আড্ডায় ওয়েস্টার্নঃ সঙ্গে অরূপরতন সমাজদার (পর্ব ১)

সোনার কেল্লা উপন্যাসে থর মরুভূমির বুক চিরে রামদেওরার ট্রেন যখন সদর্পে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং শব্দ করে ছুটে যাচ্ছিল, তখন তোপসের মনে হয়েছিল – “এমন অদ্ভুত ট্রেন একমাত্র হলিউডের ‘ওয়েস্টার্ন’ ছবিতেই দেখেছি, এ দেশে কোনওদিন দেখিনি, দেখব ভাবিওনি।” সোনার কেল্লা ছবিতে যখন ওই বিশেষ দৃশ্যটি দেখানো হয়, তখন আমরা যারা হলিউড ছবির পোকা – তাদেরও কল্পনায় ভারতবর্ষের রাজস্থান আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা একাকার হয়ে যায়। হলুদ মরুপ্রান্তরের ওপর বিস্তৃত নীল আকাশ, তার ওপর কালো ধোঁয়া উগরে দিয়ে সবেগে এগিয়ে আসছে কালো রেলগাড়ি, আর উটে চড়ে তার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু। এখানে উটের জায়গায় ঘোড়া বসিয়ে দিলে গড়পড়তা একটি ওয়েস্টার্নের থেকে একে আলাদা করার আর কোনো উপায়ই থাকত না। এরকম দৃশ্য আরো অনেক অনেক ছবিতে আমরা পাই, এবং ওয়েস্টার্নের আইকনোগ্রাফির সাথে কিছু মিল থাকার জন্য খুব সহজেই তারা আমাদের মনে দাগ কেটে যায়।

কিন্তু ওয়েস্টার্ন মানেই তো কেবল তার আইকনোগ্রাফি নয়। রেলগাড়ি, ধূ ধূ প্রান্তর আর ঘোড়া ছোটানো কাউবয় থাকলে আমাদের মাথায় ওয়েস্টার্ন নামক আইডিয়াটি ভেসে ওঠে বটে, কিন্তু শুধু সেটুকু দিয়ে তো ওয়েস্টার্ন ফিল্ম-কে বোঝা যায় না। ওয়েস্টার্ন ফিল্ম বলতে আমরা মূলত বুঝি ফিল্মের বিশেষ এক ধরণের ঘরানা বা ‘জঁর’, যা মূলত সিনেমার ইতিহাসের একদম সূচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে শুধুমাত্র সিনেমার ইতিহাসই নয়, ওয়েস্টার্ন ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোটা একটি দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার নির্মাণের ইতিহাস। 

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপিয়ানরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উপনিবেশ গড়তে শুরু করে, আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতোই এখানেও ক্রমাগত হিংস্রতা এবং গণহত্যা ছিল উপনিবেশ নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার। আমেরিকার মাটিতে বসবাসকারী আদি বাসিন্দারা, সাদা চামড়ার সাহেবরা যাঁদের নাম দিয়েছিলেন রেড ইন্ডিয়ান, তাঁদের নিজেদের মাটি থেকে হটিয়ে দিয়ে ক্রমশ সাদা চামড়ার ‘সভ্যতা’র পত্তনের ইতিহাসকেই ‘মিথ’ আকারে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ করে এসেছে ওয়েস্টার্ন জঁর, যার মধ্যে রয়েছে, গান-গল্প-উপন্যাস-ছবি। আমেরিকার পশ্চিমপ্রান্তের এই রুক্ষ পাথুরে প্রান্তর, যেখানে নিয়মকানুনহীন এক ‘অসভ্য’ পরিসরকে ‘সভ্য’ করতে চলেছে সাদা চামড়ার সাহেবের দল – ওয়েস্টার্নের মিথ নির্মাণের মূল উপকরণ এটাই। পাথুরে জমিতে গজিয়ে ওঠা সেই শহরের বিচিত্র অধিবাসীদের (যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র কাউবয়, শেরিফ, মার্শাল) জীবনযাপনে প্রকৃতির রুক্ষতা ছাড়াও বাধা হিসেবে ছিল দুই গোত্রের মানুষ – আইনের শাসন মানতে না চাওয়া আউটল (outlaw) এবং অবশ্যই ‘রেড ইন্ডিয়ান’, অর্থাৎ আদিবাসী মানুষেরা। ওয়েস্টার্ন-ফিল্ম এই পরিসরে নির্মিত হওয়া মিথের নানান বিচিত্র গল্প বলে, যেখানে প্রথম যুগের নির্দ্বিধায় রাষ্ট্রনির্মাণ প্রক্রিয়া উদযাপনকারী ছবি থেকে শুরু করে ক্রমশ ধূসর, অন্ধকারাচ্ছন্ন, হিংস্র (যাকে পরবর্তীকালে রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্ন বলা হয়) হয়ে ওঠা ছবি দেখতে পাওয়া যায়

