ইরানের চিত্রপরিচালক জাফর পানাহি ২০১০ সাল থেকে গৃহবন্দী। রাষ্ট্রের নিষেধ ছবি বানানোয়, সাক্ষাৎকার দেওয়ায় বা ছবি সম্পর্কিত কোনোকিছুর সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায়। তার মধ্যে থেকেও উনি বানিয়ে চলেছেন একের পর এক ছবি। ছবি বানানোর সিদ্ধান্তই যেখানে রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করবার মতো- সেখানে ছবিগুলো হয়ে ওঠে পানাহির যুদ্ধক্ষেত্র। এমন অবস্থায় মাসখানেক আগে তিনি চিত্রনির্মাতা মহম্মদ রাসুলুফ ও মোস্তাফা আল আহমুদের অন্যায় গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকেও পাঠানো হয় জেলে। বহু বছর যাবদ ইরান দেশের মধ্যে আটকে থাকা পানাহি এখন তিনি বন্দী হলেন সরাসরি ইরানের জেলে।
এটি পানাহির ২০০৩ সালের একটি সাক্ষাৎকার- অপেক্ষাকৃত কম চর্চিত ক্রিমসন গোল্ড বানানোর পর। তখনো তিনি রাষ্ট্রের হাতে বন্দী হননি- তখনো তিনি ক্যামেরা নিয়ে সোচ্চারে দাপিয়ে বেড়াতে পারছেন ইরানের রাস্তাঘাট। তবু তাঁর ছবিতে, কথায় প্রকাশ পাচ্ছে রাষ্ট্রের দাপট- ক্রাইম ও সেলফ পানিশমেন্টের ভাষ্য। বর্তমানে মাহসা আমিনির রাষ্ট্রীয় হত্যার প্রতিবাদে সরব ইরান- রাস্তার মোড়ে মোড়ে আজাদী- মেয়েরা হিজাব খুলে পুড়িয়ে দিচ্ছে জ্বলন্ত আগুনে। মনে রাখতে হবে এ লড়াই কেবল মাহসা আমিনির জন্যই নয়- এ লড়াই ইরানের সমস্ত মেয়েদের জন্য যাদের কথা বারবার উঠে এসছে পানাহির কথায় ও ছবিতে। ইরানের মেয়েদের উপর নেমে আসা ভায়োলেন্স ও তাদের সোচ্চার প্রতিবাদের এই পরিস্থিতিতে পানাহিকে নিয়ে আরো বেশী বেশী করে কথা বলার প্রয়োজন। এ লড়াই এখন আর কেবল মেয়েদেরই নয়- এ লড়াই সমগ্র ইরানের স্বাধীনচেতা মানুষের লড়াই যারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের অনুশাসনের হাতে বন্দী- ঠিক পানাহির মতোই।
“এ এক অদ্ভুত সময়। আমরা না ওরা- পক্ষ বেছে নাও। বিষয় হলো, এই কথা যে কেবল জর্জ বুশ-ই বলছেন তা নয়। আজ আমার দেশেও এমন কথা উঠছে। ছকের বাইরে সামান্য কয়েক পা ফেললেই কন্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লাগছে রাষ্ট্র- নামের পাশে সেঁটে দিচ্ছে লেবেলঃ সমাজবিচ্ছিন্ন- ঘৃণ্য- অর্থপিশাচ- দ্বিচারী- পাষন্ড।
আমেরিকা আমার আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে রাখে, আমার দেশপ্রেমকে ধূলিসাৎ করতে পরিয়ে রাখে হাতকড়া- কারণ আমি ইরান দেশের চিত্রনির্মাতা। আর নিজের দেশ ইরান আমাকে বিশ্বাস করেনা, আমাকে বারবার প্রশ্নের সামনে ফেলে- কারণ আমি একজন সমাজসচেতন চিত্রনির্মাতা”।
-জাফর পানাহি
রিচার্ড পর্টনঃ আমি যদ্দুর জানি ক্রিমসন গোল্ড (২০০৩) ছবিটি এক সত্যিকারের ঘটনার উপর নির্মিত। মূল ঘটনাটির সাথে ফিল্মের গল্পে কতোটা মিল রয়েছে এবং কতোটা নেই- সেই নিয়ে আপনি কি কিছু মন্তব্য করতে চান?
