জলে ভাসা পদ্ম জীবন: নোনা জলের কাব্য

শহরের একটি ছেলে, ভাস্কর, উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে রওনা দেয় বিরাট এক বাক্স নিয়ে। ছেলেটির নাম রুদ্র, বাক্সবোঝাই তার নিজের হাতে তৈরি প্রায় মানুষের আকৃতির সমান হরেকরকম ভাস্কর্য। সমুদ্রের ধারে সুন্দরবন অঞ্চলের সেই অজপাড়াগাঁয়ের সব অধিবাসীরাই পেশায় জেলে, মাছ ধরাই তাঁদের মূল জীবিকা। প্রতি বছরই সমুদ্রের জল এসে তাঁদের ঘর ভাসিয়ে দেয়, নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হয় বসতি। শহুরে, নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য সেই জেলেদের গ্রামে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক বলতে একমাত্র রেডিও, তাতেই মাঝে মাঝে সাইক্লোনের পূর্বাভাস ভেসে আসে। রুদ্র সেই গ্রামে থাকতে শুরু করে, স্থানীয় বাচ্চা ছেলেদের তাকে নিয়ে বেশ হইহই পড়ে যায়। বোঝা যায়, বাড়ির একটি মেয়ের তাকে বেশ পছন্দ – আর এই সমস্ত নিয়ে গ্রামের মাতব্বর এবং কথায় কথায় আল্লাকে ডাকতে থাকা গ্রামপ্রধানের যারপরনাই সমস্যা শুরু হয়। অতএব নায়কের সঙ্গে বাকিদের ঠান্ডা যুদ্ধ, নায়িকাও উপস্থিত – ভালো একটি জমজমাট গল্প বলার সবকটি উপাদানই হাতের কাছে তৈরী। কিন্তু যে ছবি থেকে এই গল্পটি লিখলাম – ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, বাংলাদেশের তরুণ চিত্রপরিচালক রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি নোনাজলের কাব্য – ছবিটি সযত্নে একটি জমজমাট নাটকীয়তায় মোড়া অজস্র উত্থানপতন নির্ভর ছবি হয়ে ওঠার পথ থেকে নিজেই সরে আসে। এবং জরুরি – এই সরে আসার জন্য তাকে অযথা মন্থর হয়ে গিয়ে ‘স্লো-সিনেমা’ হয়ে উঠতে হয় না, অযথা প্রো ফিল্মিক পরিসরের প্রতি কারণ ছাড়া ঠায় চেয়ে থাকতে হয় না। বরং পরিমিত মাপা ছন্দে সুমিত শহুরে রুদ্র এবং অজপাড়াগাঁয়ের জেলেদের অবধারিত সংঘর্ষের জায়গাগুলো দেখাতে থাকেন, ছবিটি জলের তোড়ে আটকে পড়া বেশ কিছু মানুষের জীবনের নীরব সাক্ষী হয়েই থেকে যেতে চায়।

অতিকায় বাক্স নিয়ে রুদ্র গ্রামের দিকে চলেছে

নোনাজলের কাব্য ছবিটির প্রথম এবং প্রধান অর্জন তার পরিমিতি বোধ, যা যে কোনো চলচ্চিত্রনির্মাতার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি গুণ। ছবিটি নিজের জন্য যে পরিসর বেছে নেয় – অর্থাৎ শহুরে একটি ছেলে তার নিজের কাজের জন্য অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে থাকছে – এই ধরণের পরিসর সারা বিশ্বের সাহিত্য এবং সিনেমায় বারবার উঠে এসেছে। এরকম পরিসরে যে ধরণের সমস্যা অত্যন্ত প্রত্যাশিত, যেমন শহুরে দৃষ্টিতে দেখা গ্রামের মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার, সেই সংক্রান্ত বিপর্যয়, শহরের প্রতিনিধি পুরুষের গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করার ভার (হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেনের বিভিন্ন রূপ) – এগুলো যে ছবিটিতে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু সুমিত এইসব প্রত্যাশিত উপাদান ছবিতে বুনে দিলেও অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ করেন – তিনি ছবির নায়ককে কার্যত নিষ্ক্রিয় একটি চরিত্র করে রেখে দেন। রুদ্র অনেক কিছুই করতে চায়, কিন্তু কিছুই করতে পারে না – এই নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নানান সম্ভাবনা, যা ছবিটিকে কেবল একমাত্রিক গ্রাম বনাম শহরের ছবি হয়ে ওঠার থেকে মুক্তি দেয়।

গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে রুদ্র

কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ছবির শুরুতেই বোঝা যায়, রুদ্রর কাজ নিয়ে গ্রামের মানুষদের মধ্যে চাপা একটি অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। যেহেতু সে ভাস্কর, ভাস্কর্য তৈরি করে; গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জেলেদের কাছে তা কেবলই মূর্তি মাত্র, যা কিনা ইসলাম ধর্মের বিরোধী। অতএব রুদ্র গ্রামে যাওয়ার পরেই প্রকৃতির খেয়ালে যে ইলিশ মাছ আসা বন্ধ হয়ে যায়, তার সরাসরি দায় পড়ে তার উপরেই – শহর থেকে সে যেন অভিশাপ নিয়ে এসেছে, গ্রামের পবিত্র মাটিতে মূর্তি বানিয়ে সে অভিশাপ সবার প্রতি চারিয়ে দিচ্ছে। এহেন অন্ধবিশ্বাসের জায়গাটি ছবিতে খুব স্পষ্ট ভাবে নির্মিত হয় – গ্রামের চেয়ারম্যান সবাইকে তাতিয়ে দেন, তার বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হয় – কিন্তু রুদ্র দুই-একবার বক্তৃতা করার চেষ্টার বাইরে বিশেষ কিছুই করতে পারে না। সন্দেহপ্রবণ গরীব এক জেলের মাধ্যমে তার ঘর যখন তছনছ হয়, তখনও গ্রামের সালিশি সভার বিচারের সামনে তার কিছুই করার থাকে না। সেই গরীব জেলের একমাত্র সম্বল একটি গরুকে কুরবানি করার রায় দেন চেয়ারম্যান, রক্তে ভেসে যাওয়া সমুদ্রতট থেকে রুদ্র চোখ ফিরিয়ে নেয়, নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া যেখানে আর কিছু করার নেই।

এই নিষ্ক্রিয়তার পরিসর ছবি যত এগোয়, তত স্পষ্ট হতে থাকে। ঘটনা ঘটছে ঘটনার মতন, রুদ্রকে শুধু নীরব সাক্ষী থেকে যেতে হচ্ছে। সমুদ্রতটের ভয়াল ঢেউ আর ঘন নীল রাত্রির অন্ধকারে কালো সিল্যুয়েট হয়ে রুদ্র মাঝে মাঝে পায়চারি করে। যে মেয়েটির তাকে ভালো লাগছিল, হয়তো তারও ভালো লাগছিল মেয়েটিকে – তাদের দেখা হওয়া বন্ধ করে দিতে হয় সামাজিক অনুশাসনের চাপে। ছবির শেষ অংশে সাইক্লোন আসার আগের মুহূর্তে গোটা গ্রাম যখন রিলিফ সেন্টারে, তখন ঘরসংসার নিয়ে আসা সেই বিরাট বাক্সে রুদ্র আর মেয়েটির আটকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দিয়েই সুমিত ছবিটি শেষ করে দেন। আক্ষরিক অর্থেই ঘটনার মাঝখানে ছবি শেষ করে দিয়ে সুমিত যেন দর্শককে বাকি অংশ কল্পনা করে নিতে বলেন। হয় ঝড় এসে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে বাকি সব, নইলে গ্রামের বাকি মানুষের রোষে সকালবেলা হয়তো গণপিটুনিতেই মারা যেতে হবে এই তরুণ তরুণীকে – দোদুল্যমান এই সম্ভাবনার মধ্যেই ছবিটি শেষ হয়ে যায়।

গ্রামবাসীরা রুদ্রর কাজ পুড়িয়ে দিচ্ছেন

নোনাজলের কাব্য ছবিটিতে মূল চরিত্রের নিষ্ক্রিয়তা, অর্থাৎ ঘটনার গতিপ্রকৃতিতে কোনোভাবেই নিজের কাজের ছাপ রাখতে না পারা এবং ছবিটির হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া – এই দুইকে মিলিয়ে আমরা কি কিছু ভিন্নতর ভাবনার দিকে এগোতে পারি? এ লেখার বাকি অংশে এই সূত্র ধরে সামান্য কিছু চেষ্টা করা হবে।

