স্বপ্ন ও স্মৃতির ছবিঃ চিত্রনির্মাতা পায়েল কাপাডিয়ার সাথে কথোপকথনে কাউন্টার শট

পায়েল কাপাডিয়া বর্তমান ভারতবর্ষের একজন উল্লেখযোগ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট চিত্রনির্মাতা। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার(FTII) ডিরেকশন অ্যান্ড স্ক্রিনপ্লে রাইটিং-এর প্রাক্তনী পায়েল আফটারনুন ক্লাউডস (২০১৩), আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং (২০২১), দা লাস্ট ম্যাংগো বিফোর দা মনসুন (২০১৫)-এর মতো একাধিক ছবি তৈরি করেছেন। সারা দেশ জুড়ে চলতে থাকা উগ্র হিন্দুত্ববাদের  উত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং এফটিআইআই-এর দিনরাত্রি নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ছবি আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং-এর জন্য ২০২১ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গোল্ডেন আই অ্যাওয়ার্ড জেতেন এই পরিচালক। এর আগেও ২০১৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছিল পরিচালকের আফটারনুন ক্লাউডস। ইমেজের দুনিয়ায় হাবুডুবু খেতে থাকা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পায়েল ইমেজ ও সাউন্ড নিয়েই নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করে যেতে চান। কাউন্টার শট-এর সাথে কথোপকথন সূত্রে প্রকাশ্যে আসে ইমেজ নির্মাণের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে পায়েলের গভীর অনুসন্ধিৎসার পরিচয়- “ইদানিং ছবি বানানোর এই পদ্ধতিটা আমাকে ভীষণভাবে টানছে। হাইব্রিড একটা কিছুর ধারণা যেখানে ফিকশান ও নন ফিকশান খুব সহজে এসে মিশতে পারে- এই ভাবনায় আমি বেশ উত্তেজিত বোধ করছি”।

পায়েল কাপাডিয়ার সাথে আমাদের এই কথোপকথন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আমাদেরই পত্রিকার সহ সম্পাদক লাবণ্য দে। ওঁর কথায়-

অনুবাদকের কথাঃ

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কাপাডিয়া একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিত্রনির্মাতা এবং ওঁর কাজ আমাদের সিনেফিল সত্তাটিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং(২০২১) কেবল একটি ছবিই নয়- বরং আমাদের ছাত্রাবস্থার এক জীবন্ত দলিল। যে সময় আমাদের ভেঙেছে, গড়েছে, ভাবিয়েছে এবং নতুন এক সত্তার নির্মাণে সাহায্য করেছে।

পায়েলের সাথে হওয়া ইমেল কথোপকথন বাংলায় অনুবাদ করবার অভিজ্ঞতা মনে রেখে দেওয়ার মতো। এই ছবি এবং কাপাডিয়ার সাথে কথাবার্তা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আমার যাদবপুরের ছাত্রাবস্থার দিনগুলিতে যেখানে অ্যাডমিশান টেস্ট তুলে দেওয়ার বিপক্ষে, ইউনিয়ন ভেঙে কাউন্সিল করবার বিপক্ষে আর দেশজুড়ে এনআরসি সিএএ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলাম আমরা- মাটি কামড়ে পড়েছিল আমাদের রাতজাগা বন্ধুর দল। অনুবাদ করতে গিয়ে প্রতিটা লাইন নিয়ে বারবার বসতে বসতে আরেকবার সেই রাতগুলোকে বেঁচে নিচ্ছিলাম যেন। আরেকবার ছবিতে আর কথায় আর ইনকিলাব শব্দের গর্জনে যাপন করে নিচ্ছিলাম আমাদের উঠতি বয়সের স্বপ্ন, স্মৃতি আর ভঙ্গুরতাগুলোকে।   