জাফর পানাহিঃ ফিল্মের সাথে গল্পের মিল কেবল এখানটায়- যেখানে লোকটি সোনার দোকান লুট করতে ঢোকে। আমি ইরানের সামাজিক বাস্তবতার ছবি ধরতে চাইলেও ছবিটি একপ্রকার সত্যি ও মিথ্যের(ফিকশান) খেলা।
পর্টনঃ ছবির বেশ খানিক ডিটেইলিং নিশ্চই আপনার করা- যেমন হোসেইনের চরিত্রায়ণ। হোসেইন- ছিনতাইবাজ এবং একইসাথে একজন পিৎজা ডেলিভারীম্যান। পিৎজা ডেলিভারীর প্রয়োজন না পড়লে এই চরিত্রটিকে হয়তো বড়োলোকদের পাড়ায় দেখাই যেতো না।
পানাহিঃ যে লোকটা আসলে দোকান লুট করতে এসেছিলো- তার পেশা সম্পর্কে আমি একেবারেই নিশ্চিত ছিলাম না। গল্পে এই পেশার উল্লেখ একপ্রকার অজুহাত বা ন্যারেটিভ এক্সকিউজ বলতে পারেন- যার উপর ভর করে ন্যারেটিভটি খুব সহজেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে যাতায়াত করতে পারে এবং দেখতে পারে সেখানে কি কি ঘটছে। হোসেইন এখানে অনুঘটক মাত্র। ওর জন্যেই আমরা শহরের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে উত্তরপ্রান্তে অবাধ যাতায়াত করতে পেরেছি।
পর্টনঃ এই ছবির চিত্রনাট্য যেহেতু আব্বাস কিয়ারোস্তামির লেখা- ফিল্মের কতোটুকু ওনার ভাবনা এবং কতোটুকু আপনার? নাকি আগাগোড়া চিত্রনাট্যই যোগসাজসের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে?
পানাহিঃ সেদিন আব্বাসের ফটোগ্রাফি এগজিবিশান। আমি আর আব্বাস গাড়িতে বসে আছি। উনি বললেন- “তুমি ঐ ছেলেটির গল্প শুনেছো যে সোনার দোকানে লুটপাট করে নিজেই নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে দেয়?” আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এগজিবিশান ছেড়ে বেরিয়ে আসি। খানিক ভাবনাচিন্তার পর আব্বাসকে ফোন করে বলি এই গল্পটা থেকে একটা দারুন ছবি হতে পারে যদি ছবির শুরুটা এই ছিনতাই এর দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যায়। এরপর থেকে আমাদের ছবি নিয়ে বহু আলোচনা হয়। আমরা পাঁচ থেকে ছয়বার ইরানের উত্তরপ্রান্তে যাই। ইতিমধ্যে আব্বাস ছবিটির চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। তবে স্বভাবতই শ্যুটের সময় হুবহু সেটাকে মেনে চলা হয়নি- গল্পের কিছু অংশে বদল এসছেই।

পর্টনঃ এখানে ফিল্মের কাঠামোটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ডাকাতি দিয়ে শুরু এবং ঐ একই ডাকাতির দৃশ্য দিয়ে শেষ করবার সিদ্ধান্ত ফিল্মটির একটি শক্তিশালী জায়গা। এবং আপনি একটু আগেই বলছিলেন যে এই ভাবনাটা মূলত আপনারই ছিলো। বেশীরভাগ জায়গায় আমরা হোসেইনের চোখ দিয়েই সমস্ত ঘটনাকে দেখতে থাকি- ছবিটির এই দৃষ্টিভঙ্গীর জায়গাটা অনস্বীকার্য।
পানাহিঃ একদমই ঠিক ধরেছেন আপনি। এই কারণেই গোটা ছবি জুড়ে আমরা হোসেইনের সাথে সাথেই থাকি। হোসেইন যা দেখেনা- দর্শকও তা দেখেনা।
পর্টনঃ আপনি ছবিটি শুরু করতে চেয়েছিলেন ডাকাতির দৃশ্যের স্ট্যাটিক শট দিয়ে- এবং সেটা হোসেইনের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে।
পানাহিঃ একদমই তাই। আমি আমার সমস্ত ফিল্মে একজন মানুষের পয়েন্ট অফ ভিউ এর উপরেই জোর দিয়ে থাকি। উদাহরণস্বরূপ একাধিক চরিত্র সম্বলিত দা সার্কেল (২০০০) ছবিটির কথা বলা যেতে পারে। একজন চরিত্র ও তার পয়েন্ট অফ ভিউকে ছেড়ে নতুন চরিত্রে প্রবেশ করার সাথে সাথে আগের পার্স্পেক্টিভকে ছেড়ে আসে ছবিটি।