****

আমরা জানি, চলচ্চিত্রে ‘রূপক’ (মেটাফর) জিনিসটি সবসময় খুব সফল ভাবে কাজ করে না। আলবেয়র কামু তাঁর প্লেগ উপন্যাসে যেভাবে রোগাক্রান্ত একটি শহরের গল্প বলে আসলে ইঙ্গিত করতে চান ফ্যাসিবাদকে, যেখানে রাজনীতি নিয়ে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, গণহত্যা নিয়ে একটিও কথা না বলেও সেইদিকেই পাঠকের নজর ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন, সিনেমায় সেই জিনিস করা অত্যন্ত কঠিন। অর্থাৎ স্পষ্ট করে বলছি এক জিনিস, অথচ ইঙ্গিত করছি আরেক জিনিস – সাহিত্যে বা চিত্রকলায় যত সহজে এটা করা যায়, সিনেমায় সেই ভাবে বিষয়টি সম্ভব হয় না। কারণ স্পষ্ট – সিনেমা বাস্তবতাকে তার নিজের স্বরূপেই ক্যামেরার সামনে প্রকাশ করে, অন্যান্য শিল্পের মতন বাস্তব পৃথিবীকে কেবলমাত্র কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে না। যেমন ধরা যাক – সিনেমার পর্দায় যদি দেখা যায় অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাহলে প্রথমত সেই বৃষ্টি সত্যিকারের প্রকৃতির বাস্তবিক বৃষ্টি হিসেবেই প্রতিভাত হয়, সেই বৃষ্টির আড়ালে কোনো গূঢ় অর্থ লুকানো আছে কিনা, তা খুঁজে বের করা দর্শকের কাজ নয়। অর্থাৎ পর্দার বৃষ্টি প্রাথমিক ভাবে কোনো কিছুর রূপক নয় – বরং সে আক্ষরিক অর্থেই বাস্তব প্রকৃতির বৃষ্টির ইমেজ। বিখ্যাত জার্মান তাত্ত্বিক সিগফ্রিড ক্র্যাকোয়ার তাঁর থিওরি অফ ফিল্ম বইয়ের মুখবন্ধে এই বিষয়ে চমৎকার একটি বাক্য লিখেছিলেন – “Works of art consume the raw material from which they are drawn, whereas films as an outgrowth of camera work are bound to exhibit it.” অবশ্যই এই বিষয়েও নানা বিতর্ক আছে – চলচ্চিত্রতত্ত্বের নানান চিন্তক সিনেমাকেও কেবল সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েড সম্পর্ক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, যেখানে মূর্ত বাস্তবের চেয়ে চিহ্নকের উপস্থিতিই আলোচকের কাছে বেশী জরুরি হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমে, যেখানে ছবি তুলে ফেলার পর পোস্ট-প্রোডাকশনে অজস্র জিনিস যোগ করা হয়, সেখানে ক্যামেরার সামনে থাকা প্রো-ফিল্মিক পরিসরের বাস্তবতা কতখানি পর্দায় দেখা যায়, সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুব স্বাভাবিক। তবুও, যে কথা অস্বীকার করলে চলে না – এখনও, নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ফিল্মের পর্দায় দেখা গাছ একটি সত্যিকারের গাছের ছবি, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ সত্যিকারের জলের ছবি। যতই পোস্ট প্রোডাকশনে কালার কারেকশন করা হোক না কেন, সত্যিকারের একটা গাছ আছে বলেই গাছের ছবিটার অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে – এই বক্তব্য অধিকাংশ কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই এখনও মিথ্যে হয়ে যায়নি।

চলচ্চিত্রে মেটাফর কাজ করতে না পারার প্রধান কারণ এইটিই। ফিল্মে দেখা গাছ, পাথর, জল সবার আগে গাছ, পাথর, জল হিসেবেই দর্শকের কাছে ধরা দেয়, তার পরে আসে তার প্রতীকি অর্থ (যদি কিছু থেকে থাকে)। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির ছবিকে যে কারণে এত বেশি ভুল বোঝাবুঝির সামনে পড়তে হয় – তাঁর ছবির ঐ অলৌকিক হাওয়া, বৃষ্টি কিংবা পরাবাস্তব ‘zone’ – সেগুলো অবশ্যম্ভাবী ভাবে কোনো কিছুর রূপক নয়, এ কথা তিনিই একাধিক জায়গায় বলে গেছেন। আব্বাস কিয়ারোস্তামি মনে করতেন, চলচ্চিত্রে রূপক ব্যবহার করলে দর্শকের কল্পনা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, পর্দায় দেখা মূর্ত বাস্তবতাকে কেবল খোলসে পরিণত করে তা কেবল আড়ালের অর্থ খুঁজতে উৎসাহিত করে। প্রেমের দৃশ্যে গোলাপফুল দেখানোর মতো নিকৃষ্টমানের রূপক ব্যবহার করা ছাড়া চলচ্চিত্রে রূপক খুব সফলভাবে কাজ করে না।

