[১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্স শহরের ছাত্র আন্দোলন সংস্কৃতির আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতোই সিনেমারও সর্বস্ব ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। প্রচলিত মূলধারার ছবির বিকল্প বিষয় এবং আঙ্গিক অনুসন্ধান করাই শুধু নয়, বরং স্বতন্ত্র বিকল্প পরিসর, যেখানে চলচ্চিত্রনির্মাণ থেকে শুরু করে প্রদর্শন পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটাই সংযুক্ত হয়ে গেছিল সেই যুগের বৈপ্লবিক রাজনীতির সঙ্গে। ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে দাবানলের মতো সারা পৃথিবীতে যখন প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন যে কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কিংবা শৈল্পিক দলিলেই যে প্রতিসংস্কৃতি নির্মাণের নাছোড় আকাঙ্ক্ষা উপচে পড়বে, তা বুঝে ফেলা খুব কঠিন কাজ নয়।
বলা বাহুল্য, জঁ-লুক গোদার একমাত্র চিত্রপরিচালক নন, যিনি এই বিকল্প সংস্কৃতি নির্মাণের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গোদারের নামটা এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য – কারণ একমাত্র না হলেও গোদার বৈপ্লবিক ছবি করিয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক, যিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত পনেরোটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও (যার মধ্যে অধিকাংশই প্রথম সারির আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কারপ্রাপ্ত) প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ থেকে সরে আসলেন। ১৯৬৭ সালে নির্মিত উইকেন্ড ছবিটির শেষ টাইটেলে দেখানো হয় ‘ফিন দে সিনেমা’ – এন্ড অফ সিনেমা! অতএব সক্রিয় মাওবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী জঁ-লুক গোদার বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে সিনেমার সমাপ্তি ঘোষণার স্পর্ধা দেখান (কারওর মনে পড়তে পারে ১৯৬৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করে দেওয়ার সময় চিৎকার করে বলা তাঁর কথাগুলো – ‘স্টুপিড লোকজন! আমরা এখানে ছাত্র ধর্মঘট আর সলিডারিটি নিয়ে কথা বলছি, আর তোমরা ক্লোজ আপ ট্র্যাকিং শট নিয়ে পড়ে আছো!’)

১৯৬৮ সালেই সহকর্মী জঁ পিয়ের গোরা-কে নিয়ে গোদার তৈরী করেন যিগা ভের্তভ গোষ্ঠী, যা প্রখ্যাত সোভিয়েত ফিল্মমেকারের নাম থেকে অনুপ্রাণিত। প্রাভদা (১৯৭০), উইন্ড ফ্রম দ্য ইস্ট (১৯৭০), স্ট্রাগলস ইন ইটালি (১৯৭০) জাতীয় ছবিগুলো চলচ্চিত্রভাষার দিক থেকে মূলধারার ছবির উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক তো বটেই – কিন্তু তার চেয়েও জরুরি তার রাজনৈতিক আঙ্গিক – তারা চলচ্চিত্র হওয়ার থেকেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীকৃত হতে যেন বেশী আগ্রহী (সংশ্লিষ্ট ম্যানিফেস্টোর ৩৫ নং পয়েন্ট দ্রষ্টব্য)। যে ম্যানিফেস্টো-টি (যার নাম লেনিনের বিখ্যাত বইয়ের নামে) আমরা কাউন্টার শট-এর পক্ষ থেকে তর্জমা করার জন্য বেছে নিয়েছি, সেখানে গোদার একদিকে যেন তাঁদের সেই পর্বের কাজের ব্লু-প্রিন্ট রচনা করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে মার্ক্সবাদী বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার নাছোড় অনুসন্ধান জারি রয়েছে; অন্যদিকে মার্ক্সবাদের দান্দ্বিক কাঠামোকে আশ্রয় করে তিনি যেন চলচ্চিত্রতত্ত্বে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছেন, যেখানে অর্থনীতি এবং রাজনীতি ছবির আঙ্গিক নির্ধারণের প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