ওয়েস্টার্ন ফিল্মের এই ইতিহাসেরই হদিশ পেতে চেয়েছিল কাউন্টার শট, তাই আমরা গিয়েছিলাম শ্রী অরূপরতন সমাজদারের কাছে। কলকাতায় বাস করে যাঁরা দেশবিদেশের সিনেমা নিয়ে, বিশেষত জঁর ফিল্ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে চর্চা করছেন, অরূপরতন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির। এককালে তিনি একটি ওয়েব পোর্টালে নিয়মিত চলচ্চিত্র সমালোচনা করতেন; বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ের গবেষক এবং ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটিতে একই বিষয়ের অধ্যাপক। সোশাল মিডিয়াতেও অবরে-সবরে তাঁর কিছু লেখা আমরা পাই, যার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে ওয়েস্টার্ন নিয়ে তাঁর চমৎকার কিছু অবসার্ভেশন। সেই লেখালিখির সূত্র ধরেই ওয়েস্টার্ন জঁর নিয়ে আমাদের এই আলোচনা এগিয়েছে, যার প্রথম পর্ব প্রকাশিত হল এই অংশে। 

সায়ন্তনঃ অরূপদা, আমরা আলোচনাটা যদি শুরু করি এইভাবে, যে আমাদের, মানে বাঙালিদের মুখ্যত আমেরিকা নিয়ে সাধারণ ধ্যানধারণার জায়গাটা ঐ মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদ –

অরূপরতনঃ হ্যাঁ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ খুব খারাপ, তাই মার্কিনি সবকিছু খুব খারাপ, তাই মার্কিনি কিছু আমরা দেখিও না, জানিও না – একটা আত্মশ্লাঘা। আমরা এটাই সাধারণত ভেবে নিয়ে খুব খুশি থাকি।

সায়ন্তনঃ আমরা যেহেতু ওয়েস্টার্ন নিয়ে কথা বলতে চলেছি, যেখানে ওয়েস্টার্ন জঁরের ভিত্তিটাই তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক নেশন-স্টেট নির্মাণের গল্প। তাই সেই গল্পের মতোই, ওয়েস্টার্নের প্রাথমিক প্রেক্ষিতটাই, যাকে বলে ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’, সেটাও তো একটা বড় সমস্যা – যে কারণে শুরুর দিকে আমারও ছবিগুলোর সঙ্গে এনগেজ করতে সমস্যা হত।

অরূপরতনঃ হ্যাঁ, এখন তো অবধারিত ভাবেই খারাপ লাগারই কথা।

সায়ন্তনঃ আর তার কারণটা তো ভুলও নয় – কিন্তু তার মধ্যেও যে নুয়ান্সটা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি …

অরূপরতনঃ দেখ, নুয়ান্স থাকতেই হবে তা তো নয়। প্রথমত আমার কথা হচ্ছে যে একটা ফিল্ম তো খুব ভালো ভাবে তৈরী। যেমন ধর, পিকাসোর ছবিটা তো খুব ভালো। এবার এইখান থেকে গোটা বিষয়টা সেই শিল্পী-শিল্প তর্কের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। সেটার মধ্যে আমরা আপাতত ঢুকছি না, কিন্তু দ্বিতীয় একটা পয়েন্ট আছে। আমি যে ছবিটা দেখছি, সেটার সঙ্গে আমাকে যে সবসময় ইডিওলজিক্যালি সহমত হয়েই থাকতে হবে, সেই কনসেনশাসের জায়গা থেকেই যে সবসময় একটা ছবি দেখবো বা বই পড়বো বা একটা সিম্ফনি শুনবো – এরকম ভাবে তো শিল্পের সঙ্গে এনগেজমেন্ট কাজ করে না। আমি যেটা বলতে চাইছি, আমেরিকাকে বুঝতে গেলে, ওয়েস্টার্ন বোঝাটা প্রায় বাধ্যতামূলক। এটা প্রায় হলপ করে বলা যায়, ওয়েস্টার্ন না বুঝলে আমেরিকা বিষয়টা বোঝা যায় না। আর এটা আমিও বলছি না – আমার থেকে অনেক জ্ঞানী লোকেরা বেশ সিরিয়াসলি বলে গেছেন, যার সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি। বিশেষ করে, আমরা যে এই পোস্ট-গ্লোবাল, নিও-লিবারাল কন্ডিশনে আছি, সেখানে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির কেন্দ্রবিন্দু আমেরিকা। আর সেই সূত্রে আমেরিকা প্রায় সারা পৃথিবীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর সচ্ছন্দে ছড়ি ঘোরাতে পারে। এই অবস্থায় আমেরিকাকে না বোঝাটা খানিকটা বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মতন। সেটা ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক – এমনকি আমরা যদি প্রতিবাদ মিছিলও বের করি, কেন আমেরিকা সিরিয়ায় বোমা ফেলছে – তখনও কিন্তু আমাদের আমেরিকাকে বুঝতে হবে। আমেরিকা কেন সিরিয়ায় বোমা ফেলছে আর অর্জুন সিং কেন ব্যারাকপুরে বোমা ফেলছে – এই দুটো কিন্তু কখনোই এক জিনিস না। বোমা ফেলা খুব খারাপ তাই আমরা সবটারই একই সূত্রে প্রতিবাদ করবো – এই যুক্তিতে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা যায় না। তাই সমকালীন সময়ে, আমার মতে যে কোনো চিন্তাশীল মানুষের দায়বদ্ধতা আছে আমেরিকাকে বোঝা, সেই কাজটা করতে গেলে কয়েকটা ফান্ডামেন্টাল জায়গা আছে যেগুলো দেখতে হয় – তার মধ্যে একটা অবশ্যই ওয়েস্টার্ন।

সায়ন্তনঃ অবশ্যই। আমরা তো আলোচনা শুরু করছি প্রথমদিকের ওয়েস্টার্ন নিয়ে, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই নেশন-স্টেট নির্মাণের বীরগাথাকে উদযাপন করা হচ্ছে, অর্থাৎ সাদা চামড়ার মানুষ কীভাবে নেটিভ আমেরিকানদের হটিয়ে ‘সভ্যতা’ পত্তন করছে। কিন্তু এর মধ্যেও, তুমি একবার কথা প্রসঙ্গে বোধহয় বলেছিলে, জন ফোর্ডের একদম প্রথম দিককার কিছু ছবি – স্টেজকোচ (১৯৩৯)-এর সময়কার – এরকম কিছু জায়গা আছে যে কোনো কোনো শটে মূল অ্যাকশন-টা হয়ে গেছে, সেখানে নেটিভ আমেরিকান কেউ, সে শুধু তাকিয়ে বসে আছে।

অরূপরতনঃ মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন (১৯৪৬)…

সায়ন্তনঃ হ্যাঁ ঠিক। আমি যেটা ভাবছিলাম, জন ফোর্ডের পরের দিকের ওয়েস্টার্ন ছবিতে, শায়ান অটাম (১৯৬৪) জাতীয় ছবি ধরো, যেখানে উনি স্পষ্টভাবে অ্যান্টি-কলোনিয়াল, অ্যান্টি-হোয়াইট একটা অবস্থান নিচ্ছেন, যেটা ওঁর প্রথমদিকের ছবির মতাদর্শের একেবারে বিপরীতে। কিন্তু প্রথমদিকের ছবি গুলো – যেখানে এই তথাকথিত ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ আদর্শগত অবস্থানটা নেই, সেগুলো বোধহয় আমাদের কাছে আরও আগ্রহের – সেইরকম ছবিতে, যেখানে মূলত রাষ্ট্রনির্মাণের বীরত্বের কথাই বলা হয়, সেখানেও যখন এরকম নেটিভ আমেরিকান কেউ চুপচাপ চেয়ে বসে থাকে, তাকে ঠিক কীভাবে পড়া যায় বলে তোমার মনে হয়?

