বাংলাদেশের ছবি হাওয়া ও একটি উপকথার পুনর্কথন

এই শীতের মরশুমেও হাওয়া সত্যিই গরম। চতুর্থ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে হাওয়া (২০২২)  ছবিটি দেখতে নন্দনে উপচে পড়লো দর্শক। হলের বাইরে ঘন্টা চার পাঁচ ধরে লম্বা লাইন, কর্তৃপক্ষকে রিপিট শো এর আয়োজন করবার বন্দোবস্ত করতে বাধ্য করা- সম্প্রতি কোনো বাংলা ছবিকে ঘিরে এমন ঘটনা বিরল। কোভিডে, বাড়ির মধ্যে বসে থাকতে থাকতে আমরা যখন কম্পিউটার আর ল্যাপটপ থেকে মোবাইলের ছোট্ট চারকোণা ফ্রেমে সেঁধিয়ে গেছি, সিনেমা তখন আরো বেশী বেশী করে ওটিটি নির্ভর হয়ে গেছিলো। ওটিটির জন্যই ছবি তৈরি, ওটিটির মাধ্যমেই ছবি দেখা। একুশ শতকের ছবি নির্মাণ ও ডিস্ট্রিবিউশানের জন্য ওটিটিকে ব্যবহার করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনোরকম উন্নাসিকতা না রেখেও বলা যেতে পারে- ছবি মূলত বড়ো পর্দায় দেখবার জন্যই। সম্প্রতি কলকাতার ফিল্মস্কুল সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশান ইন্সটিটিউটের বড়ো পর্দায় সের্জিও লিওনির ক্লাসিকাল স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন ওয়ান্স আপোন এ টাইম ইন দা ওয়েস্ট (১৯৬৮) দেখবার অভিজ্ঞতা ছিলো অপার্থিব। ভিন্ন শহর থেকে আসা জিল (অভিনেতা ক্লদিয়া কার্দিনাল) রেলগাড়ি থেকে নেমে প্রবেশ করেন ওয়েস্টের প্রান্তরে- তাঁর ঘোড়াগাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে যায় মাউন্টেন ভ্যালির রাস্তায়… আর এনিও মরিকনের সুরের সাথে সাথে ক্যামেরা উঠে আসে এক্সট্রিম লং শটে। এই দৃশ্য একাধিকবার ডিজিটাল স্ক্রিনে দেখেও সেই মুগ্ধতা হয়নি, যে মুগ্ধতা হয়েছিলো ওই পর্দাজোড়া অসীমের সামনের বসে। আমি বলতে পারি হারমোনিকার মুখের ভাঁজে থাকা প্রতিশোধের আগুন অথবা একটি শিশুকে হত্যা করবার ঠিক আগের মুহুর্তে হিংস্র হেনরি ফন্ডার থুতু ফেলার এক্সট্রিম ক্লোজ আপ যে দ্যোতনায় সেদিন বুকের মধ্যে হাহাকার ফেলেছিলো- তা কখনোই ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে সমানুপাতিক না। এখন এই কথা বলামাত্র পাঠক ভাবতে পারেন টেলিভিশান ফিল্ম বা আমাজন প্রাইমে রিলিজ পাওয়া ওয়েবসিরিজের চাইতে হল রিলিজ পাওয়া ছবির প্রতি একধরণের পক্ষপাতিত্ব করছি আমি। এমন মনে হওয়া অসঙ্গত না। তবে এক্ষেত্রে আমি বলতে চাইবো, কথাটা পক্ষপাতিত্বের নয়, কথাটা হলো অভিজ্ঞতার তারতম্যের। হলের সমস্ত আলো নিভে গেলে সামনের বিপুল পর্দায় যখন ছবি চলতে শুরু করে- আর শব্দে গমগম করতে থাকে চারপাশ, সিনেফিলরা জানেন- এই রোমাঞ্চ অপরিসীম। ঘরের এককোণে বসে কানে হেডফোন গুঁজে ছোটো স্ক্রিনে এই রোমাঞ্চ বোধ হয় সম্ভব না। সম্ভব হলে আরো মাসখানেক অপেক্ষা করে বাংলাদেশের এই ছবি বাড়িতেই দেখে নিতেন দর্শকেরা, ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে লাইন দিতেন না। হাওয়া-র সমস্ত দর্শক একবার ভেবে দেখুন তো, ঐ সুবৃহৎ সমুদ্দুর ও মাঝদরিয়ায় একদল মাঝি আর একজন রহস্যময়ী মহিলাকে ঘিরে তৈরি হওয়া গপ্পো থামিয়ে থামিয়ে মোবাইলের মধ্যে দেখলে কি এই একই শিহরণ হতো আমাদের? যদিও সিনেমা হলের যৌথ স্পেকটেটারশিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি এক্ষেত্রে বাদ রাখা হলো।

