হাওয়া : একুশ শতকের নতুন বাংলা ছবির সূচনাবিন্দু?

এতক্ষণে সবাই নিশ্চই হাওয়া (২০২২) ছবিটির কথা জেনে ফেলেছেন। নন্দনে পরপর শোয়ে রেকর্ড পরিমাণ ভিড় – ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজ অবধি নন্দনে কোনো ছবিতে দর্শকদের দীর্ঘ লাইন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এত বেশী পরিমাণ নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন পড়েছে বলে স্মরণকালের মধ্যে দেখিনি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সাধারণত নন্দন ১-এ প্রদর্শিত সব ছবির জন্যই লাইন পড়ে – কিন্তু তাই বলে সোমবার সকাল দশটার শো দেখার জন্য ভোর ছটা থেকে মানুষজন লাইন দিচ্ছেন – এমনটা বাংলা তো দূরের কথা, কোনো ছবির জন্যই কলকাতার বুকে হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। কলকাতার মানুষ দুহাত ভরে গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের ছবিটিকে  – যে কোনো সিনেপ্রেমীর জন্যই এ খুব আনন্দের বিষয়।

এ লেখায় আমি হাওয়া ছবিটির জনপ্রিয়তার রহস্য অনুসন্ধান করতে বসবো না, সে কাজে আমার চেয়ে যোগ্য মানুষ অনেক আছেন। আমি শুধু একটা বিষয়ে নজর ঘোরাতে চাইব। হাওয়া একটি বিশেষ ধরণের মূলধারার ছবি – যে ধরণের ছবিকে বিশ্বায়নপরবর্তী আন্তর্জাতিক মার্কেট মূলত ইন্টারনেটের সাহায্যে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলেছে। অর্থাৎ শোলে (১৯৭৫)কিংবা বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯)জাতীয় ছবি, যা একটা সময় পর্যন্ত উপমহাদেশের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের চেয়ে আকারে ইঙ্গিতে দৃশ্যে শব্দে হাওয়া ভীষণ, ভীষণ আলাদা। আত্মীয়তা যদি টানতে হয়, টানা যেতে পারে সমকালীন হলিউডি ছবির সঙ্গে, (ছবিটি দেখার পর প্রায় আমার সমবয়সী এক দর্শক তাঁর বন্ধুকে বলছিলেন, যেন হলিউডের ছবি দেখলাম) যে বিষয়ে পরে খানিক আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে। আপাতত ছবিটির অত্যন্ত জরুরী কিছু অর্জনের কথা বলা যাক। 

ছবিটি দেখতে বসে পশ্চিমবঙ্গের দর্শক হিসেবে সবার আগে যে কথা মনে হয় – ছবির ভাষার উপর এই মানের  দখল এই মুহূর্তে এপার বাংলায় মূলধারার কোনো চলচ্চিত্র পরিচালকেরই আছে বলে মনে হয় না। একটা গল্প – তাকে দৃশ্য আর শব্দের ভাষায় কীভাবে নির্মাণ করতে হয়, কীভাবে ঘটনার বুনোট জুড়ে জুড়ে সিঁড়ি ভাঙার মতো করে ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, কীভাবে কিছু মোটিফ বারবার ফিরিয়ে এনে মোক্ষম সময় মোচড় দিয়ে তাকে অর্থবহ করে তুলতে হয় – এসব কাজ হাওয়া-র নির্মাতারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করেছেন। ধরে নিচ্ছি পাঠকদের অনেকেই ছবিটি দেখেছেন – মনে করুন নৌকোর নোঙরটির ব্যবহার। শুধুমাত্র নোঙরের সঙ্গে ক্যামেরা জুড়ে জলের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার কারিগরি চমকই নয়, বরং ছবিতে বারবার নোঙর ফিরে আসে একটি মোটিফ হয়ে – মোটিফ অর্থাৎ কাহিনীর বুননে এমন কিছু উপাদান যা একাধিকবার ফিরে এসে গল্পের বুনোটকে শক্তিশালী করে তুলবে তো বটেই, সম্ভব হলে তা পাল্টে যাবে অর্থের দিক থেকেও। ছবিতে বারবার নোঙরটিকে দেখানো যে অকারণে নয় (যেমনটা এপারের নিরানব্বই শতাংশ ছবির বেলায় হয়) -, তা বোঝা যায় যখন ছবির শেষে নোঙর আলগা হয়ে গিয়ে জলের নীচের মাটির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে গোটা নৌকোটি, ফলত চরিত্ররা অনিবার্য ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। শৈলীর একটি উপাদানকে (নোঙরের ক্লোজ শট) এইভাবে ছবির অর্থের সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ – হাওয়া-র নির্মাতারা যা সার্থক ভাবে করেছেন। একই কথা বলা যায় ছবিটির মুখ্য এবং একমাত্র মহিলা চরিত্র গুলতির একটি নির্দিষ্ট কাজকে – সে যখন হাওয়ায় তার ভেজা শাড়ি শুকোতে দেয়। হাওয়ায় উড়ন্ত শাড়ির শটগুলি অর্থের দিক থেকে চরিত্রটির রহস্যময় সেনসুয়ালিটি, কাহিনীর পুরাণধর্মীতা এবং আঙ্গিকের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যথারীতি শেষে যার অনুপস্থিতি দৃশ্যমান হয় চাঁদের আলোয় প্রায় একই অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা অন্য একটি ছেঁড়া কাপড়ের ব্যবহারে। এরকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায় – কিন্তু আপাতত যা বলার – হাওয়া ছবিটি অত্যন্ত মুন্সিয়ানা এবং যত্নের সঙ্গে বানানো সমকালীন বাংলাভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলধারার কাজ। 