আমরা আমাদের চলচ্চিত্রপাঠের সময় এই বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন থাকবো – কিন্তু এও মাথায় রাখা প্রয়োজন, একটি টেক্সট তার শরীরে এমন কিছু চিহ্ন খোদাই করে রাখতে পারে, যেখান থেকে উৎসাহী দর্শক-পাঠক বেশ কিছু ভিন্ন পাঠের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন। বহু সময় একটি টেক্সট নানা বিষয়ে আকারে ইঙ্গিতে কিছু আভাস দিয়ে যায়, যা হয়তো সচেতন ভাবে স্রষ্টার তৈরি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেই আভাসের সূত্র ধরে ধরে পাঠক যদি নির্মাণ করে তোলেন তাঁর নিজস্ব পাঠ, স্রষ্টার অভিপ্রায় ব্যতিরেকে, তার নিজস্ব গুরুত্ব সবসময়েই থেকে যায়।

নোনাজলের কাব্য ছবিটি, সেই অর্থেই, আমার কাছে আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয়ের সামনে সমগ্র মানবজাতির অসহায়তার আভাস দিয়ে যায়। জলবায়ু বিপর্যয়ের সামনে আমাদের মানবসভ্যতার গাড়ি যে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে খাদের দিকে এগিয়ে চলেছে, সে বিষয়ে পৃথিবীর সমস্ত পরিবেশ বিজ্ঞানীরাই দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে চলেছেন। একুশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে বোঝা যাচ্ছে, বেশ কিছু ম্যাজিক না ঘটলে এ পৃথিবীর মাটি থেকে মানুষ নামক এই প্রজাতির নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে আর বেশীদিন সময় লাগবে না, সেক্ষেত্রে এই গ্রহের ষষ্ঠ Mass Extinciton-এর বলি হবে মানুষ – এবং একমাত্র ধ্বংস যেখানে কিনা ধ্বংসের কারণ হবে প্রজাতির নিজেরই খোঁড়া নিজেদের কবর

এমন অবস্থায় প্রতিরোধ, বিক্ষোভ, আন্দোলন – ইত্যাদি হওয়ার কথা, হচ্ছেও। কিন্তু কোনোদিনই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন না, বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয় না। নোনাজলের কাব্য ছবিটি সমুদ্রের উপকূলের গ্রামে গিয়ে প্রধান চরিত্রকে যেভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, আমার মতে, সেই নিষ্ক্রিয়তাকে পড়া যেতে পারে জলবায়ু বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মনুষ্যপ্রজাতির সামগ্রিক নিষ্ক্রিয়তার দ্যোতনা হিসেবে। অর্থাৎ যেভাবে চোখের সামনে ডাক্তার না দেখিয়ে একটি ছেলেকে মরে যেতে দেখে, একাধিক অন্যায় দেখেও রুদ্রকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে হয়, সেভাবেই প্রতিবছর এই গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেখতে দেখতে, বরফের চাঁই ভেঙে পড়ার খবর শুনতে শুনতে, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস না পাওয়া দেখতে দেখতে আমরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকি, রুদ্রর মতো নিজেদের বাক্সে ঢুকে গিয়ে অপেক্ষা করি অবধারিত ধ্বংসের। জলস্তর বাড়তে থাকার খবর, বছর বছর সাইক্লোন আসার খবর ছবিটি সূক্ষ্মভাবে আমাদের জানিয়েও যায়, কিন্তু জলে ভেসে থাকা মানুষের আর কোনো নিস্তারের খবর আসে না। পালিয়ে যাওয়ার এক অলীক, কার্যত অসম্ভব স্বপ্ন নিয়েই রুদ্র সারারাত অপেক্ষা করে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের সামনে মানুষের অসহায়তার এই দ্যোতনাকে ছবিটি কখনোই স্পষ্ট করে প্রকাশ করে না, কিন্তু আগে যেমন বেশ কিছু চিহ্নের কথা বলছিলাম – চাইলেই আমরা সেরকম কিছু চিহ্ন খুঁজে পেতে পারি। যেমন ধরা যাক, ছবির টাইটেল কার্ডেরও আগে থাকা একদম শুরুর শটটার কথা। মানুষের আকৃতির এক ভাঙাচোরা কাঠামো পড়ে রয়েছে সমুদ্রের তীরে, আর তার দিকে ধেয়ে আসছে একের পর এক ভয়াল ঢেউ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাঠামোটি অদৃশ্য হয়ে যায় পর্দা থেকে – বরং ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে দেখতে থাকা সমুদ্র ক্রমশঃ হিংস্র আর ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে। ছবিটা পুরোটা দেখে উঠে আমরা এই শটটির আখ্যানগত তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারি – কিন্তু ছবির শুরুতেই এই শটের উপস্থিতি, বিশেষ লেন্সের ব্যবহারে জলের স্রোতকে এই হিংস্র, ভয়াল আকৃতি দেওয়া, এবং শটটির দৈর্ঘ্য – অর্থাৎ কাঠামো ভেসে যাওয়ার পর যতক্ষণ ধরে শুধুমাত্র ঢেউ ভেসে আসতে দেখা যায়, ততক্ষণে এই চিহ্ন অবলম্বন করে নানান পাঠের সম্ভাবনা তৈরী হয়ে যায়। জল, বন্যা এবং আসন্ন দুর্যোগ আর শুধুমাত্র আখ্যানের পরিসরে আটকে থাকে না, বরং ছিটকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর দুর্যোগের আভাস দিতে থাকে। 