তবে যে ভয়ঙ্কর সময়ে একপ্রকার নিরুপায় হয়েই আরো বেশী ওটিটি নির্ভর হয়ে পড়েছি আমরা- হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেঁধিয়ে গিয়েছি ছোট্ট স্ক্রিনে, ঠিক সেইসময়েই সমুদ্রের মাঝখানে নৌকা করে পৌঁছে হাওয়া ছবির শ্যুট চলছে। সালটা ২০২০- কোভিডের জন্য তখন বড়ো হলে ছবি আবার আগের মতো করে ফিরবে কিনা এ নিয়ে অনিশ্চিত অনেকেই। সেই অনিশ্চিত অসহায়তার মধ্যে মেজাবুর রহমান সুমন কি অপরিসীম আত্মবিশ্বাসে বড়ো পর্দার এই ছবির কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন… সুদক্ষ অভিনেতা ও ছবির সাথে যুক্ত থাকা অন্যান্য সিনেশিল্পীদের নিয়ে কক্সবাজার থেকে পাড়ি দিয়ে ফেলেছিলেন মাঝদরিয়ায়। 

অভিনেতাদের নানান সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়, প্রায় ৪০-৪৫ দিনের একটানা শ্যুট ছিলো এই ছবির। এবং বেশীরভাগ শুটিংন-ই মধ্য সমুদ্রে- নৌকার মধ্যে। একজন বাদে ছবির চরিত্রদের প্রত্যেকেই যেহেতু মাঝি, তাদের মেক আপ-ও সেইভাবেই প্রয়োজন ছিলো। ট্যান পড়ে যাওয়া চামড়া- পান খেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত -ধুলোবালি মাখা অপরিষ্কার ত্বক ইত্যাদি। জানা যায়, প্রথম কদিন অভিনেতাদের চেহারা জেলে চরিত্রদের চেহারার মতো করবার জন্য দুই তিন ঘন্টা মেক আপের প্রয়োজন হতো। তবে ওই পরিবেশে একটানা থাকতে থাকতে তাদের শরীর ও ত্বক ক্রমশ অমনটাই হয়ে যায়।  দীর্ঘ সময় ধরে মেক আপ আর প্রয়োজন হয়নি অনেকেরই- অল্প মেক আপ বা প্রায় মেক আপহীন ভাবেই শ্যুট করতে পারতেন অভিনেতারা। এই ছবির জন্য অনেকটা মেথড অ্যাক্টিং এর মতো করে অভিনেতাদের ট্রেন করা হয়। শ্যুট শেষ হয়ে গেলেও সেটে তাদের নিজ নিজ চরিত্র হয়েই থাকতে বলা হতো। একটানা মাঝদরিয়ায় পড়ে থাকতে থাকতে তাদের শরীরের রং, শরীরী ভাষা এবং গলার স্বর ক্রমশ বাস্তবের মাঝিমাল্লাদের মতোই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে। চঞ্চল চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় অভিজ্ঞ এই অভিনেতাকে তাঁর নিজস্ব স্টারডম থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলেন পরিচালক। কেবল তাই নয়- শ্যুট শেষের পরে বাকি সময়টাও যাতে তিনি অন্যান্য মাঝিদের মতো করেই বোটের সকলের সাথে থাকেন এমন কড়া নির্দেশ ছিলো পরিচালকের। এই ছবিতে স্টারডম ও তার রিসেপশান নিয়ে কিছু ভিন্ন বক্তব্য আছে আমার, তা অন্য আরেকটি প্রবন্ধে খোলসা করে বলবার ইচ্ছা রয়েছে। তবে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী যে পরিচালকের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তা বলাই বাহুল্য।