পর্টনঃ আমি লক্ষ্য করেছি আপনার ছবিগুলো খুব সরল সাধারণ ধারণার(কনসেপ্ট) মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও তারা তাদের প্রাথমিক স্তরেই নতুন ভাবনাচিন্তার রসদ রেখে যায়।
পানাহিঃ একদমই তাই। আপনি দা হোয়াইট বেলুন (১৯৯৬) এবং দা মিরর (১৯৯৭) এর কথাই ভাবুন। ছবি দুটিতে ক্যামেরা কিন্তু ছোটো ছেলেমেয়েগুলোর আইলাইন এবং পয়েন্ট অফ ভিউ ছেড়ে কদাচিৎ দূরে সরে যায়। অবশ্যই ওদের জগতটা বড়োদের জগতের মতো প্রকান্ড নয়। দেখবেন ছবিতে আইলাইন খানিক উঁচুতে উঠে বড়োদের জগতে প্রবেশ করলেই বাচ্চাগুলো হারিয়ে যায়। সরল দৃষ্টিভঙ্গী উধাও হয়ে গেলেই দুনিয়া হয়ে ওঠে আরো কঠিন। ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ে কঠিন নির্মম সত্য।
পর্টনঃ আমি পড়েছি আপনি আলফ্রেড হিচককের ছবি থেকে ভীষণরকমের অনুপ্রাণিত। এবং হিচকক টাইট ফোকাস পয়েন্ট অফ ভিউ নিয়ন্ত্রণের মাস্টার।
পানাহিঃ হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি হিচককের সমস্ত ছবি দেখে ফেলেছিলাম। ছবি বানানোর শুরুর দিকে আমি অন্ধভাবে ওনার সম্পাদনার শৈলীকে অনুসরণ করতাম। তবে ওনার মতো করে ছবি বানিয়ে ফেলবার পর একটি বিষয় আমি বুঝতে পারি। ছবি বানানোর কৌশল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হলেও তাদের মধ্যে কোথাও গিয়ে মানবতার অভাব দেখা দিচ্ছে। এমন হৃদয়হীন বাস্তবরহিত ছবি তো আমি বানাতে চাইনি। এরপর আমি ছবির কৌশলের নৈপুণ্যের থেকেও বাস্তবের চিত্র তুলে ধরার প্রতি বেশী মনোযোগী হলাম। আমার কাছে ক্যামেরার গুরুত্ব আর আগের মতো রইলো না। বুঝতে শিখলাম সঠিক গল্প এবং গল্পের ধারণা থাকলে টেকনিকাল জাঁকজমকের জায়গাটা কতোটা গৌণ হয়ে পড়ে। হিচকককে আবিষ্কার করবার পর আমি আবার বুনুয়েল, গোদার এবং নিওরিয়েলিস্ট ছবিকরিয়েদের থেকেও অনুপ্রাণিত হতে থাকলাম।
পর্টনঃ এই সূত্র ধরে আমি বলবো, আপনার ছবির আঙ্গিকে ক্লাসিকাল স্টাইল এবং একধরণের নিওরিয়ালিস্ট প্রবণতার মধ্যে একটি টেনশান বা টানাপোড়েন চলতে থাকে।
পানাহিঃ এটা একেবারেই যে ছবি দেখছে তার দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নির্ভর করছে। আমার কাজ ছবি বানানো। এখন সমস্ত ছবি পরিচালকের ছবিতেই তাদের পূর্ববর্তী ছবিকরিয়েদের প্রভাব রয়েছে আবার একইভাবে পরবর্তী ছবি করিয়েদের ছবিতে বর্তমান পরিচালকদের প্রভাব থাকবে। এখন অন্য পরিচালকদের থেকে প্রভাবিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে তাদের স্টাইলকে টুকে ফেলা হচ্ছে- বরং তাদের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হচ্ছে নিজস্ব ছবি বানানোর ভাষা ও শৈলী।
পর্টনঃ আপনার অন্যান্য ছবিতে যেভাবে প্রচুর মহিলা চরিত্রদের দেখা যায়- ক্রিমসন গোল্ডে তেমন দেখা যায় না। কিন্তু ছবির মধ্যে মহিলাদের নিয়ে বহু কথাবার্তা ও চর্চা হতে থাকে। এটা কি তাদের পরোক্ষভাবে দেখবার কোনো স্ট্র্যাটেজি? এবং আমি এর সাথে জানতে চাইবো ছবির অত্যন্ত ধনী চরিত্র পোরাং-এর এই সাংঘাতিক মিসোজিনির উৎসটাই বা কি।
