আমাদের চলচ্চিত্রবোধেও সংকট আছে
আমাদের চলচ্চিত্রবোধেরও যে একরকম অবক্ষয় হয়েছে তা স্বীকার করলে ভাল।
একটা গৌণ প্রসঙ্গ (কী আইরনি, এক কালে সিনেমা নিয়ে লেখালেখির এটাই ছিল মূল প্রসঙ্গ) – কেন একদা চলচ্চিত্রচর্চা মূলধারা-বিমুখ হয়ে বিকল্প-ধারার দিকে ঝুঁকেছিল? কারণ বাঙালি তখন ‘চলচ্চিত্রের ভাষা’ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিল, এবং সেই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে ইচ্ছুক ছিল, নির্মাতা এবং দর্শক দুজনেই। যে জন্য ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন গোছের স্বল্পদৈর্ঘ্যের কোর্স শুরু হয়েছিল। একটা ধারণা জন্মেছিল যে মূলধারার ছবিতে এই ভাষার চর্চা সম্ভব নয়। অবশ্যই ধারণাটা কিঞ্চিৎ বেঠিক ছিল, কিন্তু ধারণাটা কেন হয়েছিল? কারণ সেই সময়ে মূলধারার ছবি ছিল অত্যন্ত স্টেবল, যাতে নতুন ভাষার প্রায় প্রয়োজন নেই মনে হয়েছিল। মূলধারার সেই স্থিতিশীলতা আশির দশক থেকেই ধীরে ধীরে অপসৃত হতে থাকে, বা সেই ছবির ভাষা হয়ে যায় অপরিশীলিত। এই সময়ে সেই ছবিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার চাইতে নতুন ছবিতে উৎসাহী মেকাররা হয়ে পড়লেন মেনস্ট্রিম-বিমুখ। এই যুগটাও পাল্টালো, নব্বইয়ের দশকে পরের দিক থেকে আর এই ভাষা নিয়ে সচেতনতা দুইধরনের ছবিতেই আর চর্চিত হল না।
চলচ্চিত্র-বোধ কী? চটজলদি সংজ্ঞা – একধরণের শৈল্পিক অভিজ্ঞতার বোধ যা শুধুই সিনেমায় হয়, তার জন্য একরকম বিশেষ ভাষা লাগে চিত্র-শব্দ-মন্তাজ-অনুষঙ্গের। ভেবে দেখুন, এই বোধ কিন্তু ‘আর্ট’ এবং ‘কমার্শিয়াল’ দু’ধরনের ছবিতেই ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। এখন এই চলচ্চিত্রের ভাষা-সচেতনতা বা চলচ্চিত্র-বোধ জিনিসটাই ‘এলিয়েন’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, নির্মাতারা সেই ভাষাতেই ছবি করেন আর দর্শকরা সেই ভাষাতেই ছবি বোঝেন, কিন্তু ভাষাটার ব্যাকরণ নিয়ে আর বিশেষ ভাবেন না। লাভের মধ্যে, ঠিক যেভাবে “কেন কী” বা “তিনি বলেছিল” জাতীয় উদ্ভট বাংলার চল চারিদিকে, সেভাবেই “কেন কী’ জাতীয় চলচ্চিত্র-ভাষার চল বাংলা সিনেমায়। এর প্রধান কারণ – বাংলা-ভাষায় চলচ্চিত্র-বোধ চর্চার অভাব ও অসচেতনতা, এবং তার জায়গায় সোশাল-মিডিয়ার কমন-সেন্সিকাল প্র্যাক্টিসের চলে আসা।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে যখন আমি একজন কিশোর-যুবক হিসেবে সিনেমায় উৎসাহিত হয়ে উঠছিলাম তখন ভিন্নধারার ছবির ধারণা তৈরি করতে প্রতিষ্ঠিত এবং লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হত প্রচুর লেখা। অর্থাৎ, সিভিল সোসাইটিতে সেই ধরনের আলোচনার প্রতি আগ্রহ ছিল, চর্চাও ছিল। মনে রাখতে হবে, বিশ্বসিনেমা তখন কিন্তু এখনকার মত আমাদের নাগালে ছিল না; কিন্তু তা উৎসাহে ভাটা ফেলেনি। এখন সারা বিশ্বের ছবি আমাদের অনায়াস নাগালে আছে। চলচ্চিত্রবোধ নিয়ে একই কথা কি বলতে পারি? বিশেষ করে সেই সমস্ত লেখালেখির প্রতি উৎসাহের সমকক্ষ কিছু আছে কি?
