১৯৬৩ সালে হলিউডে থাকাকালীন সমালোচক লুইস স্কোরেচকি (ছদ্মনাম জঁ-লুই নোমস) বিশ্ববরেণ্য ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া-র (১৮৯৪-১৯৭৯) একটি সাক্ষাৎকার নেন। এর পরের বছর মে মাসে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ফরাসি ফিল্ম জার্নাল কাহিয়ে দু সিনেমা-য়– সেখানে তার শিরোনাম ছিল ‘Propos rompus’। এর একটি বিশেষ অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল। পঞ্চাশের দশক থেকেই কাহিয়ে দু সিনেমার পাতায় এবং ফরাসি সিনেফিল জগতে ‘অতিয়র’ (auteur) নিয়ে যে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের জল গড়াতে শুরু করেছিল, সেটা ষাটের দশক নাগাদ আটলান্টিকের এপারেও এসে পৌঁছয়। খানিকটা ফরাসি লেখালিখির সূত্র ধরেই চ্যাপলিন, ওয়েলস, হিচকক, স্যামুয়েল ফুলার প্রমুখকে অতিয়রের মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা, সেই নিয়ে তুমুল বাগবিতন্ডা শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায়, যার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ফিল্ম কোয়ার্টারলি জার্নালে সমালোচক অ্যান্ড্রু সারিস এবং পলিন কেইলের বাগযুদ্ধ। জঁ রেনোয়ার সাক্ষাৎকারের একটি বিশেষ অংশ- যেটা এখানে উদ্ধৃত করা হল- সেখানে রেনোয়া এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তাঁর নিজস্ব মত জানিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য যে, রেনোয়া ছিলেন সে’সব হাতেগোনা ফরাসি পরিচালকদের মধ্যে একজন, যাঁদেরকে কাহিয়ে দু সিনেমার নবীন সমালোচকরা প্রকৃত অতিয়র বলে সম্মান করতেন। এই সাক্ষাৎকারটি দেওয়ার সময়ে রেনোয়ার বয়স ছিল আটষট্টি, আর তাঁর পরিচালিত ছবির সংখ্যা ছিল ছত্রিশ।
ফিল্ম অতিয়রের সমস্যাটা, সত্যি বলতে আদৌ সমস্যাই নয়। আমার বিশ্বাস, অনেক ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকারেরই ছবির পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। সেরকমই, আমার মতে এমন অনেক সময়ে হয়েছে যে চিত্রনাট্য লেখার জন্য যা যা গুণ দরকার তার সবই পরিচালকের মধ্যে মজুত, এবং তিনি সেটা লিখলে হয়তো দর্শকের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে নির্বিঘ্নে আদানপ্রদান করতে পারতেন। তার চাইতেও বড় কথা, অতিয়রের সমস্যাটা কোনো সমস্যা নয়, বরং একটা জ্বলজ্যান্ত ফ্যাক্ট। জগৎসংসার বদলায়, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা যাকে বড়াই করে আর্ট বলি, সেটাও পাল্টে পাল্টে যায়। বলাই বাহুল্য, আমি নিজেও এমন এক যুগে বাস করতে চাই যেখানে স্রষ্টা বা ক্রিয়েটরের আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। প্রিমিটিভ আর্ট ছিল মহান শিল্প, অথচ যীশুর জন্মের শত শত বছর পূর্বে তৈরি গ্রিক ভাস্কর্যের যে কারুকার্য, সেখানে স্রষ্টার নাম কোথাও পাওয়া যাবে না। গির্জা-ক্যাথিড্রালের আর্টের কথা যদি ভাবি– আমরা জানিই না সেন্ট পিটার বা এঞ্জেল গ্যাব্রিয়েলের মূর্তি কাদের গড়া, স্রেফ জানি না। হাজার হাজার গ্যাব্রিয়েলের মধ্যে একটি গ্যাব্রিয়েল। এতদসত্ত্বেও স্রষ্টার ব্যক্তিত্ব কিন্তু তার মধ্যেও ফুটে বেরোয়। প্রতিটি বিভঙ্গের মধ্যে আমরা স্রষ্টার হাতের স্পর্শ অনুভব করি, কিন্তু তাঁর নাম তো আমাদের কাছে অজানা। স্রষ্টা আছেন, আবার নেই-ও। এই ধরণের আদিম সৃষ্টিকর্ম আমার ভীষণই প্রিয়, কিন্তু এদের জিইয়ে রাখার জন্য কিছু শর্তও পূরণ করতে হয়, যা এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। প্রথমত, এর জন্য দরকার ধর্ম আর জীবনের ওতোপ্রোত সম্পর্ক- দুটো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে থাকবে অন্তরঙ্গভাবে। পুরাকালের মানুষ ধর্মকে অবলম্বন করে জীবনধারণ করত, তাদের কাছে নাওয়া খাওয়া থেকে শুরু করে সঙ্গম বা পশুশিকার– সবই একেকটা আচার অনুষ্ঠান। ধর্ম আর জীবনের এই সম্পর্ক শিল্প – যা জীবনেরই অভিব্যক্তি – তার ওপর একটি অনিবার্য দ্যোতনা আরোপ করত। হতেই পারে যে এগুলো ভীষণ জাঁকালো, চোখধাঁধানো- যাবতীয় প্রিমিটিভ আর্টের প্রতি আমাদের উচ্ছ্বাসের পিছনে হয়তো এই জাঁকালো ভাবটাই দায়ী।