কাউন্টার শটঃ সম্প্রতি The Circle -এর ইউটিউব চ্যানেলে স্ক্রিনিং হয়েছে আপনার ২০১৫ সালের ছবি দা লাস্ট ম্যাংগো বিফোর দা মনসুন। এখান থেকেই কথাবার্তা শুরু করা যাক যাক। অফস্ক্রিনে সমুদ্রের ঢেউ-এর আওয়াজ দিয়ে আঠারো মিনিটের এই এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মটির সূত্রপাত। স্ক্রিনে আমরা দেখি একা একজন মহিলাকে, খুব তৃপ্তি করে তাঁর ঘরে বসে আম খাচ্ছেন। ক্রমশ বোঝা যায়, হয়তো আমরা তাঁর স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। মহিলার স্বপ্নে তাঁর স্বামী মহিলাটিকে নিজের প্রিয় খাবার রান্না করে দিতে বলেন। যদিও ছবিটি কোনো একরৈখিক ন্যারেটিভ অনুসরণ করেনা- তাই একে এমন একরৈখিক প্লটলাইনে বেঁধে ফেলাও খুবই কঠিন। এখন এই ছবিটা আপনার কাছে কীভাবে এলো সেই ব্যাপারে একটু জানতে চাই। টুকরো টুকরো ছবি এবং ভাবনা জুড়তে জুড়তে এই কাজের সূত্রপাত, নাকি সম্পূর্ণ ভাবনাটি আগে আসে এবং তারপর সেই ভাবনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ শব্দ এবং ইমেজ মিশিয়ে দেন? 

পায়েল কাপাডিয়াঃ ছবিটা তৈরি হয় ২০১৪-এ। আমার অন্যান্য কাজের মতোই এটাও আগে থেকে খুব ভেবেচিন্তে শুরু করিনি। আমার এক বন্ধু তখন তামিলনাড়ুর গুদালুর এ শোলা ট্রাস্ট এ কাজ করছিলো। ওখানে ক্যামেরা ট্র্যাপে যেসব ছবি উঠতো, ও সেগুলো আমাকে পাঠাতে থাকতো। ছবিগুলো ছিলো মূলত নাইট ভিশান এ শ্যুট করা বন্য জন্তুদের। তার আগে আমি এই ধরনের কাজের সাথে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না, তাই ওই ইমেজগুলো আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছিলো। বৈজ্ঞানিক ইমেজগুলোয় কি অদ্ভুত এক কাব্যিক দ্যোতনা! ভয়ঙ্কর সব জন্তু জানোয়ারদের বনের মধ্যে এমন নিরীহ অসহায় অবস্থায় দেখাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়ে গেছিলো। ইতিমধ্যে আমার দিদিমার ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হতে থাকে। স্বপ্নে উনি বহু বছর যাবৎ মৃত স্বামীকে দেখতে পান। ঠিক আগেরদিনের কথা মনে রাখতে না পারলেও, বহুকাল আগের অতীতের ঘটনা তাঁর বেশ স্পষ্ট মনে পড়ত, যেহেতু সেগুলো বিশেষ কিছু স্মৃতির সাথে জড়িয়ে ছিল। স্বপ্ন আর স্মৃতিগুলোকে নিয়ে আমি দিদিমাকে ডায়েরী লেখার উস্কানি দি- যাতে করে এখন যা ঘটছে সেগুলোকে আবার পরে ভুলে না যান। ক্যামেরা ট্র্যাপ এর ফর্ম আর স্মৃতি- এই বিষয় দুটোর মধ্যে আমি একটা সংযোগ খুঁজে পাচ্ছিলাম। তাই তখন থেকেই ক্যামেরা ট্র্যাপের ফর্মের মধ্যে দিয়ে বর্তমান ও অতীতের স্মৃতিকে ডকুমেন্ট করবার পরিকল্পনা শুরু করে দিই। 

কাউন্টার শটঃ দা লাস্ট ম্যানগো বিফোর দা মনসুন -এ জঙ্গলের এক জোরালো উপস্থিতি রয়েছে। ছবিতে দুজন সরকারী কর্মচারী বন্য জন্তুদের পর্যবেক্ষণের জন্য জঙ্গলে একটি ক্যামেরা লাগিয়ে আসে। এবং এরপর দুজনের অ্যাডভেঞ্চার ছাপিয়ে ক্যামেরার এক স্বয়ংক্রিয় অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। এই সিকোয়েন্সটি কীভাবে আপনার মাথায় এলো? 