পানাহিঃ হ্যাঁ- আমার মনে হয় আপনি স্ট্র্যাটেজির বিষয়টা ঠিকই ধরেছেন। পোরাং তার কাছে আসা মহিলাটিকে বেশ্যা বলে চিহ্নিত করে- কিন্তু বলাই বাহুল্য মহিলাটি বেশ্যা নন যেহেতু তার বিবাহের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করে পোরাং। ইসলাম ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ছেলে ও মেয়েদের ঘনিষ্ঠতার পূর্বেই বিবাহের প্রয়োজন। পোরাং দীর্ঘকাল আমেরিকায় থাকবার দরুন ইরানের এই ধর্মীয় নিয়মটি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা।
পর্টনঃ আপনার ছবি মূলত তেহরানের শহুরে জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি। শ্রেণী বিভাজনের ব্যাপারটির উপর নির্দিষ্টভাবে ফোকাস করার জন্যই কি আপনার এই প্রেক্ষাপটটি বাছবার প্রয়োজন ছিলো?
পানাহিঃ কেবল শ্রেণী বিভাজনের সূত্র ধরে দেখা হলে ছবিটিকে একভাবে দেখা হবে- এবং এই দেখার পরিপ্রেক্ষিতটি বেশ সীমিত। কেননা আমি লক্ষ্য করেছি প্রাচ্যের লোকজন ধনী গরীবের বৈষম্যের থেকেও হোসেইনের অপমানিত হওয়ার জায়গাটি নিয়ে বেশী চিন্তিত। উঁচু শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে হোসেইনের বিশেষ কোনো সমস্যা ছিলো না। সে চাইলে, ধনী লোকটির বাড়িতেও ডাকাতি আসতে পারতো। কিন্তু দোকানের মালিক তাকে ফ্যান্সি গয়নার দোকানে ঢুকতে বাধা দিলে সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে। আসলে আমি একমাত্র সমাজের শ্রেণীবিভাজন নিয়ে কথা বলবো বলেই ছবিটি করেছি এমন নয়- বরং আমি দেখাতে চেয়েছি প্রত্যেক শ্রেণীরই কিছু নিজস্ব সমস্যা রয়েছে।
পর্টনঃ অর্থাৎ, সোনার দোকানীর অপমানই হোসেইনের এই ব্রেকডাউনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছিলো…
পানাহিঃ অবশ্যই সেটা ওর ব্রেকডাউনের একটা অন্যতম জরুরী কারণ। তবে এইটিই একমাত্র নয়। এর সাথে হোসেইনের সামাজিক জীবন জড়িয়ে থাকতে পারে। এবং এর জন্য অন্যান্য কারণ থাকাও অসম্ভব নয়। আসলে ইরানের ছবি যেকোনো বিষয়েরই নির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে তাকে দর্শকদের ভাবনার জন্য খুলে রাখতে চায়। যাতে নিজেদের জীবনবোধ এবং বোঝাপড়ার ক্ষেত্র থেকে দর্শকেরা নিজেদের মতো ভেবে নিতে পারে- তৈরি করে নিতে পারে নিজস্ব ভার্শান। এইটিই বোধ হয় হলিউড ছবির সাথে ইরানি ছবির মূল পার্থক্য।

পর্টনঃ ছবির শেষে এসে এই ওপেন এন্ডেড ন্যারেটিভ এর ধরণটি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। ধনী লোকটির বাড়িতে হোসেইনের ঘুরে বেড়ানো আর তারপরেই দোকানে চুরি করবার সাথে কোনো আপাত সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। দর্শককেই ঠিক করে নিতে হয় ঠিক কি ঘটেছিলো এই দুই সিকোয়েন্সের মাঝখানে।
পানাহিঃ হ্যাঁ আসলে আমার মনে হয়না ন্যারেটিভের এক পর্যায় থেকে অপর পর্যায় পৌঁছোনোর কোনো নির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে। ধনী লোকটির বাড়ির পুলে ঝাঁপ দিয়ে হোসেইনের নিজেকে শুদ্ধ মনে হয় এবং তারপরেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দোকানে ডাকাতি করবার। কিন্তু সে জলে ঝাঁপ দেওয়ার পরেই ডাকাতি করতে গেলো কেন- এর কোনো উত্তর হয়না।
পর্টনঃ এই শুদ্ধিকরণের ব্যাপারটি নিয়ে একটু বলবেন? জলে ডুব দিয়ে হোসেইন নিজেকে শুদ্ধ মনে করলো কেন বলছেন?
