যে এই ছবি এমন এক নান্দনিকতা উদ্রেক করছে, যেখানে নিউরোসিসের কোনও স্থান নেই। তুলতুলে কাব্যিক সুখী গদ্য সেখানে। এই হয়, জীবনানন্দ থেকে বিনয় পেরিয়ে আমরা কাব্যিকতা বলতে এই ভাষায় মজে থাকা বুঝি; এই ছবি দেখে বাঙালি সেই ভাষায় মজার একটা সুযোগ পেয়েছে!
আমাদের অবদমিত কথাগুলো ব্যক্ত করতে হবে, নিউরোটিক হতে হবে নতুন ছবিতে। তার আগে আমাদের অবদমনকে স্বীকার করতে হবে, চিনতে হবে। আমরাই আমাদের এক নাগরিক কেরানিকে দুরত্ব থেকে দেখব না। তার অসুখ আমাদেরও অসুখ, আমাদের ছবির অসুখ হোক। তুলনায় ‘পারিয়া’-র যে ফর্ম ও আঙ্গিক, সেই ছবিতে সেই নিউরোসিস ব্যক্ত করার সম্ভাবনা আছে। ‘পারিয়া’-ও একাকী অসুখী একটি মানুষের ছবি। মানিকবাবুর কাছে যা মেঘ, লুব্ধকের কাছে তা কুকুর – মানবসমাজ জাত অর্থহীনতার যুগে অ-মানুষী অবলম্বন। তফাত হল, কুকুরকে অ্যাবিউজ করা যায়, মেঘকে যায় না। যায় না? গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর যুগে মেঘকে টক্সিক কেমিকেলে ঠুসে দিলেই মেঘকে অ্যাবিউজ করা হয়, হচ্ছে। ‘টক্সিক ক্লাউড’ কাকে বলে গুগল করুন। সেই মেঘ বিষবৃষ্টি ঝরালে তখন মানিকবাবু কী করবেন? কেন মানিকবাবু মেঘের মধ্যে মানুষের বিষ ঠুসে দেওয়া টের পেলেন না?
‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর এই কেরানির কোট আর ধুতির মত ‘সাদা-কালো’, এই ‘সংলাপহীনতা’ আর্ট নয়, কালচার, গ্লোবাল আর্টহাউজে পশ্চিমবঙ্গের কালচারাল আর্কাইভাল এথনোগ্রাফিক অবদান। সেইজন্যই ছবিটি বিরক্ত না করে আমাদের আরাম দিচ্ছে, আমরা নিজেদেরকেই ‘বাইরের চোখ’ দিয়ে দেখছি বলে। ছবিটি আদপেই ব্যর্থ নয়, কালচারালি সাক্সেসফুল, ব্যর্থ আমার ছবির সাধ।
বা বলা ভাল, এই জীবনের সার সত্য, ব্যর্থ আমার নতুন বাংলা ছবির সাধ। কেন যে নিজের ভাষায় নতুন ছবি দেখার সাধ এখনও আছে! বাংলা ছবি ওপার বাংলাতেও হয়, তার মান উর্ধ্বমুখী। কিন্তু ইতিহাসের খেয়ালেই সেখানকার সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আমার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত নয়; ভাষা এক, ভূমি এক, সংগীত এক, কাব্য এক হলেও। নিজেদের সিনেমা প্রয়োজন হয় নিজেদের প্রেক্ষিতে বাঁচাকে অর্থময় করতে।
এই লেখায় যে আমি ‘পারিয়া’ বা ‘মানিকবাবুর মেঘ’-কে আদপেই অপর্যাপ্ত ছবি বলছি তা নয়, ছবিগুলোয় আরো কী মাত্রা যুক্ত করা যেত তাই বললাম। এটা ‘কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজম’ হল কিনা, পাঠকদের বিচার্য। ‘পারিয়া’ ডার্ক অ্যাকশন ছবি হতে চায় যার একটি শুভবোধসম্পন্ন হৃদয় আছে, শুধুমাত্র তামসিকতার এক্সারসাইজ হতে চায়না। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ প্রান্তিক একটি চরিত্রের সংবেদনশীল একটি ছবি হতে চায়। আমার সমালোচনা ছবিগুলির এই অভীপ্সার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এটাও স্বীকার করছি যে ছবিগুলি সেরকম খানিকটা হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি হতে পারেনি। পারাটা দরকার। আমি যে মাত্রাগুলি চাইছি সেগুলি অযাচিত কিনা তা পাঠকের বিচার্য।