আমার গত বিশ বছরের লেখালেখির অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী ব্যতিরেকে আমাদের লেখালেখি, বলাবলি কিছু ‘বিচিত্র কথন’-এ পর্যবসিত হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁয় আবহসঙ্গীতের মত, চলছে কিন্তু কেউ শুনছে না, এসব বলা হয়ে থাকলে ভাল ‘কালচার’-এর আবহ তৈরি হয়; আমরা সেই আবহই তৈরি করি মাত্র। উন্নত চলচ্চিত্রবোধ একসময়ে উন্নত শিল্পবোধের অংশ ছিল। উন্নত শিল্পবোধ উন্নতমানের ক্রিটিকাল নাগরিকত্ব নির্মাণের সহায়ক ছিল।
সেই নাগরিকত্বের ধারণাই নেই আর; তার স্থান নিয়েছে কনজিউমারের অ্যাস্পিরেশন। তাহলে যুক্তি-পরম্পরায় উন্নত চলচ্চিত্রবোধের প্রয়োজন আর থাকেনা; বরং অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্তের প্রেস্টিজিয়াস ছবির প্রয়োজন রইল স্রেফ ‘কালচারাল কুলীন’ হতে। এমন ভিন্নধর্মী ছবি কিন্তু হওয়া সম্ভব যা এই ‘বাঙালিয়ানা’ (স্বচ্ছল-দাম্ভিক বা দুঃস্থ-বেচারা, দু’ধরনের উদাহরণই পাওয়া যায়) নির্মাণে উৎসাহী নয়। সাংস্কৃতিক শ্লাঘা সেই ছবির কাম্য নয়; সেই ছবি সাংস্কৃতিক কৌলিন্যকামী নয়। তেমন ছবিতে কি মিডিয়া বা মধ্যবিত্ত-ভোক্তা সমাজের উৎসাহ থাকবে?
কালচার একটি জনগোষ্ঠীর কনসেনশাসে তৈরি কিছু চিহ্ন মাত্র। সংস্কৃতির ভিতর-বাহির থাকে; সংস্কৃতি সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকে তার ভিতরে কী আছে, আর কী তাতে শোভা পায়না – এইসব নিয়ম-নিদানে। সেভাবেই কালচারের ব্যবসা হয়, এটা আমাদের দর্শক ঠিক ‘খাবে না’, এই আন্দাজ কালচারেরই আন্দাজ। আর্ট সেই আলোকিত বৃত্তের সীমানার বাইরের অন্ধকারে কী আছে তাতেই উৎসাহী থাকে। উত্তর কলকাতার ভগ্ন ঐতিহ্য, দক্ষিণ কলকাতার মগ্ন লিবারালপনা – এইসব আর্টের বিষয় নয়, কালচারের বিষয়। তাই শিল্প-সংস্কৃতি যুগ্মপদটি পরিহার করে, কালচারই যে ইন্ডাস্ট্রি, কালচারই যে বিজ্ঞাপন – এটা মেনে নেওয়া ভাল। আর্ট সেই চৌহদ্দির বাইরের জিনিস, যদিও আর্টের ফসল হল কালচারের fodder, কালচার শিল্পকর্মকেই চিবিয়ে খেয়ে জাবর কেটে বাঁচে। পরিহাস এই – কালচার ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির আর কোনও পুঁজি নেই, পণ্য নেই, ভোগ্য নেই, আত্মপরিচয় নেই; সেজন্যই বাঙালির কালচারাল প্রোডাকশন লাগে, তার শৈল্পিক মূল্য অকিঞ্চিৎকর হলেও।
বাঙালি তাই এখন কালচার খায় শুধু, তা নিয়ে ভাবে না। সেইজন্যই চলচ্চিত্রবোধের অবক্ষয়। এইজন্যই দেখবেন যে ইউটিউব রিভিউয়ার বেশ উচ্চমানের রিভিউ করতে সক্ষম, তাকে অ্যালগরিদম বজায় রাখতে বাজে ছবিও রিভিউ করে যেতে হয়, এবং বিবিধ ‘আপডেট’, ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ‘স্পেকুলেশন’ দিতে দিতে সে কার্যত হয়ে যায় ইন্ডাস্ট্রির মুখপাত্র। বাজারে যা ট্রেন্ডিং তা নিয়ে মতামত জানাতে অথবা ফ্যানবেস catering করতে হয় views-এর সংখ্যা স্টেডি রাখতে। এহেন অবস্থায় সমালোচনা করতে যে দুরত্ব প্রয়োজন হয় তা যায় ঘুঁচে। অর্থাৎ, একজন দক্ষ ইউটিউব রিভিউয়ারের মধ্যে একটা