পায়েল কাপাডিয়াঃ শোলা ট্রাস্ট ওয়েবসাইট ও আরো কিছু জায়গা থেকে পড়া এ অঞ্চলের জঙ্গলে হাতি আর স্থানীয় মানুষের সংঘর্ষের গল্পগুলো থেকেই আমার ছবির শুরু। প্রকৃতিকে রোমান্টিসাইজ করবার একটা ঝোঁক আমাদের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে সবথেকে হিংস্র শক্তি। প্রকৃতির এই বিভীষিকাকে ওই দুজন মানুষের মধ্যে দিয়ে আমি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। 

পোস্টারঃ দা লাস্ট ম্যাংগো বিফোর দা মনসুন

কাউন্টার শটঃ আপনার ভিডিও ফুটেজগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অ্যানিমেটেড শট রাখা হয়েছে, কখনো কখনো শটগুলোকে সুপারইমপোজ-ও করা হয়েছে, যা আমাদের অমিত দত্ত, মেহদি জাহান এবং আরো অনেকের সাম্প্রতিক কাজের কথা মনে করায়। এই নির্দিষ্ট ফিল্ম এবং এর থিম-এর সাপেক্ষে অ্যানিমেটেড শট ব্যবহার করবার কোনো বিশেষ নান্দনিক কারণ ছিল কি?

 
পায়েল কাপাডিয়াঃ
২০১৩-তে আমার সর্বপ্রথম ছবি ওয়াটারমেলন ফিশ অ্যান্ড হাফ ঘোস্ট থেকেই আমি ফিল্মে হাতে আঁকা ছবি আর অ্যানিমেশান ব্যবহার করা শুরু করি। এইভাবে ফিল্মে কাজ করা আমার পছন্দের। ফিল্ম এমনই এক মিডিয়াম, যেখানে বিভিন্ন ইমেজ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত- বিভিন্ন জিনিসের কোলাজ বুনতে বুনতে এক সম্পূর্ণতার দিকে পৌঁছানোর মতো। এটা অনেকটা কাঁথা বোনার মত, যেটা কিনা অনেকগুলো ছোটো ছোটো কাপড়ের টুকরো দিয়ে বোনা হয় যাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকে না, কিন্তু সবগুলো টুকরোকে একসাথে আনা মাত্র একটা বড়োসড়ো ছবি ফুটে ওঠে। 

কাউন্টার শটঃ শেষ এক দশক জুড়ে গোটা ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় যেসব ছাত্র আন্দোলনগুলো হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই উত্থানের প্রভাব নিয়ে আপনার ২০২১-এর ছবি আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং। উচ্চপদগুলির গেরুয়াকরণ, ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া, ভিন্নমত গ্রহণে অক্ষমতা এবং যেকোনো বিকল্প প্রতর্কের প্রতি আক্রমণের মতো বিষয়গুলি আপনার ছবি জুড়ে রয়েছে। আবার একইসাথে ছবিটির ন্যারেটিভ ভীষণ ব্যক্তিগত ও আন্তরিক। আমরা ছবিতে এত সব ঘটনা সম্বন্ধে জানতে পারছি ছবির ‘এল’ নামক চরিত্রের ভয়েসওভারের সূত্রে, তার চিঠিপত্র থেকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই বিশেষ সময়ের একটা প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সামনে।ঠিক কোন বিষয়টি আপনাকে ইতিহাস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিকে মিলিয়ে এই ন্যারেটিভ তৈরিতে উস্কানি দিয়েছিলো? 