এই লেখায় যার বিরোধিতা আমি করেছি, তা হল একধরণের আরোপিত সংস্কৃতির ধারণার, সে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালির হোক বা গ্লোবাল আর্টহাউজ সিনেমার। কারণ এই আরোপিত ‘কালচারাল’ পলি বাংলা ছবিকে আরো আন্তরিক হতে বাধা দিচ্ছে বলে আমি মনে করি। বাংলা ছবিকে আরো ‘রিলেটেবল’ হতে হবে; এবং তার গণ্ডী পেরিয়ে রিলেটেবল হতে হবে, এবং তার ভাষিক সীমানার মধ্যেই রিলেটেবল হতে হবে। অন্য কথায়, কলকাতা এবং মাল্টিপ্লেক্স ছাড়িয়ে যেতে হবে, এবং আপামর বাঙালির কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে হবে, নেহাতই বিনোদন বা কালচারের নুড়ি-পাথর হিসেবে নয়।
এই লেখায় আমার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপত্তিটা হয়ত অনেকের অদ্ভুত ঠেকবে। আমি সেই ব্যাপারে সবার সহমতও প্রত্যাশা করছি না। আগেও বলেছি, শিল্পকর্মই সংস্কৃতির উপাদান। কিন্তু শিল্পকর্মের গ্রহণে যে খোলা মনের মুক্তি কাম্য, তার নিরিখে কোনও কোনও যুগে সংস্কৃতি খাঁচার মত। সে অর্থে কালচার হল আর্টের চিড়িয়াখানার মত, তাতে বিচিত্র প্রাণীরা সংরক্ষিত থাকে, কিন্তু বদ্ধতায়। সংস্কৃতি নিয়ম-নিদানে বদ্ধ থাকে, সংস্কৃতি তৈরি হয় একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সংখ্যাগুরুর ঐকমত্যে। এই মুহুর্তে, নতুন সিনেমাকে সংস্কৃতির বিরোধীতা করতে হবে – আমার মতে।
বাংলার কাব্যিক আর্ট সিনেমার সংস্কৃতিই বলবে ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ নিউরোটিক ভায়োলেন্স অসম্ভব, massy ছবির সংস্কৃতিই বলবে ‘পারিয়া’-র নায়ককে গতে বাঁধা পৌরুষেই বাঁধতে হবে। যে পৌরুষে অধুনার অ্যাকশন-হিরোর আলফা-ম্যাস্কুলিনিটির মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি নেই, তার দ্বারা যেন rage সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যখনই কেউ একটি ছবি বানাচ্ছেন, তখন সেই ছবির যে সর্বসম্মত ‘কালচার’, তাকে লঙ্ঘন করা যাচ্ছে না, বরং তা থেকে ছবিটি যেন স্বীকৃতি চাইছে। ‘পারিয়া’ বলছে আমি কি massy হলাম? ‘মানিকবাবুর মেঘ’ বলছে আমি কি arty হলাম? দর্শকও সেই ধারণার ঘেরাটোপের সীমাবদ্ধতাই চাইছে। একে বলা যায় ossification – বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির হাড়-গোড় জমাট বেঁধে গেছে, তাতে নতুন কল্পনার নমনীয়তা দেওয়া যাচ্ছেনা।
‘পারিয়া’ প্রসঙ্গে অনেকে কোরিয়ান ছবিতে ভায়োলেন্সের কথা তুলেছেন। কোরিয়ার ছবির কথা এরকম তীব্র ভায়োলেন্সের যে কোনও ছবির প্রসঙ্গেই ইদানিং তোলা হয়। কিন্তু সেই তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রাকে ভুলে যাওয়া হয়। কোরিয়ার শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে han নামে একটি ধারণা আছে, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হয়না, যে ধারণার উৎস কোরিয়ার ইতিহাসে প্রোথিত। উইকিপিডিয়া উদ্ধৃত করছে – “Han is frequently translated as sorrow, spite, rancour, regret, resentment or grief, among many other attempts to explain a concept that has no English equivalent … A complex emotional cluster often translated as ‘resentful