একটি মাছধরা নৌকা, তাকে ঘিরে একদল মাঝি ও মাছের জালে ধরা পড়া একটি মেয়ের গল্প হাওয়া। নৌকা ক্রমশ মাঝদরিয়ায় এগোতে থাকে এবং একের পর এক রহস্যময় জটিলতার সম্মুখীন হতে থাকে মাঝিরা। হাওয়া র গল্প এটুকুই। যদিও এটুকু বলা হলে কিছুই বলা হয়না- কারণ যেকোনো শিল্পেই কি বলা হচ্ছে- তার সাথে, কিভাবে বলা হচ্ছে- এই বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। মাঝসমুদ্রে কেবল এক নৌকাকে ঘিরে তৈরি হওয়া মূলধারার কাহিনী যে এতোটা নিপুণ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে বাংলা ভাষায় বলা যেতে পারে- তা বাংলাদেশের ছবি না দেখে থাকলে কলকাতার বাঙালি হয়ে বিশ্বাস করাটা খানিক কঠিন হতো। মেজবুর রহমান সুমন ও টিমের প্রত্যেককে বাঙালি সিনেফিলদের আশ্বাস যোগানোর জন্য অভিনন্দন। অভিনন্দন বাংলাদেশ ফেস্টিভাল কর্তৃপক্ষকেও- কলকাতায় বসে নিজের ভাষায় এমন বিশ্বমানের পপুলার ছবি দেখবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।  