পানাহিঃ জল শুদ্ধতার প্রতীক। জলে ঝাঁপ দেওয়ার পর হোসেইনের মনে হলো সে পুরোনো গ্লানি থেকে মুক্ত শুদ্ধ নতুন এক মানুষ। এবং এই নতুন মানুষটি নতুন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এই বিষয়টি যেমন ধর্মীয় প্রেক্ষিত থেকে সত্য- তেমন সত্য ভৌগলিক অধর্মীয় প্রেক্ষিত থেকেও। জল থেকে উঠে হোসেইন কোনোকিছু স্পর্শ অবধি করেনা, কেবল অপেক্ষা করতে থাকে সূর্যোদয়ের। মূল চিত্রনাট্যের একটি জায়গায় ছিলো গয়নার দোকানি তার নাতিকে স্কুলে দিয়ে এলে হোসেইন তার পিছু নিচ্ছে। এই দৃশ্যটি শ্যুট করা হয়, কিন্তু গোটা ছবির নিরিখে একে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় পরে আমি বাদ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
পর্টনঃ আপনি আপনার ছবির জন্য বেশীরভাগ সময়েই অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করান। হোসেইন এর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন আমি যদ্দুর জানি তিনি স্ক্রিৎজোফ্রেনিক ছিলেন।
পানাহিঃ হ্যাঁ। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমি অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করে থাকি। হোসেইনের চরিত্রের অভিনেতা বাস্তবেও একজন পিৎজা ডেলিভারিম্যান। ওনাকে ছবিটি করবার কথা বলায় উনি প্রথমে রাজি হননি। আমরা মাসখানেক অপেক্ষা করে ওনার ভাইয়ের সাথে কথা বলি যিনি নিজে একজন ডাক্তার। শেষপর্যন্ত উনিই হোসেইনকে এই চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য রাজি করান।
পর্টনঃ এমন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের সাথে কাজ করাটা নিশ্চই খুব সহজ ছিলো না?
পানাহিঃ ভীষণ ভীষণ শক্ত ছিলো। ওনার বিবিধ সমস্যার জন্য মাঝেমাঝেই ছবির শ্যুটিং বন্ধ করে দিতে হতো। এক এক সময় পরিস্থিতি এতোটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে আমি দুই তিনবার ছবির প্রজেক্টটিকে বাতিল করবার কথা অবধি ভেবে ফেলেছিলাম। কিন্তু আবার সেই ভাবনায় জল ঢেলে আমি নতুন উদ্যমে শ্যুট শুরু করি। এই করতে করতে একটা সময় বুঝতে পারলাম ওনাকে কয়েকটি দৃশ্যে রাখা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছেনা- তা মূলত ওনার অসুস্থতার জন্যেই। আমি ঠিক করি যে আমরা যদি ওর পয়েন্ট অফ ভিউ এর ওপর পুরোপুরি মনোনিবেশ করি, সেক্ষেত্রে মাঝেসাঝে দর্শকের ওঁকে না দেখলেও চলবে। হোসেইনের জন্য আমরা ফিল্মের দৃশ্যগুলিকে ধারাবাহিকভাবে শ্যুট করছিলাম। এতে করে আদপে ওর পয়েন্ট অফ ভিউ পেতে সুবিধাই হয়েছে।
পর্টনঃ আপনি কি সাধারণত স্ক্রিপ্টের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই শ্যুট করেন?