শুধুমাত্র আঙ্গিকগত সৌষ্ঠবই নয় – আমি নজর ঘোরাতে চাইব ছবিটির (এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছবির) দুটি বিশেষ দিকে। প্রথমত, হাওয়া জুড়ে রয়েছে এক বিশেষ ধরণের শারীরিকতা, যা বাংলা ভাষার সিনেমায় এত তীব্রভাবে চট করে উঠে আসে না। এখানে বলা প্রয়োজন – শারীরিকতা বলতে আমি যৌনতার কথা বলতে চাইছি না – নারী শরীরের খোলামেলা প্রদর্শনের সঙ্গে ছবির সাবালকত্বের হাস্যকর তুলনা করে কিছু বছর আগে বাংলা ছবি অবশেষে সাবালক হয়ে উঠল বলে দাবি করছিলেন কলকাতার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিরা। কিন্তু এত কিছু থাকতে হঠাৎ নারীর (প্রায়) নগ্ন শরীরই কেন সিনেমাকে রাতারাতি সাবালক করে দেবে, এর উত্তর তাঁরা কেউ দেননি। হাওয়া ছবিটির সাবালকত্বে এই ধরণের কোনো ফাঁকিবাজি নেই, বরং আছে দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ঠাভরে কাজ করে যাওয়ার প্রকাশ। প্রান্তিক মানুষের ইমেজ মূলধারার ছবিতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই হয়ে আসছে – কিন্তু টালিগঞ্জের বাংলা ছবির গা থেকে যে উগ্র শহরকেন্দ্রীক গন্ধ ছাড়ে, যা শুরু হয় সাউথ সিটির পারফিউম এবং শেষ হয় বৈঠকখানার বিয়ারের বোতলে (মাঝে মাঝে কেউ কেউ দাবি করেন গ্রাম দেখাচ্ছি, অতএব দারুণ ছবি বানালাম) – সেইসব আবর্জনার সামনে হাওয়া প্রান্তিক মানুষের শরীরের জ্বলজ্যান্ত, দগদগে রূপ প্রকাশ করে যা দর্শককে, আধুনিক চলচ্চিত্রতত্ত্বের ভাষা ধার করে বলা যায়, প্রায় visceral একটি অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। ইদানীংকালের পশ্চিবঙ্গের বাংলা সিনেমায় গ্রামে গিয়ে শহুরে অভিনেতারা অভিনয় করতে শুরু করলেই কী বিশ্রীরকম মেকি লাগতে শুরু করে, তা জানার জন্য ছবিগুলো একবার চালিয়ে দেখলেই হয়। হাওয়া ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী সহ জেলেনৌকার প্রত্যেক মাঝির চরিত্রে অভিনয় করা পুরুষ অভিনেতাদের শরীরী ভাষায় ফুটে ওঠে এই visceral অভিজ্ঞতার উপাদান। নিজেদের বাচন, কন্ঠস্বর, শরীরী ভাষা – সব মিলিয়ে অভিনেতারা তাঁদের সাধারণ নিয়মমাফিক শারীরিকতা ভেঙে দিয়ে ভিন্ন পরিসরের মানুষ হয়ে উঠতে চান। চলচ্চিত্রে বাস্তববাদ বলতে আমরা যা বুঝি, তারই নতুন এক ধরণের রূপ এই বিশেষ গোত্রের আঞ্চলিক বাস্তবতাবাদ – যেখানে নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল, তার মানুষ, তাদের ভাষা, বাচন-কে সিনেমা তার সমস্ত যান্ত্রিকতা অবলম্বন করে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু একই সঙ্গে তার এক পা দেওয়া থাকে অতিবাস্তব fable বা রূপকথাধর্মীতায়। বাস্তব এবং অতিবাস্তব জুড়ে থাকে হাত ধরাধরি করে – বাস্তবকে ছাপিয়ে যাওয়ার উপাদান হিসেবেই জমি প্রস্তুত করে সুক্ষ্ম, নিঁখুত ডিটেল সম্বলিত অঞ্চলের বাস্তবতা। সারা পৃথিবীর আন্তর্জাতিক ছবির মানচিত্রে এই ভিন্ন ধরণের বাস্তববাদী ছবি উঠে আসছে, যেখানে ধ্রুপদী বাস্তবতার যৌক্তিক কাঠামোর পরিবর্তে জরুরী হয়ে উঠছে এই ধরণের নিবেদিত আঞ্চলিকতা। আমরা আপিচাটপং ভীরাসেথাকুল কিংবা পেদ্রো কোস্তা জাতীয় পরিচালকদের ছবির কথা মনে করতে পারি (হাওয়া-কে এঁদের ছবির সঙ্গে তুলনা করছি না, কেন করছি না লেখার বাকি অংশ থেকে আশা করি বোঝা যাবে) – ভারতবর্ষেও অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রে গুরবিন্দর সিং, সানাল কুমার সশীধরণ, হাওবাম পবন কুমার-দের ছবির পাশাপাশি বাংলাদেশের বেশ কিছু ছবি, যেমন নোনাজলের কাব্য (২০২০)র কথা বলা যেতে পারে, যাঁরা এই ভিন্ন ধরণের বাস্তব ছবির গোত্রে আন্তর্জাতিক সিনেমার মানচিত্রে নিজেদের ঠাঁই করে নিয়েছে। এই গোত্রের মধ্যে হাওয়া কে ফেললে আশা করি খুব ভুল হবে না। 