মাঝিমাল্লাদের জীবনে মিথ বা উপকথা একটি অত্যন্ত জরুরী উপাদান। বলা যেতে পারে তাদের জীবনকে কেন্দ্র করে থাকে এই মিথ। মিথ তাদের কাছে কেবল মিথ ই নয়- তা বিশ্বাসযোগ্য সত্য। তাদের দুনিয়ায় ডাঙার নিয়ম খাটেনা। সমুদ্রের মাছধরা নৌকায় মেয়ে মানুষ ওঠা নিষেধ- উঠলে বিপদ হয় এমন বিশ্বাস কক্সবাজারের জেলেদের। তাই নৌকায় একজন মহিলা জল থেকে উঠে আসার পর থেকেই বোঝা যায় বিপদ আসন্ন, সবকিছু আর আগের মতো মসৃণ থাকবে না। মিথে যা বলা আছে- তা খাটতে বাধ্য, তার অন্যথা হবেনা কিছুতেই। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত থাকা মিথ একধরণের জনজাতির জীবনের অংশ হয়ে যায়। তারা এই মিথকে পরম্পরা ধরে এমনভাবে বিশ্বাস করতে থাকে যে তাদের ধারণাবিশ্বে বাস্তব আর মিথিকাল এলিমেন্টের কোনো পার্থক্য থাকে না- তারা পরস্পরের সাথে মিলেমিশে থাকে ওতপ্রোতভাবে। এই প্রসঙ্গে হিমাচলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের অভিজ্ঞতা বলতে ইচ্ছে করে। মূল শহর থেকে অনেক উপরে এক বিস্তীর্ণ ধূ ধূ ভ্যালির উপর চুপচাপ বসে আছি- দূরে পাইন বার্চের সারি। এমন সময় দূর থেকে এক বছর বারো তেরোর মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে এগিয়ে আসে, আঙুল দিয়ে দেখায় পাহাড়ের ওই ঢালের এক ঝর্না। অনেক দূরের ঐ ঝর্নাকে কেমন সাদা সরু সুতোর মতো লাগছিলো- অদ্ভুত রহস্যে তা আমাকে আকৃষ্ট করায় তাকে বললাম ওখানে নিয়ে যেতে। তা শুনে মেয়েটি আঁতকে উঠে জানায়, এখন মাঝদুপুর, যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে, তাই সে এখন যাবেনা। আমি অবাক হয়ে তাকাতে মেয়েটি জানালো ওখানে বিকেলের পর থেকে স্বর্গের পরীরা স্নান করতে আসে, তাই সেই সময় ওখানে যাওয়া নিষেধ- গেলে বিপদ হয়। শহরে ফিরে এই গল্পকে বেশ অবিশ্বাস্য মনে হলেও শহর থেকে কয়েকশো মাইল দূরে ভ্যালির ওই ধূ ধূ প্রান্তরে সেদিন বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিলো। ওই জায়গায় বসে সমস্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তিক্রম ছাপিয়ে এক লহমার জন্য হলেও এই মুখে মুখে ফেরা কিসসাকে সত্যি বলে মনে হয়েছিলো। সাহস পাইনি আমি সেদিন একা একা ওই ঝোরার প্রান্তে যাওয়ার। এইরকম নানান গল্প, উপকথা, কিসসা ও মিথ আমাদের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। একেকটি অঞ্চল ও তার আদি বাসিন্দারা যেমন মিথগুলোকে সৃষ্টি করেছে- আবার বছরের পর বছর ধরে এই মিথই নির্মাণ করে রেখেছে জনজাতির বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর, ধারণ করেছে তাদের অঞ্চলের ইতিহাস। সুতরাং জালে মাছের পরিবর্তে একজন জ্যান্ত মহিলা ওঠা মাত্রই বুঝতে পারা যায় ন্যারেশানটিকে আর বাস্তবের প্যারাডাইমে দেখলে চলবে না। ন্যারেশানটি ততক্ষণে মিথ হয়ে গিয়েছে বা মিথ এসে ভর করেছে ন্যারেশানের অন্দরে। একদিকে মধ্যসমুদ্রে পড়ে প্রাণে বেঁচে থাকা অসম্ভব- অপরদিকে, নৌকায় মেয়েমানুষ অর্থাৎ বিপদ অবশ্যাম্ভাবী। সুতরাং নৌকায় মহিলা চরিত্র গুলতির আবির্ভাবের পর থেকেই বোঝা যায় ন্যারেশানটি ক্রমশ বাস্তব থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, যেমন তীর থেকে ক্রমশ দূরদূরান্তের সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে নৌকা- আর গল্পটি রিয়েলিটির পরিসর থেকে বেরিয়ে ক্রমশ ফ্যান্টাসির দিকে এগোচ্ছে- এগোচ্ছে রূপকথার দিকে। নৌকাটি ক্রমশ দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে সমুদ্রের গভীরে চলে যেতে থাকবে- আর আস্তে আস্তে রিয়েলিটির সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে গল্পটি রূপকথার হয়ে উঠবে, মিথ এসে ক্রমশ গ্রাস করে নিতে থাকবে বাস্তবের চরিত্র ও প্রেক্ষাপট।