পানাহিঃ হ্যাঁ, কেননা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমার ছবিতে অপেশাদার অভিনেতারা কাজ করে থাকেন। সিকোয়েনশিয়ালি শ্যুট না করলে তাদের চরিত্রের মধ্যে থাকতে অসুবিধে হয়। তবে লোকেশান শ্যুটিং বা রি-শ্যুটিং এর ক্ষেত্রে সবসময় সিকোয়েন্সের পর সিকোয়েন্স বজায় রেখে শ্যুট করা সম্ভব হয়না।
পর্টনঃ পেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করালে নিশ্চই শ্যুটিং স্টাইল খানিক ভিন্নপ্রকার হতো।
পানাহিঃ তা তো হতোই। এইক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময় আমরা অভিনেতাদের সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য হাতে দিইনা। তাই তারা বুঝে উঠতে পারেনা তাদের পরেরদিন ঠিক কি করতে হবে। দর্শকের মতো অভিনেতারাও গল্পটিকে অনুসরণ করতে থাকে। তবে অপেশাদার অভিনেতাদের মধ্যে একমাত্র হুসেনের ক্ষেত্রেই আমি সম্পূর্ণ চিত্রনাট্যটি আগেভাগে দিয়ে রেখেছিলাম। আসলে ওর অসুস্থতার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম- আমার মনে হতো কোনো একটা যুক্তি খাড়া করে ও ছবি ছেড়ে চলে যাবে। তাও আগে থেকে হাতে স্ক্রিপ্ট পেয়ে গেলে হয়তো সে শান্ত থাকতে পারে। যদিও চিত্রনাট্যটি আদপেই হোসেইনের পছন্দ হয়নি।
পর্টনঃ শ্যুটে আপনি যে লাইনগুলো দিতেন- হোসেইন কি সেগুলোর ওপরেই কাজ করতো নাকি সেগুলোকে নিজের মতো করে ইম্প্রোভাইজ করে নিয়েছিলো?
পানাহিঃ কখনো কখনো স্ক্রিপ্টে যা যা লাইন ঠিক তাই তাই সে ব্যবহার করতো আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণটা ভুলেও যেতো। ওর এই খামখেয়ালী ব্যবহারকে আমরা চরিত্রের মধ্যে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছিলাম।
পর্টনঃ ‘ক্রিমসন গোল্ড’ নামটি থেকে খুব বেশী কিছু স্পষ্ট হয়না। আপনি কি ফিল্মের এই টাইটেলটি নিয়ে কিছু বলতে চান?
পানাহিঃ ছবিটা দেখবার পর দর্শক যাতে ‘ক্রিমসন গোল্ড’ নামটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে তার জন্যই মূলত এই টাইটেলের ব্যবহার। ভেবে দেখুন হোয়াইট বেলুন ছবিটিতেও কিন্তু কোথাও সাদা রঙের বেলুন দেখতে পাওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় আমার ফিল্মের টাইটেল গুলো ব্যঞ্জনাধর্মী হয় আবার কোনো কোনো সময় তা হয়না। ‘গোল্ড’ অর্থাৎ স্বর্ণ সম্পত্তির প্রতীক আবার ‘ক্রিমসন’ অর্থাৎ লাল রঙ প্রতীক রক্তের। দর্শককে তাই আগেভাগেই বলে রাখা হচ্ছে, ছবিটির গল্পে বিত্ত এবং রক্ত- এই দুইই আশা করতে পারেন।

পর্টনঃ ধনী লোকটির বাড়িতে গিয়ে কিছু লাল দাগ দেখে হোসেইন প্রথমে তা রক্ত ভাবলেও পরে বোঝে যে ওইগুলো আসলে নেল পালিশের দাগ। এইটিও কি দর্শকের সাথে মশকরা করবার জন্যই করেছেন?
পানাহিঃ একদমই তাই!