তারপর কেটে গেছে বহু যুগ, আক্ষরিক অর্থেই তার পরিমাপ পাঁচ দশক – অর্ধেক শতাব্দী। আর পাঁচটা বৈপ্লবিক গোষ্ঠীর মতোই যিগা ভের্তভ গোষ্ঠীও ভেঙে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই। জঁ-লুক গোদার আবার নিজেকে পাল্টে ফেলতে চেয়েছেন, চলচ্চিত্রভাষা নিয়ে নাছোড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষ চলচ্চিত্র পর্যন্ত। কাউন্টার শট-এর পক্ষ থেকে আমরা যখন এই তর্জমা করার সিদ্ধান্ত নিই, তখনও জানতাম না পত্রিকা প্রকাশের দুই দিন আগে খবর পাবো, বৃদ্ধ গোদার, তাঁর নিজের ভাষায় ‘exhausted’ হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেবেন। কাউন্টার শট-এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রত্যেকের তো বটেই, এ পত্রিকার সম্ভাব্য পাঠকেরও বৃহৎ অংশ হয়তো এই শিল্পীর চিন্তা ভাবনায় জীবনের কোনো না কোনো সময় উত্তেজিত হয়েছেন – এবং সে উত্তেজনার প্রাথমিক ক্ষেত্রটা আবিষ্কার এবং অনুসন্ধানের পথে গ্রথিত। যখনই কেউ চলচ্চিত্রের চেনা পরিসরে খানিক ‘exhausted’ হয়ে গিয়ে অন্য কিছু অনুসন্ধান করতে চাইবেন, তিনি জানতে পারবেন তাঁর কাজের সঙ্গী কমরেড ছিলেন ৯২ বছরে স্বেচ্ছামৃত এক টগবগে তরুণ, যিনিও এই ঠিক একই কাজে – চলচ্চিত্রের নতুন ভাষার সন্ধান – আজীবন নিয়োজিত থেকেছেন।
আমাদের পত্রিকার ‘নতুন সিনেমার সন্ধানে’ বিভাগটিতে আমরা খতিয়ে দেখতে চাই – নিরন্তর সমালোচনামূলক (যার প্রতিশব্দ নিন্দে নয়) দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের নতুন কোনো ভাষা খুঁজে পাওয়া সম্ভব কিনা। তাই সেই অনুসন্ধানের প্রথম লেখা হিসেবে রইল অর্ধশতাব্দী আগেকার এই ম্যানিফেস্টো – যা তার মতো করে সেই উত্তাল সময়ে ঠিক এই কাজটিই করেছিল। রাজনীতি আর সিনেমার মিশেলে কতটা সফল সেই নিরীক্ষা, মে ১৯৬৮ সফল না ব্যর্থ, উত্তর-বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদ আদৌ আর বিকল্প পরিসর তৈরী করার অবকাশ রাখে কিনা, সেইসব সামাজিক-রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক তর্ক তো চলতে থাকবেই। আপাতত থেকে যাক বুলেটের মতো ৩৯ পয়েন্টের এই দলিল। ]

হোয়াট ইজ টু বি ডান!
[মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ‘আফটারইমেজ’ পত্রিকায় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখাটি প্রথম ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়]
১. আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ছবি বানাতে হবে।
২. আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ছবি বানাতে হবে।
৩. ১ এবং ২ পরস্পরবিরোধী এবং দুনিয়ার দু’টি বিপরীত মতাদর্শের অন্তর্গত।
৪. ১ দুনিয়ার ভাববাদী ও অধিবিদ্যক মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে।
৫. ২ দুনিয়ার দ্বন্দ্বমূলক ও মার্ক্সবাদী মতার্দশের প্রতিনিধিত্ব করে।
৬. মার্ক্সবাদের সংগ্রাম ভাববাদের বিরুদ্ধে আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে যাবতীয় অধিবিদ্যক তার প্রতিদ্বন্দ্বী।
৭. এই লড়াই প্রাচীনের সঙ্গে নবীনের; নতুন এবং পুরোনো চিন্তাধারার।
৮. মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব তাদের চিন্তার গতিপথ নির্ধারণ করে।
৯. প্রাচীন এবং নবীনের মধ্যে চলতে থাকা দন্দ্ব হল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যবর্তী দন্দ্বের প্রকাশ।
১০. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর অংশীদার হয়ে থেকে যাওয়া।
১১. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ সমাজের শ্রমজীবী সর্বহারা শ্রেণীর অবস্থান গ্রহণে সক্ষম হওয়া।
১২. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ কোনো পরিস্থিতিকে বর্ণনা করা।
১৩. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ নির্দিষ্ট পরিস্থিতির মূর্ত বিশ্লেষণ করা।
১৪. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ ব্রিটিশ সাউন্ডস নির্মাণ করা।
১৫. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ ইংলিশ টেলিভিশনে সেই ব্রিটিশ সাউন্ডস সম্প্রচারের জন্য সংগ্রাম করা।
১৬. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ বস্তুজগতের নৈর্ব্যক্তিক নিয়মকানুন বুঝতে পারা, যাতে তাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