ছবির শেষ শট

একইভাবে ধরা যাক ছবির শেষ শটটির কথা। দুর্যোগে আটকে থেকে রিলিফ সেন্টারে আল্লার নাম জপ করছেন গ্রামের সমস্ত মানুষ, এদিকে রুদ্র আর টুনি বদ্ধ হয়ে রয়েছে সেই বিরাট বাক্সের ভিতরে। এ লেখার শুরুতেই যা বলেছিলাম – ছবিটি এই অংশে হঠাৎ শেষ হয়ে যায় – এর পরে বন্যা তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, নাকি অনাত্মীয় নারী-পুরুষের একসাথে রাত কাটানোর অপরাধে তাদের গণপিটুনিতেই মরতে হবে, তার আশঙ্কাটুকুই থেকে যায় দর্শকের মনে। বাক্সের মধ্যে আটকে থেকে অল্প কথাবার্তা, মাঝে মাঝে হাসি গল্প করতে করতে রুদ্র আর টুনি হঠাৎ কোনো অজানা শব্দ শুনতে পায় – তৎক্ষণাৎ কাট করে আমরা ছবির শেষ শটটিতে আসি। সেই ঘননীল রাত্রির ভয়াল সমুদ্রতট, দুইপাশে দুই গাছের মাঝে প্রায় সুররিয়াল চিত্রকলার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে অতিকায় সেই বাক্স। শোঁ শোঁ হাওয়া তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে গাছের চঞ্চল পাতায় এবং সাউন্ডট্র্যাকে – অন্যদিকে সমুদ্রের চাপা গর্জন ফুঁসছে বাক্সের ঠিক ঐ প্রান্তেই। এই শটে এসে যেন শুধুমাত্র আর প্রধান চরিত্রই নয় – সমস্ত ছবিটিই তার ঘটমান বাস্তবতার সামনে নতজানু হয়ে হার স্বীকার করে নেয়, বুঝতে পেরে যায় কোনোভাবেই সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তার এবার শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের – তাকে দর্শকের কল্পনার উপরেই ছেড়ে দেন পরিচালক। 