পর্টনঃ আপনার ছবি দেখে মনে হয় বন্ধ দরজার ওপারে কি চলছে তার সম্বন্ধে নানান ভাবনাচিন্তা উসকে দিয়ে আপনি মজা পান। যেমন একটি দৃশ্যে হোসেইন এবং ধনী লোকটিকে আমরা বন্ধ দরজার এপার থেকে ছায়ার মধ্যে দিয়ে দেখি, আবার একইভাবে অন্য এক দৃশ্যে হোসেইন এবং সেনাবাহিনীর ছেলেটি বন্ধ জানলার কাচে এক হাউজপার্টির ছায়া দেখতে থাকে। যে পার্টি ইরানে বে আইনী- তা নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়। অর্থাৎ, আপনার ছবিতে প্রাইভেট এবং পাবলিক এই স্পেস দুটির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা নিশ্চই এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
পানাহিঃ ইরানের জীবনে এটি একটি সত্যিকারের সমস্যা। ছেলেমেয়েদের পার্টি করতে চাওয়া মানে নিজেদের বাড়ি বয়ে বিপদ ডেকে আনা। এখানে হোসেইন ন্যারেটিভ ডিভাইস হিসাবে কাজ করে যার মাধ্যমে আমরা এই সমস্যাটিকে মেলে ধরবার সুযোগ পাই। ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা হোসেইন এবং সেনার ছেলেটির চাইলেও এই পার্টিতে ঢুকতে পারবেনা। তারা কেবল বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে- কেননা ওরা জানে ওই জগতটা ওদের জন্য নয়।
পর্টনঃ সেইটা কি মূলত ওদের সামাজিক অবস্থানের জন্য?
পানাহিঃ কিছুটা তো অবশ্যই তাই। তাছাড়াও ইরানের চিত্রপরিচালকেরা ওইধরনের পার্টির দৃশ্য ভিতর থেকে শ্যুট করবার অনুমতি পান না। তাই আড়াল করে পর্দার ছায়ার মধ্যে দিয়ে শটগুলি নেওয়া হয়েছে। পার্টি করাই ইরানে একপ্রকার ক্রাইম।
পর্টনঃ কিন্তু ইরানে তো এমন পার্টি হয়েই থাকে!
পানাহিঃ হ্যাঁ হয়ে থাকে। তবে তার উলটো পিঠ-ও রয়েছে। মাত্র দু হপ্তা আগের ঘটনা বলি। শহরের এক যুগল পার্টি করে ফিরছিলো। ফেরার রাস্তায় পুলিশ তাদের পিছু নেয় এবং পার্টি করবার অপরাধে সটান গুলি করে। ছেলেটি মারা যায়।
পর্টনঃ সেক্ষেত্রে আপনার সত্যিকারের পার্টি শ্যুট করতে না পারবার সীমাবদ্ধতা নান্দনিক একটি সম্ভাবনার দিক খুলে দেয়। আয়রনিকালি, একে আমরা ‘এস্থেটিক অ্যাডভান্টেজ’ বলতে পারি। এই অ্যাডভান্টেজ-এর জন্যই বোধ হয় ছবিটির নাটকীয় প্রভাব অনেক বেশী বলিষ্ঠ ও আবেদনপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পানাহিঃ ঠিকই ধরেছেন। যদি কোনো ছবির প্রয়োজনে প্রেমিক প্রেমিকার ঘনিষ্ঠতা ব্যক্ত করতে হয়- আমি তা সরাসরি স্ক্রিনে না দেখাতেই অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করবো। দরজার ভিতর প্রেমিক প্রেমিকা থাকলে ক্যামেরাকে রেখে দেবো বন্ধ দরজার এপারে। আমার মতে, এর সিনেম্যাটিক প্রভাব অনেকখানি বেশী।


(তেহরানের ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এবং ক্রিমসন গোল্ড (২০০৩) ছবিটিকে কেন্দ্র করে জাফর পানাহির সাথে রিচার্ড পর্টনের সাক্ষাৎকার।)
উৎসঃ Cinema Scope No 17(January 12, 2003): 9-13, Reprinted by Permission of Andrew Tracy, Managing Editor, Cinema Scope.
Jafar Panahi Interviews, Edited by Drew Todd, University Press of Mississippi/Jackson)