দ্বিতীয়ত – বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে ছবিটির পরিসরের (স্পেস) ব্যবহার। পরিসর জিনিসটা সিনেমায় সবসময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ – ক্যামেরা/শব্দযন্ত্র দিয়ে যে মুহূর্তে এই পৃথিবীর ছবি/শব্দকে দেখা/শোনা শুরু হয়, সে মুহূর্তে চলচ্চিত্রে পরিসর বিষয়টি অন্য সমস্তকিছুর চেয়ে জরুরী হয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রের ইতিহাস সাক্ষী – চলচ্চিত্রভাষার বাঁকবদলের সঙ্গে নতুন ধরণের পরিসরকে দেখতে চাওয়ার ডিজায়ার এবং সেই অনুযায়ী ছবির ভাষাকে গড়েপিটে নেওয়ার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আমরা মনে করতে পারি ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম-র ধ্রুপদী উদাহরণকে, যেখানে স্টুডিও ছেড়ে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসপ্রায় শহরের পথে ক্যামেরা নেমে আসতেই ধ্রুপদী বাস্তববাদী আঙ্গিক থেকে পরিচালকদের হ্যাঁচকা টানে বের হয়ে আসতে হয়। আমরা মনে করতে পারি পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্যারিস শহর, যাকে নতুন ভাবে দেখার জন্য আগ্নেস ভার্দা – ফ্রাসোয়া ত্রুফো – জঁ-লুক গোদার – ক্লদ শ্যাব্রল – প্রত্যেকে নিজের নিজের চলচ্চিত্রের ব্যক্তিগতভাষা তৈরী করতে মনোযোগী হলেন। আমরা মনে করতে পারি লাতিন আমেরিকান সিনেমা, মনে করতে পারি ইস্ট ইউরোপিয়ান সিনেমা – এমনকি ইরানিয়ান নিউ ওয়েভের জগৎজোড়া খ্যাতির পিছনেও রয়েছে ইরানের শহরে-গ্রামে ক্যামেরা আয়েসে চলাচল করার মধ্যে দিয়ে নির্মাতারা যেভাবে ‘সিনেমাটিক স্পেস’ নামক আইডিয়াটিরই প্রতিসরণ ঘটান। হাওয়া ছবিটি নিজেকে যেভাবে সমুদ্রের মধ্যিখানে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়, তা শুধুমাত্র নির্মাণগত দিক থেকেই চ্যালেঞ্জিং নয় (মাথায় রাখতে হবে এটি জাহাজ নয়, নৌকা – আর চলচ্চিত্রনির্মাণের সামান্য অভিজ্ঞতা থাকলেও যে কেউ বুঝবেন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে শট নেওয়া, ক্যামেরাকে প্রায় জলের স্তরে নামিয়ে এনে ছবি তোলা কতখানি কঠিন একটি কাজ) – বরং সিনেমা এবং পরিসরের ধারণাটিকেই বেশ সম্প্রসারণ করে। একদিকে যেমন খোলা সমুদ্রের অসীম, অনন্ত বিস্তার – অন্যদিকে একই কারণে একটি মাত্র বোটে আটকে পড়ার ক্লসট্রোফোবিয়া – বিস্তার এবং বদ্ধতার এহেন যুগপৎ প্রয়োগ সিনেমার ভাষায় চট করে দেখা যায় না। ফরাসী দার্শনিক জিল দেল্যুজ সিনেমায় স্পেসের কথা লিখতে গিয়ে ‘any-space-whatever’ নামে একটি কনসেপ্টের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে পরিসর জিনিসটা কোনো নির্দিষ্ট অ্যাক্ট, কার্যকারণ সম্পর্কের বাইরে উন্মুক্ত শূণ্যতা হিসেবে বিরাজ করতে থাকে। অন্যান্য স্পেসের ধারণা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছু কিছু স্পেস স্বয়ংম্পূর্ণ হিসেবে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, যা কিনা, দেল্যুজের ভাষায়, “homogenous, de-singularizing space”। আমেরিকান দার্শনিক জেফ্রি বেল দেল্যুজের এই কনসেপ্টকে নিয়ে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন সিনেমার পর্দায় মেট্রো স্টেশন, ওয়েটিং রুম, এয়ারপোর্ট টার্মিনাল জাতীয় পরিসরের আধিক্যের কথা, যা কিনা “a nomadic place, a point of transit between places of importance”। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে অন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চলার পথে পড়ে থাকা জরুরী কিন্তু অর্থহীন পরিসর, যা কিনা মূলত নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিকতার অঙ্গ – দেল্যুজ একেই দেখান আন্তোনিওনির রেড ডেজার্ট জাতীয় ছবির পরিসরকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। হাওয়া ছবিতে এই যাত্রা – point of transit-এর ধারণাটি ভিন্ন মাত্রা পায় – নাগরিক পরিসর না হয়েও,  আক্ষরিক অর্থেই ছবিটি এক অনন্ত যাত্রার কথা বলে যার কোনো শুরু কিংবা শেষ নেই (যেখানে ছবিটিকে রূপকথা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টার সঙ্গেও জুড়ে দেওয়া যায়)। দেল্যুজের চিন্তায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল movement নামক ধারণাটি, যেখানে তিনি একটি বিন্দু থেকে অপর বিন্দুতে চলমানতার সময় বিন্দুর পরিবর্তে চলমানতার ধারণাটিকেই (the act of moving itself)  বেশী গুরুত্ব দিতেন। অর্থাৎ সাধারণ বুদ্ধিতে মুভমেন্ট বলতেই আমরা যেমন কতটা পথ পেরোলাম তার হিসেব কষতে বসি, দেল্যুজের ভাবনায় পথ পেরোনোর হিসেব আর মুভমেন্ট এক নয়। বরং মুভমেন্ট এই হিসেবের অতিরিক্ত একটি ক্রিয়া, যার থাকাটাই এই ‘moving itslef’কে ইঙ্গিত করে। হাওয়া ছবির সামুদ্রিক জলজ পরিসর (এক ফরাসী সমালোচক যাকে aquatic বলে উল্লেখ করেছেন) এই মুভমেন্টের ধারণার নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছবির অন্যতম প্রধাণ চরিত্র গুলতিকে ইবা যখন জিজ্ঞেস করে, সে যা বলছে তা সত্যি নাকি রূপকথার গল্প(কিসসা)? গুলতি বলে হ্যাঁ, এ তো কিসসাই। ছবির শেষ শটটি – যেখানে টপ অ্যাঙ্গেল থেকে নৌকোটিকে ভেসে যেতে দেখতে দেখতে যখন শুধু জল পড়ে থাক,  তারপর একই শটে ক্যামেরা মাথা তোলে, প্রত্যাশিত ভাবে নৌকোটিকে দূরে ভাসতে দেখার কথা – আমরা তা আর দেখতে পাই না। ছবির মাঝে মাঝেই যেমন সমুদ্রের বেশ কিছু অটোনমাস শট উঠে আসছিল – শেষেও নৌকোটি উধাও হয়ে গিয়ে শুধুমাত্র জল পড়ে থাকতে দেখা যায়। এহেন ‘অবাস্তব’ একটি দৃশ্যপটের ব্যবহারে একদিকে যেমন ছবিটির কিসসা হয়ে ওঠার পথ সার্থক হয় – অন্যদিকে তেমনই আখ্যানকে ধারণ করে রাখা ‘any-space-whatever’ সামুদ্রিক পরিসর, মাঝে মাঝে অটোনমাস হয়ে ওঠা সামুদ্রিক পরিসর ছবির শেষে আক্ষরিক অর্থেই একমাত্র স্বয়ংক্রিয় এজেন্ট হয়ে ওঠে। গন্তব্য বা সূচনা-শেষের বিন্দুর বদলে পড়ে থাকে শুধুই যাত্রা (movement) – আর যা কিনা ধারণ করে থাকে বিপুল এই দরিয়া। পরিসরের আখ্যান, এ ছবির নিরিখে দরিয়ার আখ্যান দরিয়ার মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। ছবিটিতে স্পেসের এই অত্যন্ত সার্থক ব্যবহার বিরাট এই দরিয়ায় মানুষের তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতার বোধকে আন্ডারলাইন করে এই গ্রহ, বিপন্ন জলবায়ু এবং সাধারণ মানুষের অসহায়তার মাত্রাকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়। 