এই দুটো শট – চাইলে ছবির মধ্যবর্তী অংশ থেকেও হয়তো আরও কিছু শট খুঁজে পাওয়া যাবে, যা খানিকটা আভাসে ইঙ্গিতে মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারাই অনুঘটকের মতো ঘটে চলা, অথচ যা আর মানুষের হাতে নেই – সেই জলবায়ু বিপর্যয়ের ভয়াল ভবিষ্যতের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য – ছবিটি স্পষ্ট করে এ কথা বলে না, রেখে যায় শুধু ইঙ্গিত। মানুষ এবং না-মানুষী জগতের মধ্যে ঘটে চলা যে ভয়াবহ বিচ্ছেদের কথা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন দার্শনিক/বৈজ্ঞানিকরা, তারই যেন একচিলতে শৈল্পিক প্রকাশ দেখি এ ছবিতে। কারও কারওর হয়তো মনে পড়তে পারে উনিশ শতকের এক বাঙালির লেখা সেই অমোঘ সাবধানবাণী, যা কোনোদিনই আমরা গুরুত্বসহকারে শোনার প্রয়োজনবোধ করিনি – “অন্যে বাক্য কবে, কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর / মনে করো, শেষের সে দিন ভয়ংকর”।  

টীকাঃ

১) একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বানানো একটি সমকালীন পটভূমির ছবিতে একবারও স্মার্টফোন দেখা যায় না কেন, সেই প্রশ্নটা রেখে যাওয়া দরকার।

২) গোটা উপন্যাসটি যে একটি রূপক, তার ইঙ্গিত দেওয়া আছে উপন্যাসের একদম শুরুতে উদ্ধৃত করা ড্যানিয়েল ড্যাফো লিখিত রবিনসন ক্রুসো-র ভূমিকা থেকে। বলা বাহুল্য, রবিনসন ক্রুসো উপন্যাসেও ঠিক এই জিনিসটিই করা হয়েছিল – “It is as reasonable to represent one kind of imprisonment by another, as it is to represent anything that really exists by that which exists not”.

৩) যদিও মূলধারার ছবির সাপেক্ষেই এর ব্যতিক্রম আছে, তবে সেইক্ষেত্রে পরিচালক নিজেই টীকাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলে দিয়েছেন ছবিটি আসলে অমুক একটি বিষয় নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে বিখ্যাত জুরাসিক পার্ক ছবির সিরিজ বা সদ্য নির্মিত ডোন্ট লুক আপ (২০২১) – যেখানে যথাক্রমে ডাইনোসর ক্যাপিটালিজমের প্রতীক এবং ধেয়ে আসা অ্যাস্টেরয়েড ক্লাইমেট ক্রাইসিসের প্রতীক হিসেবে পরিচালকরা নিজেরাই ব্যাখ্যা করে গেছেন।

৪) Siegfried Kracauer, Theory of Film: Redemption of Physical Reality. p l, Princeton University Press, 1997.  

৫) পরিভাষায় একে বলে ইনডেক্সিকাল রিলেশনশিপ। আমেরিকান ভাষাতাত্ত্বিক C. S. Pierce যে কোনো সাইনের ক্ষেত্রে সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েডের মধ্যে তিনরকম সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যার মধ্যে একটি ইনডেক্সিকাল। এই ক্ষেত্রে সিগনিফায়ার আর সিগনিফায়েডের মধ্যে একটি জৈব সম্পর্ক থাকে। যেমন আঙুলের ছাপ – এখানে জ্যান্ত একটি আঙুল না থাকলে আঙুলের ছাপ তৈরী হওয়া সম্ভব না। ফটোগ্রাফিও এই গোত্রের সাইনের মধ্যেই পড়ে। এই লিংকে বিষয়টি বিশদে পাওয়া যাবে।

৬) কোনো প্রজাতির অর্ধেকের বেশি সংখ্যক প্রাণী যখন অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংসের মধ্যে পড়ে, সেই অবস্থাকে বিজ্ঞানীরা mass extinction বলেন। জীবাশ্মের অবস্থান দেখে জানা গেছে, এর আগে পৃথিবীতে পাঁচবার এইরকম mass extinction হয়েছে, যার পঞ্চম তথা শেষ উদাহরণ ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে অ্যাস্টেরয়েডের প্রকোপে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ডাইনোসরের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা এই মুহূর্তে ষষ্ঠ mass extinction-র মধ্যে দিয়ে আছি।

৭) বহু দার্শনিক, চিন্তক, বিজ্ঞানীরাই এই প্রসঙ্গে সহমত – মানুষের তৈরী বিশেষ এই অর্থনৈতিক অবস্থা, পুঁজিবাদ, তাই বর্তমান mass extinction-র জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। এই প্রসঙ্গে Naomi Klein-র বই This Changes Everything: Capitalism Vs. The Climate র নাম করা যেতে পারে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s