পায়েল কাপাডিয়াঃ ২০১৬ থেকে আমি আর রণবীর(ছবিটির আলোকচিত্রশিল্পী ও সম্পাদক) এফটিআইআইকে কেন্দ্র করে  আমাদের রোজকার জীবন আর চারিপাশের বন্ধুবান্ধবদের শ্যুট করা শুরু করি। আমরা তখন ওখানেই পড়ছি। বেশীরভাগটাই আমাদের চেনা পরিসর বলে আমরা খুবই ক্যাজুয়াল এবং ইন্টিমেট পদ্ধতিতে শ্যুট করছিলাম। ছোট্ট একটা ক্যামেরা আর সাউন্ড রেকর্ডারের মধ্যে স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখছিলাম কিন্তু আদপে ছবিটা যে কি দাঁড়াবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই ডকুমেন্টেশানের মধ্যে দিয়ে সোচ্চার হচ্ছিলো আমাদের বন্ধুদের আর একটা উঠতি সময়ের স্বপ্ন, স্মৃতি আর ভঙ্গুরতার ইমেজ। 

এসবের বেশ কয়েক বছর পরে আমাদের অন্যান্য বন্ধুরা তাদের নিজের নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলা বেশ কিছু ফুটেজ আমাদেরকে দেয়। আমাদের মতোই ওরা জানতো না ওই ফুটেজগুলো নিয়ে ঠিক কি করা যেতে পারে। তখন উত্তাল সময়- সারা দেশ জুড়ে তখন প্রতিরোধ আর প্রতিবাদ মিছিল। কেবল জ্বলজ্যান্ত সময়কে খোদাই করে রাখবার তাগিদ থেকেই ওরা এই কাজ করছিলো। বন্ধুদের থেকে ধার করে, পরিবারের পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে এবং ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওগুলো থেকে আমরা এরকম আরো অনেক ফুটেজ খুঁজছিলাম। যেই সময়কে দেখতে দেখতে আর বাঁচতে বাঁচতে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম- ইমেজের পর ইমেজ জড়ো করে আমরা সেই সময়ের স্মৃতির আর্কাইভ তৈরি করে রাখছিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের তোলা ফুটেজগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো ওইগুলো ও যেন কোথাও থেকে ‘হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া গেছে’। এই সমস্ত আপাত সম্পর্কহীন ‘found footage’ সুলভ ইমেজগুলোকে জুড়ে আমরা একটি ন্যারেটিভ তৈরির দিকে অগ্রসর হতে থাকি। 

এই ‘found footage’ ফিল্ম বানানোর আইডিয়া নিয়ে আমার লেখক ও ফিল্মমেকার বন্ধু হিমাংশু প্রজাপতির সাথে যোগাযোগ করি। এফ টি আই আই তে আমরা একসাথে পড়তাম। আমাদের মাথায় একটা গপ্পো দানা বাঁধছিলো- যার মধ্যে এই আপাত সংযোগহীন ভিডিও ফুটেজগুলোকে একসূত্রে গাঁথা যায়। 

আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং(২০২১)

কাউন্টার শটঃ আমাদের মনে হয়েছে যে আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং -এ ইমেজ তৈরির টেক্সচার, ছবির টোন, ফিকশানাল ন্যারেটিভ দিয়ে নন ফিকশানাল ন্যারেটিভ গাঁথা- সমস্তটাই আপনার ছবি তৈরির আগেকার ঘরানার থেকে চোখে পড়বার মতো আলাদা। এই ছক ভেঙে বেরিয়ে আসাটা কি আপনার পূর্ব পরিকল্পিত নাকি ছবি বানাবার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হয়? 

পায়েল কাপাডিয়াঃ আগের ছবিগুলোর তুলনায় এই ছবিটার শৈলী অনেক অর্গ্যানিক ভাবে তৈরী হয়েছে। খুব সাধারণ ক্যামেরা আর অল্পসংখ্যক লোকজন নিয়ে শ্যুট করছিলাম বলে ইমেজগুলোয় একটা বিশেষত্ব দেখা দিচ্ছিলো। বিভিন্নজন তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এই ইমেজগুলো রূপ দিচ্ছিলেন, তাই থেকেই হয়তো স্টাইলটা এতখানি বদলে গিয়েছে।
ইদানিং ছবি বানানোর এই পদ্ধতিটা আমাকে ভীষণভাবে টানছে। হাইব্রিড একটা কিছুর ধারণা যেখানে ফিকশান ও নন ফিকশান খুব সহজে এসে মিশতে পারে- এই ভাবনায় আমি বেশ উত্তেজিত বোধ করছি।   

কাউন্টার শটঃ ছবির মধ্যে বিয়ের ভিডিও ফুটেজ রাখবার কথা আপনি কখন ভাবলেন? এটি কি ছবির চিত্রনাট্যের মধ্যেই ছিলো?