কিন্তু এত কিছু অর্জন সত্ত্বেও কয়েকটি কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। হাওয়া ছবিটির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির স্পেকট্যাকল, যা উপমহাশের প্রাত্যহিক দৈনন্দিনতার একটি বড় অংশ। বলা বাহুল্য – ছবিটি এই উগ্র পৌরুষকে সমালোচনা করার জন্যই বানানো – সমুদ্রের মাঝে পুরুষ মাঝিদের নৌকোয় হঠাৎ একটি যুবতী মেয়ে উঠে পড়লে যে ধরণের গন্ডগোল হওয়া সম্ভব, তার সবকিছুই ছবিটি দেখাতে দেখাতে যায়। আমাদের উপমহাদেশ নাম না জানা হাজার হাজার নির্ভয়া আর আসিফার দেশ – এহেন পরিসরে, ছবির চরিত্র গুলতি নিজের মুখেই বলে, পুরুষের নারীশরীর ছিঁড়ে খেতে চাওয়ার চাহিদা শুধুমাত্র মেয়ে জন্মালেই টের পাওয়া যায়। শিল্পের পরিসরে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির সমালোচনা উঠে আসা নতুন কিছু না – দস্তয়ভস্কির ক্লাসিক সাহিত্য থেকে শুরু করে মার্টিন স্করসেসের ছবি ট্যাক্সি ড্রাইভার – ম্যাসকুলিনিটির সমালোচনাই কাজগুলির মূল উপজীব্য। এই ধরণের শিল্পকর্ম সাধারণত টক্সিসিটি বাড়াতে বাড়াতে অবধারিত উন্মাদনা আর ধ্বংসের পথে এগোতে থাকে। হাওয়া ছবিটির ক্ষেত্রেও আখ্যানগতি আলাদা কিছু নয়। কিন্তু – এখানেই জরুরী একটা কিন্তু – ছবির শেষ পয়তাল্লিশ মিনিট যেখানে আতঙ্কিত হয়ে হাত পা পেটের ভিতর ঢুকে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে (দুইবার নন্দন ১-এ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি) দর্শককুল বেশ উৎফুল্ল হয়ে হাততালি বাজাতে, সিটি মারতে থাকেন। নৌকাভর্তি লোক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে – এ দেখে যদি দর্শকের মজা লাগতে থাকে, তাহলে শুধুমাত্র দর্শককে দোষ দেওয়াটা বোকামি – বুঝতে হবে ছবির মধ্যেই একধরণের সেফ খেলার ইঙ্গিত আছে যা সীমানা নির্ধারিত বিনোদনের বাইরে নিজেকে নিয়ে যাওয়াটা খুব একটা সমীচিন বোধ করে না। এ লেখার শুরুতে ইন্টারনেট মারফৎ আন্তর্জাতিক সিনেমার বাজারের কথা বলছিলাম – সমকালীন হলিউডি সায়েন্স-ফিকশন থেকে থ্রিলার – সবকিছুই কমবেশী ডিস্টোপিক – ডিস্টোপিয়াকে একধরণের প্লেজারের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলার কাজ খুব সফলভাবেই হলিউড করে ফেলেছে। যা দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা দেখে হাসি পাচ্ছে (যেখানে ছবিটি কোনো অর্থেই কমেডি নয়) – এই বাস্তবতা এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মূলধারার ছবির নিশ্চিত ব্যবসায়িক সফলতার বাস্তবতা। হাওয়া-র ক্ষেত্রে নানান সম্ভাবনা ছিল, যা এই নিরাপদ প্লেজারের গন্ডী ছেড়ে অনেক দূর উড়ান দিতে পারত। কিন্তু যে কারণেই হোক (মূল কারণটা আন্দাজ করা কঠিন নয়) – নির্মাতারা এই গন্ডী অতিক্রম করতে আগ্রহ দেখাননি। 