অরূপরতনঃ প্রথমত তো সেই চিরাচরিত প্রশ্নটা করাই যায় – জন ফোর্ড কি এটা ভেবে বানিয়েছিলেন? এই ধরণের প্রশ্ন আমরা এত এত শুনেছি, নিজেরাও হয়তো ছোটবেলায় করেছি – এই অথর এবং অথোরিয়াল ইণ্টেনশনের প্রসঙ্গটা নিয়ে এখন কথা বলা অসম্ভব। সেটা হয়তো ফোর্ড বেঁচে থাকলে ওঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, এবং উনি সাধারণত যে ধরণের উত্তর দিতেন, তাতে এরকম প্রশ্ন করলে প্রায় লাথি মেরে বোধহয় বের করে দিতেন! এমনিতে ওঁর সাক্ষাৎকারে যা দেখা যায়, উনি মার্টিন স্করসেসে, পিটার বোগদানোভিচ বা স্পিলবার্গের প্রশ্নের পরে এমন এমন সব উত্তর দিয়েছেন, সেখানে আমার ধারণা উনি সায়ন্তন বা অরূপরতন – এঁদের খুব একটা পাত্তা দিতেন না! ফলে এর তো কোনো সদুত্তর পাওয়া সম্ভব নয়, তাই ইন্টেনশনালিটির প্রশ্নে যাওয়ার মনে হয় খুব একটা মানে হয় না।

পিটার বোগদানোভিচ-কে উত্তর দেওয়ার (বা না দেওয়ার) সময় জন ফোর্ড

এইবার, বাকিটা হচ্ছে ছবিটাকে ভালোমতো পড়া। এই পড়ার প্রক্রিয়াটা তো সবসময়ই ইডিওলজি দ্বারা প্রভাবিত, অর্থাৎ আমি কোন জায়গা থেকে পড়ছি, কী পড়ছি – সেটা। এটা তো হেগেলিয়ান একটা জগৎ নয়, যেখানে সবকিছুই লেখা আছে, আর তোমার কাজ হল স্রেফ দেখে দেখে পড়ে ফেলা। এটা এতটা প্যাসিভ বিষয় নয়। এখানে পড়া বা রিডিং মানে হচ্ছে, দেরিদা যাকে পরবর্তীকালে বলেছেন কনজিওরিং, তাঁর স্পেকটার্স অফ মার্ক্স বইতে। তুমি আসলে একটা ভূত তৈরি করছ। একটা অবয়বহীন জিনিস আছে- তোমার রিডিঙের ফলে সেটা একটা অবয়ব ধারণ করে – বিষয়টা এভাবে একটু ভাবা যাক। ঠিক যেমন ভূত হন্ট করে – তেমনই মিনিং-টিনিং ইত্যাদি টেক্সটকে হন্ট করে বেড়াচ্ছে। তোমার কাজ হচ্ছে এক্সরসিস্টের মত তাকে কনজিওর করা – একটা অবয়ব দেওয়া। ঠিক যেমন হ্যামলেট নাটকের প্রহরী বাবাকে প্রথম দেখতে পেল, তারপর খবর দিল হোরেশিওকে। তারপর এরা সবাই মিলে গেল, হ্যামলেট বলল, দেখা দাও, কথা বলে ওঠো। বাবা/রাজা তখন শিরস্ত্রাণের মধ্যে থেকে কথা বলে উঠলেন। ভাইসার আছে, শিরস্ত্রাণ-বর্ম, ঢাল তলোয়ার সবই আছে, অথচ রাজাকে দেখা যাচ্ছে না, তিনি অদৃশ্য। কথা বলিয়ে দেওয়ার কারণেই রাজার উপস্থিতি তৈরি হচ্ছে। রিডিং তো এরকমই একটা প্রক্রিয়া। অর্থ আছে আর সেটা পড়ে ফেললাম- ব্যাপারটা এত সরল নয়। ফলে সেই জায়গা থেকে ইমেজ সাউন্ড ন্যারেশন ইত্যাদি, একটা ছবির ফর্ম- এসব দেখে আমরা কী বুঝছি, কী জানছি, কী দেখতে চাইছি- অর্থাৎ, কী ভাবে পড়ছি – এটাই মোদ্দা কথা।