পায়েল কাপাডিয়াঃ সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কাছে শুরুতে কোনো চিত্রনাট্য ছিলো না- ফিল্মমেকিং এবং ছবি সম্পাদনার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ছবির গল্প এবং কাঠামো ক্রমশ একটা আকার নিচ্ছিল। CAMP আর্টিস্ট কালেকটিভের ওয়েবসাইট Pad.ma থেকে আমরা কিছু ৮মিলিমিটার ফিল্ম আর্কাইভের সন্ধান পাই। আমাদের বন্ধু মুকুলের যে স্বপ্ন আমরা রেকর্ড করেছিলাম- তার সাথে এই ফুটেজগুলো ভারী সুন্দর খাপ খাচ্ছিলো। তখনই ঠিক হলো এই সাউন্ড এবং ইমেজকে ছবিতে একসাথে মন্তাজের মতো করে ব্যবহার করা হবে।

কাউন্টার শটঃ এই ছবিতে আপনার ব্যবহার করা ইমেজের টেক্সচারটি আমাদেরকে খুবই নাড়া দিয়ে যায়। একদিকে, এই ইমেজগুলোর মধ্যে ১৬ মিলিমিটার ইমেজের একটা লুক রয়েছে- যা এককালের ৩৫ মিলিমিটার স্ট্যান্ডার্ড ফিল্ম লুকের প্রায় বিকল্প একটা অবস্থানে ছিল। বলা বাহুল্য এই অবস্থানটি যে রাজনৈতিক, যেভাবে দর্শনশাস্ত্রে রাজনীতি শব্দটাকে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে, অনেক ফিল্মমেকার(যেমন জোনাস মেকাস) এই টেক্সচারটি ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যক্তিগত মোড এর ছবি ‘ডায়েরী ফিল্ম’ বানাতে গিয়ে, যার সাথে আপনার ছবিটির এক ইন্টারেস্টিং যোগসাজশ রয়েছে। আবার ডিজিটাল আসবার পর আমরা হোম-ভিডিও লুক এর ইমেজে আকন্ঠ ডুবে রয়েছি- ইন্টারনেট ছেয়ে গিয়েছে এইসব ইমেজে। আপনি কি এগুলোর কোনোটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন? আপনি ঠিক কীভাবে ভাবছিলেন এবং যদি সম্ভব হয়- প্রোডাকশনের সময় কীভাবে এই ধরণের টেক্সচার তৈরি করেছিলেন, তা যদি একটু বলেন।   

পায়েল কাপাডিয়াঃ আমরা ১৯৬০ এর দশকের ফরাসি নিউ ওয়েভ ছবি এবং পুরোনো সোভিয়েত সিনেমা দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলাম।  বিশেষত ক্রিস মার্কারের ছবি! ওই ছবিগুলোর স্মৃতিকে উস্কে দেওয়ার জন্যই আমরা 1.33 আসপেক্ট রেশিও-এ গ্রেনি স্টাইলে ক্যাম্পাসের ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। এই স্টাইলটার একটা টেমপ্লেট তৈরি করতে রণবীর কিছু বেসিক ফিল্টার ব্যবহার করে। এরপর আমরা কালার গ্রেডার লিওনেল কপ এর সাথে কাজ করি। কপ একজন সত্যিকারের শিল্পী- চিত্রকারের মতো ওনার কালার গ্রেডিং। ওনার সাহচর্যে এই লুকটা আনতে অনেকটা সুবিধে হয় আমাদের। 

আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং (২০২১)