অন্যদিকে আরেকটা জরুরী বিষয় – যা বিশ্বায়নপরবর্তী ছবির বাজার নিয়ে ভাবতে বসে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। আন্তর্জাতিক মূলধারার ছবি নিয়ে কথা বলছিলাম একটু আগে – সেখানে শুধুমাত্র হলিউড নয়, বরং এশিয়ার পূর্ব প্রান্তের একাধিক দেশের নাম করা যায় যাদের এই ধরণের ছবি বাঙালী সিনেফিলদের কাছে খুব জনপ্রিয়। হাওয়া  ছবিটিকে নিয়ে একটু ঠান্ডা মাত্রায় ভাবতে বসলে মনে হয়, বাংলা ভাষায় নির্মিত ছবির দুনিয়ায় নিশ্চই ছবিটি জরুরী একটি ইন্টারভেনশন – কিন্তু আন্তর্জাতিক ছবির মানচিত্রেও কি ছবিটি তাই? অবধারিত ভাবে সেই কূটতর্কটি উঠে আসে – জন্ম থেকেই কি সিনেমা একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যম নয়? লুমিয়ের ব্রাদার্স প্যারিসে ছবি দেখানোর এক বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে চলমান চিত্রের প্রদর্শনী শুরু হয়ে গিয়েছিল – একই সঙ্গে ছবি করছিলেন ডি ডবলিউ গ্রিফিথ এবং হীরালাল সেন, কয়েক বছর পরে, ঋত্বিক ঘটক এবং জঁ-লুক গোদার। তাহলে বাংলা সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এখনও কেন বারবার আমাদের বলতে হয়, ‘বাংলা’ ভাষায় এত ভালো ছবি হয়নি? ভাবটা এই – যেন বাংলা সিনেমা আন্তর্জাতিক সিনেমার চেয়ে বিচ্ছিন্ন একটি জগত, সেখানে নতুন কিছু করা মানেই সংশ্লিষ্ট ছবিটির কেল্লাফতে। ভারতবর্ষের ভার্নাকুলার এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার নির্মিত একটি ছবি – যা ভাষার ভৌগোলিক হিসেবেই ট্রান্স-ন্যাশনাল – তাকে কেন সবসময় আলাদা করে বিশেষ কিছু মাপজোক মেনে নিয়ে ভালো হয়ে উঠতে হবে? সন্দেহ নেই – এই প্রশ্নের মধ্যেই বাংলা সিনেমার সাম্প্রতিক দীনতার সংজ্ঞা লুকিয়ে আছে – তবুও – বারবার কেন আমাদের আঞ্চলিকতার গন্ডিতেই ছবির প্রশংসা করতে হয়? তাহলে হাওয়া জাতীয় ছবিতে যা দেখছি তা কি সিনেমার ভাষায় চেনা জিনিস, শুধুমাত্র মুখের ভাষাটা নিজের? লেখার শুরুতে উল্লিখিত ঐ তরুণী যেমন বললেন, বাংলা ভাষার হলিউডি ছবি? 