জাঁক দেরিদার লেখা স্পেক্টার্স অফ মার্ক্স বইয়ের মূল ফরাসী প্রচ্ছদ

এই বিষয়টা মাথায় রেখে যদি মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইনের জায়গাটা ভাবা যায়… দুটো দৃশ্যের কথা ধরা যাক। একটি দৃশ্য ছবির মুখ্য চরিত্র, অর্থাৎ ওয়াইট আর্প আর তার ভাইদের নিয়ে, অন্যটি ফিল্মের নামকরণ যার নামে সেই ক্লেমেন্টাইন কার্টারকে নিয়ে। ক্লেমেন্টাইন কার্টার তার প্রেমিক, ডক হলিডের সন্ধানে এসেছে সুদূর ইস্ট থেকে, স্টেজকোচে চেপে। শটটা নেওয়া হচ্ছে বারান্দা থেকে, তাতে রাস্তাঘাট ল্যান্ডস্কেপ ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। স্টেজকোচটা ফ্রেমের বাঁ দিক দিয়ে ঢোকে, তারপর থমকে দাঁড়ায়। ক্লেমেন্টাইন স্টেজকোচ থেকে নামে, কিছু কথোপকথন হয় ওয়াইট আর্পের সঙ্গে – এগুলো আমরা ফোরগ্রাউন্ড এবং মিডগ্রাউন্ডে দেখতে পাচ্ছি। এখানে লক্ষ্য করবে, নায়ক নায়িকার পিছন দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে তিনজন ইন্ডিয়ান ঘোড়ায় চড়ে হেঁটে চলে যায়। এখানে ক্লেমেন্টাইন কার্টার ক্যামেরার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়ান ঘোড়সওয়ারদের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে –

মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন-র সংশ্লিষ্ট দৃশ্য – মিডগ্রাউন্ডে ঘোড়ায় চেপে চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান সওয়ারি

সায়ন্তন: ফোর্ডের স্টেজকোচ ছবিতেও এরকম একটা দৃশ্য ছিল, যতদূর মনে পড়ছে…

অরূপরতন: স্টেজকোচে একটু অন্যরকম ব্যাপার ছিল- ছবির শুরুর দিকে একটা দৃশ্যে একজন ইন্ডিয়ানের ক্লোস আপ দেখা যায়, এবং এটাই স্টেজকোচ ছবির প্রথম আইসোলেটেড ক্লোস আপ। মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইনের আরেকটি দৃশ্যে, যেখানে গল্পটা একটা স্থিতাবস্থায় পৌঁছেছে, যখন ওয়াইট আর্প শেরিফ হয়ে বসেছে, এর ঠিক পরের সিকোয়েন্সে একটা শট আছে, যেখানে ওয়াইট আর্প (হেনরি ফন্ডা) এবং তার দুই ভাই ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যায় – এরা হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই, তাদের একদম পিছন পিছন দু’জন ক্যারেকটার ঢোকে – দু’জন ইন্ডিয়ান।

স্টেজকোচ ছবির প্রথম ক্লোজ আপ
দুজন ইন্ডিয়ান ফ্রেমে বসে আছেন

এটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটা দিক হল ফোর্ডের নিজস্ব স্টাইল, যেখানে চরিত্রের মত ল্যান্ডস্কেপও সমান গুরুত্ব পেয়ে যায়। অর্থাৎ যাকে চরিত্র-নির্ভর আখ্যান বলে, যেখানে চরিত্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে কাট হয়, বা সে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেলে কাট হয়- সেই গতে বাঁধা ছকে ফোর্ড হয়তো যাচ্ছেন না। আমরা নেহাত ফোর্ডের সিনেমার হিস্টোরিকাল-ইডিওলজিকাল রিডিং করতে চাইছি বলে এই দুটো দৃশ্য নিয়ে কথা বললাম। হয়তো অন্য কোনো জায়গায় দেখব যে সেখানে ইন্ডিয়ান নেই, এতদসত্ত্বেও ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে চরিত্র ছাড়াও অন্য ডিটেলের দিকে নজর যাচ্ছে।