sorrow.” এই ‘ভাব’-টি কোরিয়ার ছবি যে কোনোরকমের জঁরেই প্রকাশ করতে পারে, তীব্র ভায়োলেন্স তার একমাত্র ধরন নয়, তীব্র বিরহতেও তার প্রকাশ সম্ভব, সম্ভব অজানা আতংকের উদ্রেকেও। অতএব, সিনেমাটিক ভায়োলেন্সে যাঁরা কেবলই কোরিয়ান ছবির প্রভাব দেখতে পান, তাঁরা কেবলমাত্র উপরিতলটি দেখছেন। দেখছেন না এই ‘আধিক্যের নন্দনতত্ত্ব’ কীভাবে প্রায় অব্যক্ত একরকম জাতীয় অনুভূতিকে আকার দিচ্ছে। তাই অনুকরণ ছাড়া কিছু শিখছেন না।
যেভাবে এই ‘বোধ’ কোরিয়ান জঁর ছবিকে উন্নীত করে – এইভাবেই সংস্কৃতি শিল্পের সহায়ক হতে পারে। অর্থাৎ সংস্কৃতিতেই মুক্ত-নমনীয় একটি ‘ফাঁকা আকার’ আছে যাতে যে কোনোরকম ‘অভিজ্ঞতা’-কে ধারণ করানো যায়। কিন্তু ক্রাফটের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন এখানেই যে অভিব্যক্তিতে একরকম ইশারা রেখে দিতে হবে; আবার ইশারাটা রাখতে হবে ‘আধিক্য’ দিয়ে। অর্থাৎ যা ‘দেখানো হচ্ছে’, তার উর্দ্ধে, বাইরে যেন ইঙ্গিত করবে ছবির আধিক্য। এই ‘উদ্রেক’-এর ফলে যেটা হয়, কেবলমাত্র উদ্দিষ্ট দর্শকের রুচি-শ্রেণি-কালচার-পছন্দের মধ্যে ছবির গ্রহণ সীমাবদ্ধ থাকে না। আরেকটু বোঝাচ্ছি, আমাদের বাংলা ছবি যত দিন যাচ্ছে ততই তার address (যার বাংলা উদ্দেশ্য ও ঠিকানা দুই-ই হতে পারে) সংকুচিত করে দিচ্ছে। একটি ছবি একটি উদ্দীষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে যেতে পারছে না। কিন্তু কোরিয়ান ছবির (বা শিল্পের) এই বিচিত্র মাত্রাটি ছবিটিকে শুধুমাত্র একটি গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ রাখে না, কারণ ‘হান’ সবার মনেই বাসা বাঁধে, মধ্যবিত্ত বা প্রান্তিক সবার। যিনি দেখছেন তিনি আলোড়িত হলেই, যেহেতু ছবির আবেগ-অনুভূতিতে আধিক্য আছে এবং আছে না-বলা কথার ইশারা, অভিব্যক্তি রূপকধর্মীতা পাচ্ছে আর দর্শক তাঁর নিজের বোধ এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে শুন্য স্থান পূর্ণ করতে পারছেন। জমাট বাঁধা কালচার এটাই করতে দেয় না।
কেন কোরিয়ার প্রসঙ্গ আনলাম? কোরিয়ার ‘হান’ নিয়ে পড়তে গেলে দেখবেন তার উৎস ঠিক খুঁজে না পাওয়া গেলেও, কোরিয়ার ইতিহাসে যে বারংবার বহিরাগত শক্তিশালী জাতির, চীন ও জাপানের, শাসনে পর্যুদস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা, দেশবিভক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা, নিজেরই অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বা অতীতকে স্পর্শ করতে গেলে যন্ত্রণাকীর্ণ হওয়ার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাতেই সেই উৎস আছে বলে অনেকে মনে করছেন। তারপর এই বোধ ছড়িয়ে পড়ছে জনপ্রিয় এবং কুলীন-শিল্পে, সংস্কৃতির মূলধারা এবং প্রান্তিকে, সর্বত্র। আমাদের এই পোড়া বাংলার ইতিহাসে সমকক্ষ বোধ পাওয়া কি খুব কঠিন? কঠিন তখনই হয়, যখন প্রথমত, তা deny করা হয়, অবদমিত হয়। দ্বিতীয়ত, এমন কালচার তৈরিই হয় যা কিনা অসুখী-অস্বস্তির যা কিছু তাকে বাইরের ঘরের বাইরে রাখে। আজ সত্যিই অবাক লাগে ভাবতে কীভাবে এই ভাষায় একই সঙ্গে ‘সপ্তপদী’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ তৈরি হয়েছিল। এই দুটি ছবির আত্মীয়তা কোথায়, তা পাঠকের কল্পনা আর স্মৃতির উপরেই ছেড়ে দিলাম। এবং আরেকটি ছবির কথা এই প্রসঙ্গেই মনে করিয়ে রাখলাম, যা সবার ভাল লাগেনি, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’।