এর উত্তর এক্ষুণি দেওয়া সম্ভব নয় – আমরা প্রশ্নটাকে রেখে যেতে পারি মাত্র। তবে এই জাতীয় দুর্বলতা কিংবা অস্বস্তিগুলো মেনে নিয়েও বলতেই হয় – আপাতত হাওয়া  ছবিটি দুই বাংলা একসাথে জয় করে নিয়েছে। খুব শিগগিরি পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই ধরণের ছবি তৈরী হবে বলে মনে হয় না – (ব্যক্তিগত ভাবে আমার মত, মূলধারায় এইধরণের ইন্টারভেনশন করা ব্যতিক্রমী ছবি বানাবার চেয়েও বেশী কঠিন) এপারের নির্মাতারা আত্মতুষ্টির পাহাড়ে উঠে আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত আছেন। বাংলাদেশ আমাদের আরও বেশী করে এইরকম ছবি দিক। হাওয়া যেন পরিণতি নয়, বরং সূচনাবিন্দু হয়। 

তথ্যসূত্র

১) চলচ্চিত্রতত্ত্বে visceral শব্দটির ব্যবহার বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। মূলত সেই ধরণের স্পেকটেটোরিয়াল (দর্শকের) অভিজ্ঞতাকেই visceral বলা হয়ে থাকে যেখানে চলচ্চিত্রের ইমেজ, মূলত ভায়োলেন্সের মাধ্যমে দর্শকদের প্রায় শারীরিক সেনসেশন ঘটাতে থাকে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে লুই বুনুয়েলের বিখ্যাত ছবি আন শিয়েন আন্দালু (১৯২৯)-র কথা, যার চোখ কেটে নেওয়ার দৃশ্য প্রসঙ্গে আমেরিকান চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক স্টিভেন শিভারো এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর The Cinematic Body বইয়ের ৫৩ নম্বর পাতায় এই আলোচনা পাওয়া যাবে। 

২) “Any-space-whatever” নামক কনসেপ্টটি জিল দেল্যুজের সিনেমা সংক্রান্ত প্রথম বইতে আছে। 

Gilles Deleuze (2013), “The Affection-Image: Qualities, Powers, Any-Space-Whatevers”, Cinema 1: The Movement-Image. Bloomsbury Academic, page 115-138. 

জেফ্রি বেলের লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ফিল্ম-ফিলোজফি জার্নালে। 

Jeffrey Bell (1997) “Thinking with Cinema: Deleuze and Film Theory” Film-Philosophy 1.1 

৩) https://kinoculturemontreal.com/hawa/ এই লিংক থেকে রিভিউটি পড়া যাবে। 

৪) এই প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী-র স্টারডমের প্রশ্নটা জরুরী, যা এই লেখার মধ্যে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এক কথায় বলা যায়, ছবির শেষের দিকে দর্শকের উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করে মনে হয়, তা যত না ‘চান মাঝি’ নামক চরিত্রের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশী চঞ্চল চৌধুরী নামক স্টার-অভিনেতার জন্য – যেখানে তিনি দীর্ঘদিন কমেডি জাতীয় ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই প্রসঙ্গে সিনেমায় ন্যারেটিভ এবং স্পেকট্যাকল – এই দুই নিয়েই আলোচনা করা দরকার যা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s