সায়ন্তন: আবার কোথাও কোথাও দেখব যে ঠিক চরিত্রের অ্যাকশনের ওপর নির্ভর করেই কাট হচ্ছে।

অরূপরতন: এখানে দেখতে হবে যে কাটটা ছবির ঠিক কোন মুহূর্তে হচ্ছে। ধরা যাক স্টেজকোচ ছবির শেষে যখন ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে দ্বৈরথ হয়, তখন তো আর সময় নিয়ে নিয়ে আন্তোনিওনির মত কাট হচ্ছে না, যেমনটা আমাদের এখানকার ইন্ডি পরিচালকরা করে থাকেন। তাছাড়া আমরা ভালোভাবেই জানি যে জন ফোর্ড ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন, তিনি কখনওই ওয়েস্টের ইতিহাস আর ল্যান্ডস্কেপে ইন্ডিয়ানদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবেন না। ফোর্ডের সিনেমার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব ওয়েস্টের মিথে শ্বেতাঙ্গ আর ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে যে ক্ষমতার সমীকরণ – সেটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ছবির পর ছবিতে। স্টেজকোচ থেকে শায়ান অটাম পর্যন্ত ফোর্ডের ছবিগুলো খুঁটিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই এই পরিবর্তনটা টের পাওয়া যাবে। আমার ধারণা এই ধরণের রিসার্চ থেকে ফোর্ডের কাটিং স্টাইলটাও আরো স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

এইবার, আমরা যদি একধরণের ফোর্ডকে খাড়া করতে চাই, তাঁকে কনস্ট্রাক্ট করতে চাই রিডিঙের মাধ্যমে- তখন এই চয়েসের প্রশ্নটা বড় হয়ে যায়। অর্থাৎ, ওই শটের শেষে কয়েকজন ইন্ডিয়ানকেই রাখা হল কেন? দুটো ঘোড়াও তো বাঁধা থাকতে পারত।

সায়ন্তনঃ তাছাড়া এটা তো রীতিমত স্টুডিও প্রোডাকশন, কোনো ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি নয়!

অরূপরতনঃ হ্যাঁ, আর রোসেলিনি, ডিসিকা বা জাভাতিনির মত কোনো নিওরিয়ালিস্ট প্রোজেক্টও নেই ওঁর। এগুলো তো বড়সড় প্রেস্টিজ প্রোডাকশন, বি মুভিও নয়। তাহলে সেখানে এই জিনিসটা কেন থাকছে? সেক্ষেত্রে কেবল ইতিহাস সচেতনতা দিয়েই প্রশ্নটার সদুত্তর দেওয়া যায় – তবেই আমরা স্টেজকোচ থেকে শায়ান অটাম পর্যন্ত যে ট্র্যাজেক্টরিটা তৈরি হয়েছে, তার সপক্ষে একটা যুক্তির ভিত্তি পাব। এটা বার বার বলে রাখা ভালো, যে এখানে ইনটেনশনালিটি, অথবা ছবি করার সময়ে পরিচালকের সচেতন উদ্দেশ্য-কে অনর্থক গুরুত্ব দেওয়ার কোনো যুক্তি হয় না। ফোর্ড ১৯৪৬ সালে ভাবেননি যে ১৯৬৪ সালে উনি শায়ান অটাম নামে একটি ছবি বানিয়ে আমেরিকার উপজাতিদের রিডিম করবেন। এই ধরণের পাঠগুলো খুবই বিভ্রান্তিকর। বরং বলা যায় – এই যে ল্যান্ডস্কেপ এবং ইন্ডিয়ান – এর মধ্যে যে গ্রেন অফ ট্রুথ আছে, সেটা জন ফোর্ডের কাছে কোনো না কোনো ভাবে অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। জন ফোর্ড তার পরে সেখান থেকে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠার গল্পে যাচ্ছেন, সেটা তাঁর ছবির একটা ইডিওলজিকাল প্রজেক্ট, যার একটা টার্নিং পয়েন্ট – আমার ধারণা – দা সার্চার্স (১৯৫৬)। এই ছবিটা রেস-এর প্রশ্নে হঠাৎ অত্যন্ত সচেতন হয়ে ওঠে।