এখানে মনে রাখা দরকার যেকোনো রূপকথার গল্পই কিন্তু আগে থেকে আমাদের জানা থাকে। ঘুমন্তপুরীতে থাকা রাজকন্যাকে উদ্ধার করবে যে রাজপুত্তুরই- এ সকলেরই জানা। তাও অপেক্ষা কেবল কীভাবে উদ্ধার করবে সেই নিয়ে- কতো জঙ্গল পাহাড় সমুদ্র নদী পেরিয়ে কতো দৈত্য দানোর সাথে কঠিন লড়াই করে রাজকুমার এসে নিয়ে যাবে কন্যাকে- তা জানতেই উদগ্রীব হয়ে থাকে রূপকথার পাঠক। পাঠক জানেন, রাজপুত্তুর জিতবেই- তবু মনে হয় তার রাজকুমারীকে উদ্ধার করবার বিজয়গাথা প্রত্যেকবার নানারকম ভাবে দেখি, শুনি, পড়ি। অর্থাৎ রূপকথা বা কিসসায় শেষে কি ঘটছে তা জানা থাকে বলেই আগ্রহ বেশী থাকে কিভাবে ঘটছে তার ওপর- রোমাঞ্চও সেখানেই। সমস্ত বাধা পেরিয়ে যখন রাজকন্যা ও রাজপুত্তুরের ‘and they lived happily ever after’ এ এসে পৌঁছাই আমরা- বইয়ের পাতা বন্ধ করি দিই  অথবা সিনেমাহলের পর্দায় নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার।

এক তুমুল বৃষ্টিবাদলার রাতে মাঝিদের জালে ওঠেন এক সুন্দরী মহিলা। প্রথমে তাকে মৃতদেহ ভেবে ভুল করলেও পরে বোঝা যায় সে জীবন্ত একজন মানুষী। এইখান থেকেই ন্যারেশান ক্রমশ কিসসায় প্রবেশ করতে থাকে। মহিলাটি যে ঠিক বাস্তবের চরিত্র নয় তা শুরু থেকেই স্পষ্ট রেখেছেন পরিচালক। সেই কারণেই অন্যান্য চরিত্রদের নোনা জলে, সমুদ্রের রুক্ষ হাওয়া আর কাঠফাটা রোদ্দুরে ত্বকের পালিশ, চুলের পেলবতা নষ্ট হয়ে গেলেও মহিলা চরিত্র গুলতির চেহারা থাকে একেবারে অপরিবর্তনীয় ও আলাদা করে চোখে পড়বার মতো সুন্দর। সে যে ঠিক বাস্তবের নারী নয়- রিয়েলিজমের সংজ্ঞায় তাকে ধরা যাবেনা, তা তার প্রথম অ্যাপিয়ারেন্স থেকেই খোলসা করে দিয়েছেন পরিচালক। ক্রমশ একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে যাতে করে তার অতিমানুষী অস্তিত্ব স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। একসময় বোঝা যায় সে নৌকায় এসছে এই নৌকা ডোবাতে এবং নৌকার চান মাঝিকে মারাই তার মূল লক্ষ্য। পিছনে রয়েছে পিতৃহত্যা ও তাকে কেন্দ্র করে এক দীর্ঘ প্রতিশোধের গল্প। বেদের মেয়ে গুলতি- প্রতিশোধের আগুনে তার দুই চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। দর্শক হিসাবে মনে হতে থাকে এ গল্প যেন খুব চেনা। বিশেষত গুলতি যখন মাঝসমুদ্দুরের মাঝে তার মৃত প্রেমিককে জড়িয়ে শুয়ে থাকে- আর বড়ো বড়ো ঢেউ এর আঘাতে ভেসে যায় ভেলা… স্পষ্ট হয়ে ওঠে বেহুলা লখিন্দরের রেফারেন্স। অদ্ভুতভাবে চান মাঝির সাথে চাঁদ সওদাগরের নামটি রেসোনেট করায় এই রেফারেন্স আরো জোরদার হয়। মেজবুর রহমান সুমন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে চান মাঝির সাথে ঠিক সাতজন জেলেকে রেখেছেন যারা একে একে বিবিধ দুর্ঘটনায় মারা পড়েন। ভেবে দেখুন- চাঁদ সওদাগরের সাত ছেলেকে একে একে জাহাজ ডুবিয়ে মেরেছিলেন মনসা দেবী। মিথ- হয়ে ওঠে আরো প্রাসঙ্গিক। ছবির চরিত্র ইবা যখন গুলতিকে ছবির মধ্যেই জিজ্ঞাসা করে- “এটা কি কিসসা?”, গুলতি উত্তর করে- “হ”। গুলতির কথার সূত্রে আসে ভীষণ রাগী এক দেবীর কথা, বেদেনিদের কথা, সাপেদের কথা। উল্লেখযোগ্য এই- হাওয়া ছবিটি কিন্তু কখনোই কোনো একটি বিশেষ টেক্সটের এডাপ্টেশান হয়ে উঠতে চায়নি, বরং অত্যন্ত সুচতুরভাবে গল্পের অবতলে রেখে দিয়েছে মঙ্গলকাব্যের রেফারেন্স। উপকথা বা ফেয়ারিটেল এ যেমন কি কি ঘটবে তা গল্পের শুরু থেকেই একরকম জানা থাকে মানুষের- তেমন এই গল্পের পরিণতি যে কি তা একটা সময়ের পর স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে মাঝিমাল্লারদের মিথ। সমুদ্রের যে মিথ ঘিরে থাকে তাদের- তাই সাপের লেজের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চরিত্রদের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। আমরা জানি মৃত লখিন্দরকে নিয়ে ভাসতে ভাসতে দেবতাদের নাচেগানে সন্তুষ্ট করে তার প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন বেহুলা। ছবির শেষ শটে গুলতি তার মৃত প্রেমিকের দেহ জড়িয়ে থাকে আর নৌকা ভেসে যায় ঢেউ এর ধাক্কায়। এরপর হয়তো প্রেমিক প্রাণ ফিরে পাবে- শান্ত হবে মনসার রাগ। চান মাঝি আর কারোর সাথে বদমেজাজ দেখাবেন না, অনুগত থাকবেন দেবীর। নাঃ, হাওয়া-তে এমন কিছুই আর বলা নেই। তবে পর্দা অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর এইটে আমরা ভেবে নিতেই পারি- এইটে ঘটতেই পারে পর্দার রিয়েলিজমের বাইরের স্পেসে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান চিত্রনির্মাতা মেজবুর রহমান সুমন দর্শকদের জন্য, কিসসার শ্রোতাদের জন্য সেই কল্পনার স্পেস দিয়ে গেছেন ছবির শেষ দৃশ্যের মিজ-অন-সিন এ।    