কাউন্টার শটঃ ফিল্মের কাঠামোটি খুবই আলগা- ইমেজের সিকোয়েন্স ঠিক কার্যকারণ সম্পর্ক মেনে তৈরি নয়। ‘L’-এর ভয়েস ন্যারেটিভটার মোটামুটি একটা কাঠামো দেয়। শব্দকে ভীষণই খোলামেলাভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়- শব্দে মিশে থাকে ঘন্টা, ঝিঁঝিঁ পোকা, হাওয়া, বৃষ্টি এবং দূরের বজ্রপাতের আওয়াজ। সাউন্ড ডিজাইনের এই ভাবনাটি কিভাবে আপনার কাছে এলো তা জানতে আমরা বেশ আগ্রহী। 

পায়েল কাপাডিয়াঃ যেসব শব্দ কেবল বর্ণনা করে তাদের থেকেও আমি সেইসব শব্দগুলোর সাথে কাজ করতে বেশী উৎসাহী যা মনের মধ্যে থেকে কোনো ভাবনা বা অনুভূতিকে উসকে দেয়। সাউন্ড ডিজাইন তৈরি করার সময় সাউন্ডের সাথে সর্বদা ইমেজের সামঞ্জস্য না থাকলেও আমরা চাইছিলাম সাউন্ডের যেন নিজস্ব একটা ন্যারেটিভ থাকে। আশা ছিলো মন্তাজের ফর্মের মতো এই আপাত সংযোগহীন সাউন্ড এবং ইমেজের ঘাতপ্রতিঘাতে দর্শকের মনে নতুন আরেক ইমেজ জন্ম নেবে।

কাউন্টার শটঃ ফিল্মটির বিস্তারের জন্য এফ টি আই আই-এর স্পেসটি ভীষণ জরুরি ছিলো। আন্দোলনের ফুটেজ, দেওয়াল-লিখন, স্লোগান, পোস্টার, গ্রাফিতি এবং সামগ্রিক স্পেসটির আবহ এই প্রজেক্টের মধ্যে গেঁথে থাকা এক ইউটপিক কল্পনাকে ব্যক্ত করে। প্রথমেই মাথায় আসে ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভের ইতিহাস- যার ইতিহাস এই স্পেসের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। এফ টি আই আই-কে নিয়ে এমন ফিল্ম বানানোর ভাবনা ঠিক কীভাবেএলো এবং কোন অভিজ্ঞতা আপনাকে এই প্রতিষ্ঠানের এমন নিবিড় পোর্ট্রেট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করলো এবং সেটা ঠিক কীভাবে- সেই নিয়ে যদি কিছু বলেন। 

পায়েল কাপাডিয়াঃ এফ টি আই আই-এর মতো স্পেস তৈরি করা হয়েছিলো যাতে দেশের যেকোনো মানুষ – কারোর আর্থিক, সামাজিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন – সে যেন ছবি বানানোর সুযোগ পায়। ছবিতে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। এফ টি আই আই এর একদম গোড়ার দিকের শিক্ষক ঋত্বিক ঘটকের ছবি এবং মতাদর্শও ফিল্ম স্কুলের মতাদর্শ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। এখানে পড়াকালীন, আমাদের ক্যাম্পাসকে ডকুমেন্ট করবার একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম। দিনের পর দিন চলতে থাকা স্ট্রাইক ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষটাকে এবং আমার রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তাকে ভীষণরকমভাবে বদলে দিয়েছিলো। যে স্পেসটা আমাকে এইভাবে বদলে দিয়েছিলো তার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে চেয়েছিলাম। আমাদের পাবলিক ইন্সটিটিউশানগুলো খোলামেলা চিন্তাভাবনা এবং মতবিরোধ করার মুক্ত পরিসর। অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এখানে নতুন ভাবনাচিন্তাকে ফুলের পাপড়ির মতো বেড়ে ওঠার সুযোগটুকু দেওয়া হয়- দেওয়া হয় প্রশ্ন করবার অবকাশ। হয়তো এই কারণেই এই স্পেসগুলোকে নিয়ে আমাদের সরকারের এতো ভয়! 

আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং (২০২১)

কাউন্টার শটঃ আপনার এরপরের প্রজেক্ট কি? ভবিষ্যতে কি আপনার ন্যারেটিভ ফিচার বানানোর ইচ্ছে রয়েছে, চৌথি কুট এর মতো কিছু একটা?