দ্য সার্চার্স

অভিষেকঃ আমি একটু ডাইগ্রেস করে যাচ্ছি…আমার সত্যজিৎ রায়ের একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, জন ফোর্ড-কে নিয়েই লেখা, প্রবন্ধের শেষে ফোর্ট অ্যাপাচে (১৯৪৮) ছবির একটা পার্টিকুলার শটের কথা উনি বলছেন, যেখানে জন ওয়েইন খাদের ধারে দাঁড়িয়ে একটা বোতল ছুঁড়ে ফেলবে, আর অনেকক্ষণ পরে তার চুরমার হয়ে যাওয়ার আওয়াজ আসবে। এটা একধরণের ন্যাচারালিস্ট ডিটেলিং বলা যায়, যেটা সত্যজিৎ ঠিক ঐ জায়গায় আবিষ্কার করছেন। এই ধরণের ডিটেলিং, যাকে অনেক সময় লিরিসিসম বলা হয়, সেটা খুব স্পষ্টভাবে জঁ রেনোয়ার ছবিতে আমরা পাই, যেখানে ক্যামেরা মূল আখ্যান থেকে সরে গিয়ে অন্য কিছু দেখে। এই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় পরবর্তীকালে আন্তোনিওনি প্রভৃতির ছবিতে, যেখানে ক্যামেরা চরিত্রদের থেকে এতটাই দূরে সরে যায় যে পুরো ছবিটাকেই ভাঙাচোরা মনে হয়, একটা ফ্র্যাগমেন্টেড স্ট্রাকচার চলে আসে। এই রিডিং গুলো, তোমার কথা অনুযায়ী, টেক্সটের মধ্যে যে সব (মিনিঙের) ভূতগুলো রয়েছে, তাদেরকে রিডিম করার চেষ্টা। এর পিছনে কি কোনো ডিসায়ার বা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে- নতুন সিনেমার ডিসায়ার? ধরো কাহিয়ে দু সিনেমার প্রথম যুগে হলিউড পড়ার প্রোজেক্টটা যদি ধরি…

ফোর্ট অ্যাপাচে ছবির সেই দৃশ্য

অরূপরতনঃ হ্যাঁ, সে তো বটেই, দেরিদার স্পেক্টার্স অফ মার্ক্সের প্রোজেক্টটার কথা ভাবলেই তো এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যখন বইটা উনি লিখছেন, তখন সোভিয়েত ডিসলভ করে গেছে, বার্লিন ওয়াল ভেঙে গিয়ে জার্মানি আবার জুড়ে গেছে — এরকম একটা সময়ে সবাই বলতে শুরু করল ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি’। এক ধরণের লিবারাল ডেমোক্রেসি, পুঁজিবাদ আর ফ্রি মার্কেট- এটাই যেন অবধারিত, মনুষ্যসভ্যতা আর ইতিহাসের গতিমুখ যেন এই দিকেই অগ্রসর হয়েছে। দেরিদা এখানে উল্টোপথে হাঁটলেন। প্রথমত, এই যে একটা কথা চালু হয়েছিল, যে Communism discredited, অতএব Marxism discredited, অতএব Marx discredited—এটা একটা পাতি সরলীকরণ। দ্বিতীয়ত, পার্টির হোতাদাদারা, মানে ধরো স্টালিন বা খ্রুশ্চেভ – পার্টির অন্য দাদারা, মানে আমাদের যেমন দাদা টাদা আছেন ফ্ল্যাটে ডেকে লেনিন বোঝান — তার সাথে স্টেট এবং পার্টি- এরা এতদিন মার্ক্সের মিনিং কী, সেটা খুব আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে দিতেন, তার বহুবিধ সম্ভাবনাগুলোকে সীমাবদ্ধ করে দিতেন। সোভিয়েতের পতনের পর দেরিদার মনে হল যে মার্ক্স সেকেলে তো হন নি, বরং কমিউনিস্ট স্টেট, ব্লক বা পার্টির এই হোতা-দাদাদের অনুপস্থিতিতে এটাই হল মার্ক্সকে ফিরে পড়ার আদর্শ সময়।