এখন এই মিথের রেফারেন্স স্বরূপ মিজ-অন-সিন এর ব্যবহার বারংবার দেখা গেছে সারা ছবিটি জুড়ে। গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়বার পর গুলতি সমুদ্রে ডুব দিয়ে আসে। স্নান শেষে সে তার ভিজে শাড়ি মেলে দেয়, পা দুলিয়ে দূর সমুদ্রের দিকে চোখ মেলে থাকে সে। আর সমুদ্রের হাওয়ায়, বোটের মেদুর আলো আঁধারিতে ভাসতে থাকে তার লম্বা শিফনের শাড়ি। শব্দে একধরণের আনক্যানি- যা থিম মিউজিকের মতো বারংবার ফিরে আসে গুলতির নানান  অ্যাপিয়ারেন্সেই। ক্যামেরা লং শটে দেখতে থাকে এই দৃশ্য। চুল মেলে নৌকার উপরে বসে আছে সুন্দরী এক কন্যা- প্রবল হাওয়ায় উড়ছে তার সদ্য মেলা গোলাপি কাপড়। মাঝদরিয়ায় আকাশ আর দরিয়ার ঘননীল মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এমন এক মিজ-অন-সিন এর নির্মাণ বা এই বিশেষ ইমেজটি রূপকথার গল্পের দ্যোতক হয়ে আসে। রূপকথার রাজকন্যার এই আইকনোগ্রাফির ব্যবহার গুলতির চিত্রায়ণে বারংবার ফিরে এসছে। বিভিন্ন সময় ক্যামেরা গুলতিকে এমনভাবে ফ্রেম করেছে, যাতে করে তার চরিত্রের মধ্যে থাকা ফেয়ারিটেল এলিমেন্টগুলি প্রকট হয়। মিথের রেফারেন্স হয় আরো স্পষ্ট। 