পায়েল কাপাডিয়াঃ হ্যাঁ, ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তে আমি একটি ফিকশান ফিল্মেরই কাজ করছি।  

কাউন্টার শটঃ প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং না থাকা সত্ত্বেও যেসব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকাররা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির ধাঁচার বাইরে ছবি বানাতে চান- তাদের জন্য আপনি কি পরামর্শ দেবেন? আমরা এই প্রশ্ন করছি কারণ আজকের দিনে ১৯৭০-৮০ এর মতো অল্টারনেটিভ সিনেমা নিয়ে চর্চার জন্য নিয়োজিত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সংগঠিত স্পেস নেই যেগুলো আমাদের নন মেন্সট্রিম, নন ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্প মাধ্যমগুলো সম্বন্ধে উৎসাহিত করতে পারে। আবার উল্টোদিকে, আমরা প্রতিটা সেকেন্ডে চারিদিক থেকে ইমেজের আক্রমণে যেভাবে জর্জরিত হয়ে আছি, তা আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে ক্রমশ অবশ করে দেয়। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে একজন আর্টিস্ট এবং ফিল্মমেকার হিসাবে কিভাবে আমরা বেয়াড়ারকমের ছকভাঙা, কল্পনাপ্রবণ এবং একইসাথে শুশ্রূষার ইমেজের প্রতি সংবেদনশীলতা বজায় রাখবো?

পায়েল কাপাডিয়াঃ আমি মানছি আমরা এখন সারাক্ষণ ইমেজ কনসিউম করে চলেছি। কিচ্ছু করবার নেই। বরং এই কারণেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকারদের উচিত আরো দৃঢ়ভাবে প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করবার। তবে প্রযুক্তির দিকটা সস্তা হয়ে যাওয়ায় আমরা অনেকখানি স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। খুব ভালো মোবাইল ফোন দিয়ে এখন আমরা ছবি বানিয়ে ফেলতে পারি। সুতরাং, সবথেকে জরুরি ব্যাপার হলো নিরন্তর অনুশীলনের মধ্যে থাকা এবং ছবি বানিয়ে চলা। যাই বানাবো তাই একটা সম্পূর্ণ ছবি হয়ে না উঠলেও দেখা যেতে পারে তাদের থেকে অন্য কোনো একটা কিছু হয়তো বেরিয়ে আসছে। সবসময় একদম শেষ টা ভেবে শুরু করাই ছবি তৈরির একমাত্র পদ্ধতি নয়! এই সূত্রে আমি সবাইকে গোদারের একটা প্রবন্ধ (https://www.diagonalthoughts.com/?p=1665 ) (এই প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ) পড়তে বলবো যেখানে রাজনৈতিকভাবে কী করে ছবি বানানো যায় সেই নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 

আর নন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ছবির রুচি তৈরি করার জন্য- প্রথমত, এই মুহূর্তেবিশ্বজুড়ে ফর্ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে এমন যাবতীয় ছবিগুলো দেখতে থাকো। বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভালগুলোতে ছবির তালিকা অনুযায়ী অনলাইনে সেই ফিল্মগুলোর খোঁজ করো বা ফিল্মমেকারদের কাছে তাদের ছবির লিংক চেয়ে চিঠি লেখ। ফিল্মমেকারদের সাথে কিন্তু চাইলেই যোগাযোগ করা যায়!

অন্যদিকে কেউ যদি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিদীপ্তভাবে মূলধারার ছবি বানাতে চাও- সেটাও খুবই শক্ত কাজ, কিন্তু এই সময় দাঁড়িয়ে জরুরি। এবং কেবল জরুরিই না-  কাজটা অনেক বেশী শক্তও কেননা এই ধরনের ছবি বানানোয় অনেকগুলো বিষয় একসাথে মাথায় রাখতে হয়। ছবিগুলো যেহেতু অনেক বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে- তাই এদের গুরুত্বও অধিক।  

এই কাজটিতে কাউন্টার শট-এর পাশে থাকার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়কে (কিউরেটর, theCircle)।

উপরের সাক্ষাৎকারটি মূল ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন এখানে / Click here to read the conversation in English

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s