ছোটোবেলায় শুনতাম, মার্ক্সবাদই সত্য কারণ ইহাই বিজ্ঞান। যদি বিজ্ঞান বা সায়েন্সের নিরিখেই বিচার করি, তবে তো মিনিং একজায়গায় আটকে থাকতে পারে না। অন্তত আইনস্টাইন আর কোয়ান্টাম থিওরির পরে এমন দাবি করা যায় না। মিনিং একটা স্থিতাবস্থায় আটকে থাকে না, তাকে তো আমরা তৈরি করা, একটা act of reading এর মাধ্যমে। এবার কী পড়তে চাইছি তার নিশ্চয়ই একটা লজিকাল মেথড থাকবে। সেটা একেবারে মাথামুন্ডুহীন তো হতে পারে না, আমি তো বলতে পারি না যে জন ফোর্ড শিশুশ্রম নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। এখানে গল্পের গরুকে গাছে তোলার কথা হচ্ছে না। আমরা মনগড়া কথা বলছি না- পড়ছি, সেই পড়ার একটা বেসিস থাকা যাই। এখানে ‘পড়া’ শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আমি মনগড়া কথা বলছি না, আমি পড়ছি। আক্ষরিক অর্থেই যেমন আমরা বই, খবরের কাগজ বা হোর্ডিং পড়ি। এভাবেই, ধরা যাক, আমরা মিজঁসিন দেখতে দেখতে এগোচ্ছি, তার সঙ্গে প্রোডাকশানের ইতিহাস পড়ছি, আর পাশাপাশি ফোর্ডের অন্যান্য ছবিগুলো পড়ছি। খেয়াল রাখতে হবে আমাদের আলোচনার যেন একটা ফ্রেমওয়র্ক থাকে, সেটা যেন লাইনচ্যুত হয়ে অন্যদিকে না চলে যায়।

এই যে মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন নিয়ে এত কথা বললাম- আচমকা দুজন ইন্ডিয়ান ফিগারের অবতারণা করা হচ্ছে- এই ডিটেলটাকে যে একটা আর্গুমেন্টের আকারে পেশ করতে পারছি এবং জাস্টিফাই করতে পারছি, তার কারণ এর আগে আমরা স্টেজকোচের সেই ক্লোস-আপ টা পেয়েছি এবং ফাইনালি দা সার্চার্স নাগাদ বুঝতে পারছি যে ওয়েস্টের সামগ্রিক মিথোলজি এবং বিশেষত রেস-এর প্রশ্ন—এই নিয়ে ফোর্ডের শেষের দিকের ছবিগুলোয় ক্রমশ একটা অ্যাওয়্যারনেস ফুটে উঠছে। এবার ফোর্ড নিজে অ্যাওয়্যার হচ্ছেন, না তাঁর ছবিগুলো–সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

সায়ন্তনঃ এবং সেই সময়টাও – শুধু একা ফোর্ড তো নন, এই সময়ে একাধিক ছবি হচ্ছে এই জায়গাটাকে কেন্দ্র করে।

অরূপরতনঃ প্রিসাইজলি। পঞ্চাশের দশক যত শেষের দিকে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আমেরিকার ঐ আশাবাদের বেলুনটা ক্রমশঃ চুপসে যাচ্ছে। আমেরিকান লিবারাল ডেমোক্র্যাসি, ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির যে ইউটোপিয়াটা – এককথায় যাকে বলে আইজেনআওয়ারের যুগ, সেটা আসতে আসতে ক্রমশঃ ক্ষয়ে যাচ্ছে। আর দশ বছরের মধ্যেই এর চূড়ান্ত রূপটা আমরা দেখতে পাবো। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, দ্য সার্চার্স আর বনি অ্যান্ড ক্লাইড (১৯৬৭)র মধ্যে কিন্তু মাত্র দশ বছরের তফাত – বা, শায়ান অটাম আর ইজি রাইডার (১৯৬৯)-র মধ্যেমাত্র চার বছরের পার্থক্য।

(চলবে)

সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s