ন্যারেশান থেকে গুলতি একসময় উধাও হয়ে যায়। তার সশরীর উপস্থিতি আর টের পাওয়া যায়না। তবে তার অন্তর্ধানের পরেও সে যে অশরীরে ন্যারেশানের একেবারে কেন্দ্রেই রয়ে গেছে এবং মিথের নিয়মমতো ন্যারেশানকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তা ছবিটির কিছু মিজ-অন-সিনে অত্যন্ত সুচতুরভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সূত্রে আমি দুইটি মিজ-অন-সিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করবো। বোটের ঘটনাক্রম যখন ক্রমশ অস্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিকতর বা bizarre হতে থাকছে- ক্যামেরা কয়েকবার বোটের উপর থেকে সোজা চলে যায় বোটের অবতলে।
১। বোটে আর গুলতি নেই, কিন্তু বোটের নীচে সমুদ্রের মধ্যে ভাসছে বোটে আটকে পড়া ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। তা ঠিক কিভাবে ওইখানে আটকে পড়লো তা সঠিকভাবে বোঝা না গেলেও এই দৃশ্য হাওয়ায় উড়তে থাকা গোলাপি শাড়ির মিজ-অন-সিন কে মনে করায়। ২। নৌকার উপরে জটিল অলৌকিক ঘটনাক্রম চলছে। ইতিমধ্যে, রাতেরবেলা ঠিক নৌকার নীচেই ঘুরতে দেখা যায় একটি বড়ো মাছকে। মাছটি আর কোথাও যায়না- নৌকাটিকে আবর্তন করে তার চারিপাশেই ঘুরতে থাকে। এই মাছই যেন নৌকার ঘটনাক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। সাউন্ডে শোনা যায় সেই আনক্যানি মিউজিক। এই দৃশ্য ও শব্দ নির্মাণ দর্শককে মনে করিয়ে দেয় রূপকথার গুলতির কথা- যে মাছ হয়েই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলো।

রূপকথার এই ভীষণ নায়িকা হঠাৎ করে যেমন এসেছিলো, তেমন হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় একদিন। তবু তার স্মৃতি আচ্ছন্ন করে রাখে ন্যারেটিভকে।