এই লেখা আপাতত মুলতুবি থাকলো
যখন এই লেখা লিখছি তখন প্রতিবেশী দেশে অগ্নিগর্ভ অবস্থা। সেই দেশের ভাষা বাংলা, এই দেশের ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে আমাদের ল্যান্ডস্কেপের তফাত নেই, তফাত নেই ভূমিলগ্ন মানুষের অবয়বের, তফাত নেই গাছের বা পুকুরের বা পাখির। সেই দেশে বাংলা ভাষায় সিনেমার যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল তা নিশ্চয়ই ধাক্কা খেলো, কিন্তু বলা যায়না এক নতুন দিশাও পেয়ে যেতে পারে। তাই, আপাতত এই মুহূর্তে এই লেখার কোনও প্রয়োজন নেই।
দিনবদল হোক বা নতুন একটি ফিল্ম – তার জন্ম হয় তরুণ মনে। যে সিনেমা সেই তরুণের প্রৌঢ় অভিভাবকদের মনে প্রথমে আসে, সেই সিনেমা বর্তমানে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের দিশা দিতে পারে না। এটাই আক্ষেপের, তরুণরা দিনবদল আনে, কিন্তু ক্ষমতায় আসে তাদের অভিভাবকরা। বাংলা সিনেমা প্রৌঢ়দের হাত থেকে তরুণদের হাতে আসুক। এবং সেই তরুণের যে vision – তাকে ক্ষুণ্ন করলে, ব্যাহত করলে কোনও ইন্ডাস্ট্রির যে আখেরে কিছু লাভ যে হবে না তা আশা করি এতদিনে প্রমাণ হয়ে গেছে, এবং গিল্ডরা সেটা জানেন।
একটা ছবি বেরিয়েছে – ‘কালিয়াচক চ্যাপ্টার ওয়ান’। ছবিটি কেমন, বা কজন সেটা দেখবে সেটা প্রশ্ন নয়। হয়তো দুর্বল ছবিই হবে। কিন্তু ছবিটি মালদায় বানানো। ওখানকার যুবকরা, অভিনেতারা অভিনয় করেছেন, তাদের ভাষা, তাদের সুরে কথা বলছেন, তাদের অঞ্চলে অভিনয় করছেন – এটা খুব মূল্যবান বলে মনে হয় আমার। সিনেমা ডিজিটাল হওয়া মাত্র এটা হওয়ার কথা ছিল; কেন হয়নি তা ইতিহাস বলবে।
এই লেখা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে আমি বাংলা ‘আর্ট সিনেমা’-র devaluation ঘটালাম, বদলে ‘বাজারি’ ছবির পুনর্জাগরণ চাইছি। মূলধারার ছবির যতই আপৎকালীন প্রয়োজন থাকুক না কেন, সেটা তো ‘কমপ্রোমাইজড’ সিনেমা– বিদ্বজ্জনের মনে হবে। কিছু কথা ‘পলিটিকাল রূপক’-এ বলি তাহলে; জ্ঞান দিচ্ছি না, নিজেকেই বোঝাতে চেষ্টা করছি। উন্নত আর্ট সিনেমাই একটি আধুনিক শৈল্পিক চেতনার অভীষ্ট, ঠিক যেমন ধর্মনিরপেক্ষ ওয়েলফেয়ার স্টেট একটি আধুনিক দেশের অভীষ্ট। কিন্তু যে প্রজন্মকে সেই ধর্মনিরপেক্ষ ওয়েলফেয়ার স্টেটের মূল্য বোঝানো হয়নি, বা সেই মূল্যবোধ সীমাবদ্ধ থেকে গেছে মুষ্টিমেয় শিক্ষিতদের হাতে, সেই গোটা প্রজন্ম যখন দ্রোহের তাড়নায় রাস্তায় নামবে, যেহেতু তাদের সেই দ্রোহের ধারণা ভাবনার দিক দিয়ে সংখ্যাগুরুর নিরিখে ‘কমপ্রোমাইজড’, তা কি স্থগিত থাকবে? থাকবে না। অপশাসন যখন পড়বে নিজের ভারেই পড়বে, আগামী তৈরি থাকুক বা না থাকুক। দ্রোহের ক্ষণ সবসময়ে প্রস্তুতির পর আসে না; এবং সফল দ্রোহের পরও আগামীর শাসনও কম্প্রোমাইজড হয়ে যেতে পারে, যেহেতু যারা দ্রোহ করে তারা ক্ষমতাসীন হয় না। কিন্তু তাতে দ্রোহের মূল্য কমে না, ইতিহাস রচিত হয় মানুষের হাতে, তাও দ্রোহের ‘ড্রেস-রিহার্সাল’-টি হয়, কী চাওয়া হয়েছিল, কী পাওয়া গেল না এবং কেন পাওয়া গেল না তা আর অনুমানে সীমাবদ্ধ থাকেনা, অভিজ্ঞতায় জারিত হয়। আগামী অতএব সবসময়েই সম্ভাবনা হিসেবে জ্যান্ত থাকে। ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রে যে জিনিসটা অবমূল্যায়িত হয় তা হল গণতন্ত্রের মর্ম। সেই আবহে যে প্রজন্ম বাড়বে সে যে সেই মূল্যটা জানবে না তাই বাস্তব; কিন্তু তাও যে সে অপশাসনকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছে সেটাও সত্য।
বাংলা সিনেমার ‘আর্ট’-এর দিকটা ক্ষয়ে গেছে। ক্ষয়ে গেছে সাধারণ ফিল্ম-সেন্স; সিনেমায় শিল্পচেতনা মধ্যবিত্তর প্রিভিলেজের ও আয়েসী যাপনের উপাদান হয়ে গেছে, তাতে বহুদিন হল যেটা নেই সেটা হল কোনরকম earnestness। আর্টহাউজ সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা শুধুই গ্লোবাল কর্পোরেটের নান্দনিকতায় টিক মার্ক দিয়ে যাচ্ছি। অতএব একে ফেলে দিতে হবেই; দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আবার নতুন করে ফিরিয়ে আনা যায়। একটা প্রজন্ম কেটে গেছে যাদের ফিল্ম-সেন্সের শিক্ষা নেই, যাদের জানানো হয়নি সিনেমার সম্ভাবনার কথা। তারা যদি বাংলা সিনেমাকে রিজেক্ট করে বিনোদনমূলক ‘কম্প্রোমাইজ’ চায়, তাই আসবে, কিন্তু তাতেও আন্তরিকতার অভিব্যক্তি থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ শহুরে উন্নত সিনেমার ‘শাসকরা’ তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, তাদের ক্রাইসিস স্বীকার করেনি, নিজেদের গণ্ডীতে তৃপ্ত থেকেছে, তাতে হারিয়ে গেছে অভিব্যক্তির সমস্ত সম্ভাবনা, হয়ে গেছে কালচারের চিহ্নসমষ্টি। এই সিনেমা থাকবে না। তার বদলে যে সিনেমা আসবে তাও ‘পর্যাপ্ত’ হবেনা, কিন্তু তাতে অধুনার রিজেকশন থাকবে। হয়ত স্পষ্ট ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণা না থাকলে যেমন মৌলবাদ বা দক্ষিণপন্থা দ্রোহকে হাইজ্যাক করে নিতে পারে, সেভাবেই আগামীর নতুন বাংলা সিনেমাকে হাইজ্যাক করে নিতে পারে প্লেবিয়ান বা লুম্পেন অস্থিরতার অপরিশীলতা। কিন্তু তাও এই নিষ্ফলা মেট্রোপলিটান মধ্যবিত্তের বাংলা সিনেমা যাক; আসুক নিরলঙ্কার অস্থিরতা যাতে অস্তিত্বের এনার্জি আছে। কেন? কারণ এই মধ্যবিত্তটাই আর আধুনিকমনস্ক নেই, জরদ্গব হয়ে গেছে।
আপাতত মনটা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমায় নেই, বাংলাদেশে আছে …।
একটা দুর্বোধ্য উথাল-পাথাল সময়ে বাঁচছি। সেখানে সিনেমা থেকে আর কিছু চাইছি না, চাইছি এই সময় নিয়ে কিছু গল্প দেবে যা দিয়ে অস্তিত্বকে দ্যোতনাময় করব, কিছু শৈল্পিক অভিজ্ঞতা দেবে যার মাধ্যমে এই বেবাক জীবনকে একটু নতুন করে বুঝবো, কিছু কল্পিত চরিত্রকে আর মুহূর্তকে অর্থময় করে মনে রেখে দেবো এই অর্থহীনতার বিশ্বে, অসাড় করা সময়ে অচেনা আবেগের আড় ভাঙবে, আর ফাউ হিসেবে পাবো রসাস্বাদনের আনন্দ। শর্ত এতটুকুই, সেই সিনেমাকে আন্তরিক হতে হবে, ফাঁকি মারলে বা চালাকি করলে চলবে না। ইতিহাসেরই খেয়াল, আন্তরিকতার অনুভবের চাইতে ফাঁকি আর চালাকিগুলো চোখে পড়ে যায় বেশি।
(শেষ, আপাতত)