১৭. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ বস্তুজগতের নৈর্ব্যক্তিক নিয়মকানুন বুঝতে পারা, যাতে তাকে সক্রিয়ভাবে পরিবর্তন করা যায়।
১৮. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ এই দুনিয়ার দৈন্য বিবৃত করা।
১৯. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ সংগ্রামরত মানুষকে দেখাতে পারা।
২০. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ সমালোচনা এবং আত্ম-সমালোচনাকে হাতিয়ার করে ১-কে আক্রান্ত তথা ধ্বংস করা।
২১. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ যাবতীয় ঘটনার ‘সম্পূর্ণ’ দর্শন নির্মাণ করা, যাকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়।
২২. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ আপেক্ষিক সত্যের নামে ক্রমাগত পূর্ণ হয়ে চলা এই পৃথিবীর ছবিকে ভঙ্গুরভাবে প্রদর্শন না করা।
২৩. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ কোনো বিষয় কীভাবে ও কতখানি বাস্তব তা বলা। (ব্রেশ্ট)
২৪. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ সমস্ত বিষয় বাস্তবিক কীরকম সেইটা বলা। (ব্রেশ্ট)
২৫. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ শ্যুট করার আগেই ছবি এডিট করা, শ্যুটিং চলতে চলতে ছবি বানানো, এমনকি শ্যুটিং শেষ হয়ে গেলেও নির্মাণ প্রক্রিয়া জারি রাখা। (যিগা ভের্তভ)
২৬. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ প্রযোজনার আগে ছবির বন্টনে মাথা ঘামানো।
২৭. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ বন্টনের আগে ছবি প্রযোজনা করা, এমনভাবে প্রযোজনা করতে শেখা যেখান থেকেই বন্টনব্যবস্থা নির্ধারিত হয়, যেভাবে রাজনীতি অর্থনীতিকে নির্ধারণ করে।
২৮. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ সেই ছাত্রদের ফিল্ম করা, যারা লেখেঃ ইউনিটি – স্টুডেন্টস – ওয়ার্কার্স।
২৯. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ যে পরস্পর বিরোধী শক্তির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো (লেনিন) যাতে জানা যায়, যে এই দুই আসলে এক।
৩০. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ দৃশ্য (ইমেজ) আর শব্দ (সাউন্ড) দিয়ে সমাজের শ্রেণীসংঘাতকে পাঠ করা।
৩১. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ উৎপাদন আর উৎপাদক শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বন্দ্বকে পাঠ করা
৩২. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ কোনো মানুষ কোন অবস্থানে অবস্থিত, তা জানার স্পর্ধা রাখা; তার ইতিহাস, উৎপাদন ব্যবস্থায় তার অবস্থান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা, যাতে তাকে পরিবর্তন করা যায়।
৩৩. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস জেনে তার দ্বারা কৃতসংকল্প হওয়া।
৩৪. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ বৈপ্লবিক সংগ্রাম ও তার ইতিহাসকে মন্থন করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নির্মাণ করা।
৩৫. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ এ কথা উপলব্ধি করা যে চলচ্চিত্র নির্মাণ আসলে এক গৌণ কর্মকান্ড; বিপ্লবের সামগ্রিক ব্যাপকতায় তার ভূমিকা একটা ছোট্টো পেরেকের চাইতে বেশি নয়।
৩৬. ২-এর বাস্তবায়নে দৃশ্য (ইমেজ) আর শব্দ (সাউন্ড) যেন কামড়ে ধরার জন্য দাঁত আর ঠোঁটের মতোই অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
৩৭. ১-এর বাস্তবায়নের অর্থ কেবল চোখ-কান খুলে সজাগ থাকা।
৩৮. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ কমরেড কিয়াং জিং-এর রিপোর্ট পড়া।
৩৯. ২-এর বাস্তবায়নের অর্থ বিপ্লবী হয়ে ওঠা।
ছবি নির্দেশিকাঃ প্রচ্ছদের ছবি ফার ফ্রম ভিয়েতনাম (১৯৬৭) নামক অ্যান্থলজি ফিল্মের একটি ফ্রেম। ‘৬৮র কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোদারের ছবিটি নেওয়া হয়েছে টু ইন দ্য ওয়েভ (২০১০) তথ্যচিত্র থেকে।
অসাধারণ লেখা, অবশ্যমান্য দিকগুলি এতো সহজে ইনিই বলতে পারতেন। কাউন্টার শটকে অনেকানেক শ্রদ্ধা
LikeLike