মিথের প্রসঙ্গে এতো কথাই যখন হলো, তখন এই সূত্রে আরেকটি ছোট্ট সমালোচনার প্রসঙ্গ এনে লেখাটির শেষ টানা যাক। মিথ বা পুরাকথা তো প্রচলিত কথা- মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানের মতো। অর্থাৎ, মিথ এর মূল গল্প আমাদের সকলেরই জানা। জানা বলেই একই গল্পের পুনর্কথন এতো উদ্বেলিত করে আমাদের। একই গাথা বারবার শুনতে ইচ্ছে করে- প্রত্যেক পুনর্কথনে উন্মোচিত হয় নতুন পরিসর। এখন চেনা গল্প বা চেনা কিসসা যদি মিথ এর কেন্দ্রে থাকে- তাহলে বোঝাই যাচ্ছে আসলে এই গল্প আছে একটি জনজাতির কালেকটিভ আনকসাস[1] এ। এক যুবার বাঁশির আওয়াজে রাতের আঁধারে উন্মত্ত কোনো যুবতী যদি ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যায়- ভারতীয় পাঠকদের স্বভাবতই মনে আসবে রাধা কৃষ্ণের রেফারেন্স। একইভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এরকম আরো কতো কতো মিথ। লায়লা-মজনু, শিরিন-খসরু, রাম-সীতা অথবা ত্রিস্তান-ইসল্টে। মিথ অর্থাৎ যে গল্প চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিতে হয়না প্রতিবার- বরং, এই গল্প এক জনজাতি বা পরিসরের কালেক্টিভ স্মৃতিতে আছে বলে সামান্য রেফারেন্সেই এর আঁচ পাওয়া যায়। সমুদ্রে, জেলেদের মহল্লায় এমন অনেক মিথ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এইসব মিথগুলি আঞ্চলিক। হাওয়া এমনই একটি মিথকে কেন্দ্রে রেখে গঠিত যেখানে মাছ হয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসে এক মেয়ে- তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। মেয়েটি বোটে আসবার পর থেকেই যে আবহাওয়া খানিক অস্বাভাবিক- এমনটা ছবির শুরু থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিলো। ছবির মিজ-অন-সিন, দৃশ্যগঠন- সমস্তটার মধ্যেই যে মিথিকাল এলিমেন্ট প্রকাশ পাচ্ছিলো তা শুরুর পর্বেই ব্যাখ্যা করেছি। বহু সমালোচক (এই সূত্রে আনন্দবাজার পোর্টালের একটি লেখা উল্লেখযোগ্য[2]) সমুদ্রের মাঝে গুলতির পরিপাটি চেহারা, লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট ও কাজলের সমালোচনা করেছেন। সমালোচকের মতে, সমুদ্রের মাঝখান থেকে উঠে আসা গুলতির এই মেক আপ অস্বাভাবিক। কিন্তু গুলতি তো বাস্তবের চরিত্র নয়। প্রথম থেকেই চিত্রনির্মাতা স্ক্রিনে তার বেশভূষার নির্মাণ দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গুলতির পরিপাটি সৌন্দর্য- তার তাকানো- পোশাক পরিচ্ছদ আর তাকে কেন্দ্র করে মিজ-অন-সিন এর নির্মাণ- এই সমস্তকিছুর মধ্যেই চিত্রনির্মাতা সাজিয়ে রেখেছেন রূপকথার উপাদান। তবে এই সাজানো অত্যন্ত নুয়ান্সড(nuanced), যাতে দর্শকের স্মৃতিতে হানা দেয় এই যোগসূত্র – সরাসরি তার উল্লেখ না করে দিয়েও। আমার মতে গুলতির পিতৃহত্যার স্মৃতি ও সেই সংক্রান্ত প্রতিশোধের গল্প সংলাপে সরাসরি না বলে দিয়ে তাকে ন্যারেটিভের মধ্যে আরেকটু আড়াল করে বলা যেতে পারতো। সেক্ষেত্রে দর্শকেরই অবকাশ থাকতো সেই আড়াল থেকে তাকে আবিষ্কার করবার। গুলতির রহস্য ও তার অতীতের সমস্তটা তার মুখ দিয়ে বলানোর জন্য গল্পের বাঁধুনি খানিক দুর্বল হয়ে যায়। মিথ যেহেতু চেনা, যেহেতু তা কালেকটিভ মেমরির অংশ, সেই মেমরিকে উদ্দেশ্য করে কেবল ইঙ্গিতটুকু ছুঁড়েও থেমে থাকা যেতো। এতে করে চেনা পুরাকথার কথন হতো মায়াবী, জটিল ও আরো অনেকটা রহস্যময়।

তথ্যসূত্র

1.কালেকটিভ আনকনশাসঃ সুইৎজারল্যান্ডের মনরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাইকোঅ্যানালিস্ট কার্ল ইউং (Karl Jung) এর একটি ধারণা। ওনার লেখা The Structure of Unconscious(1916) প্রবন্ধটিতে প্রথম এই ধারণাটির উল্লেখ করেন।

2. https://www.anandabazar.com/entertainment/review-of-chanchal-chowdhury-starrer-bangladeshi-film-hawa-dgtl/cid/1380596

One thought on “বাংলাদেশের ছবি হাওয়া ও একটি উপকথার পুনর্কথন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s