স্পষ্ট সত্তার বিভাজন তৈরি হতে বাধ্য – একদিকে সমালোচক, অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রির মাউথপিস। কারণ সে ক্যাপিটালিস্ট প্রোডাকশনের প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছে যখন থেকে তার চ্যানেলের মনিটাইজেশন শুরু হয়েছে। ক্ষতিটা এখানেই হয় যে সে ছবি বিশ্লেষণ করায় দক্ষ, কিন্তু যেহেতু সেও বাজারে প্রবেশ করে গেছে, তার উন্নত চলচ্চিত্রবোধের ভোক্তা কমতে আরম্ভ করবে। জনপ্রিয়তাবিরোধিতা তার পরতায় পোষাবে না। আখেরে market is the greatest leveler, আর বংবাজারের প্রধান প্রোডাক্ট হল কালচার। সিনেমা নিয়ে কমন-সেন্সও তাই, অতএব, কালচার।
কিছুদিনের মধ্যেই তার অন্য বোধোদয় হবে। কনজিউমার মার্কেট ক্রিটিকাল সমালোচনা পছন্দ করেনা। কনজিউমার আর বাজারের যোগসূত্র যখন ইমেডিয়েট, তখন আর এই লোকটির প্রয়োজন নেই যে কিনা প্রোডাক্টের গুণমান বিচার করার স্পেশালিস্ট। সেই কাজটি ভোক্তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই হবে। তাই রিভিউয়ারকে হতে হবে কনজিউমারের প্রতিনিধি। যেহেতু বাংলায় চাকরি নেই, চাকরি থাকলেও মাইনে কম, মানুষের হাতে উদবৃত্ত অর্থ কম, মধ্যবিত্ত পাঁচশো টাকায় কফিশপে এক ঘন্টা আড্ডায় ব্যয় করে কিন্তু সেই টাকাটা সিনেমা দেখা বা বই কেনার আগে তিনবার ভাবে। আপাতত রিভিউয়ারের মূল্য এটুকুই যে রিভিউয়ার বলে দিচ্ছে ছবিটা দেখবেন নাকি দেখবেন না। যদি কোনো সুদিনে মানুষের হাতে টাকা বেড়ে যায়, তখন আর রিভিউয়ারের চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রতি কনজিউমারের ধৈর্য থাকবেনা।
বলাই বাহুল্য, রিভিউ আর সমালোচনা এক নয়, সমালোচনা আর ক্রিটিকাল সমালোচনা এক নয়, ক্রিটিকাল সমালোচনা আর তত্ত্ব এক নয়। তাই চর্চা এখন শুধু বাজারি ছবি নিয়েই হয়, সেই চর্চা থেকে ‘নতুন সিনেমা’ বা ‘অন্য সিনেমা’-র চাহিদা তৈরি হওয়ার সুযোগ হ্রাসমান। যিনি ভাবছেন যে এহেন সিনেমার আর কোনও প্রয়োজন নেই, তিনি আর্টি ছবিকে ‘আঁতেল’ ছবি মনে করেন, দেখেন না, তাঁকে জানানো যে মূলধারার ছবিতেও ‘নতুনত্ব’ এবং ‘ভিন্নত্ব’ প্রয়োজন হয় এবং সেটা কীরকম তা বুঝতে বা বোঝাতে গেলেও প্রয়োজন হয় উন্নত চলচ্চিত্রবোধ। বাজারি ছবি মানেই শিল্পমূল্যের নিরিখে খারাপ ছবি নয়। সেভাবেই বাজারি ছবি নিয়ে আলোচনা করার প্রক্রিয়াও তাকে দূরছাই করার প্রক্রিয়া নয়। এই ভুল ধারণার জন্যই আমাদের প্রচূর ভাল ছবির appraisal হয়নি। বাংলার মেনস্ট্রিম সিনেমার শ্রেষ্ঠ সময়ের মূল্যায়ন হয়েছে একমাত্র যে বিভাগে আমি পড়াই সেখানে, অহমিকা সহকারে বললাম। যে ফিল্ম-স্কুল, ইন্ডাস্ট্রি, ফিল্ম-সোসাইটির লোকজন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজকে পছন্দ করে না, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, বাংলা মূলধারার স্বর্ণযুগের যে ফর্ম, তা নিয়ে সিরিয়াসলি আমরাই পড়াশোনা করি; আপনারা সেই ছবির বোধজগৎ এবং ভাষাকে ভুলে গেছেন বলেই আপনাদের মূলধারার ছবি এখন এতটা দিশাহীন।
(চলবে)