অতিয়রের প্রসঙ্গ এলে আমাদের দাবি দাওয়াগুলো আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। একটা গোটা জাতি বা উপজাতির লোক মিলে যা সম্ভব করেছে, আমরা দাবি করি যে সেটা মোটে একজন মানুষ করে দেখাবেন। সেজন্যই আমাদের অতিয়রের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। এবার এটা যদি একটু বাস্তবজ্ঞান দিয়ে বিচার করে দেখি তাহলে প্রশ্ন জাগে, এত ভালো ছবি আমরা পাবো কোত্থেকে? অতিয়রের ধারণা নিয়ে যারা বিরোধিতা করে, তাদের কথাটা কিন্তু ঠিক। আমাদের যা দরকার, তা হল একাধিক উৎকৃষ্টমানের ছবি, আর আমরা চাই পৃথিবীর প্রতিটা সিনেমা হলে প্রতি হপ্তায় অন্তত একটা করে ভালো ছবি পৌঁছে দিতে। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করে লাভ নেই যে, একই সঙ্গে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক-এরকম মানুষ খুঁজলে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। এসব ক্ষেত্রে আমি একটা অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করি – একটি সময়-নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ। প্রতি হপ্তায় থিয়েটারে যে হাজার হাজার ছবি মুক্তি পাচ্ছে, তাতে আমার একফোঁটা আগ্রহ নেই, সত্যিই নেই। যা আমায় টানে, তা হল ন’মাসে ছ’মাসে একটা সিটিজেন কেন, মাঝেমধ্যে একটা গোল্ড রাশ, বা কখনওসখনও একটা ডেভিড অ্যান্ড লিজা। তখনই আমার মনে হয় যে আলবাত অতিয়রের প্রয়োজন আছে। আমি জানি, চ্যাপলিনের পক্ষে এতগুলো মাস্টারপিস তোলা সম্ভব হয়েছে কারণ তিনি নিজে তাদের চিত্রনাট্য লিখতেন, তাতে অভিনয় করতেন, ডিরেকশন দিতেন, এডিটিং সামলাতেন, সুর দিতেন- প্রত্যেকটা বিভাগ সামলাতেন। আমার চোখের সামনে যে ফিল্মটা রয়েছে, তা কেবল একজন ব্যক্তিমানুষের অভিব্যক্তি। এটাই এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ শতকে একজন ‘অথরে’র অভিব্যক্তি বলতে আমরা এটাই বুঝি।


ধরা যাক, আমরা এই যে (ফ্রঁসোয়া) সাগানের লেখা বঁজুর ত্রিস্তেস (উপন্যাস) পড়ি, হতে পারে তার কারণ এই যে মাদাম সাগান যথেষ্ট প্রতিভাবান লেখিকা, কিন্তু সেটা তাঁর সাফল্যের একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। বরং তাঁর বইয়ের পাতায় যে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে– এটাই তাঁর সাফল্যের হেতু। আমরা তাঁকে স্পর্শ করতে পারছি, তাঁর সাথে কথা বলতে পারছি, এবং তিনি আমাদের উদ্দেশ্য করে কথা বলছেন– এটুকুই যথেষ্ট। বাকি আর কিছুরই কোনো দাম নেই। তাঁর বই খাজা হতে পারে, ভালোও হতে পারে। জনতার ভিড়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে রাস্তা দিয়ে একসাথে দশ হাজার গাড়ি ছুটে যায়, আর যেই একটা লাল আলো জ্বলে উঠল অমনি দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? না একটা বে-লাগাম, ফোলানো ফাঁপানো ট্রেন্ড যার মধ্যিখানে রয়েছে ব্যক্তিমানুষ। আর ফিল্মে এই ট্রেন্ডটা অতিয়রকে কেন্দ্র করে। আমি তার হয়ে সওয়াল করছি না, তার বিরোধিতাও করছি না। আমি স্রেফ তাকে জরিপ করছি। ব্যস, এইটুকুই।


এই সাক্ষাৎকারটি ছেপে বেরনোর প্রায় আড়াই দশক বাদে ফরাসি ফিল্ম বোদ্ধা জঁ-লুই কোমোলি – কাহিয়ে দু সিনেমার আগুনঝরানো রেড ইয়ার্সের পয়লা নম্বরের মুরুব্বি জঁ-লুই কোমোলি – জঁ রেনোয়ার সারা জীবনের কীর্তির মূল্যায়ন করে লেখেন, “আমাদের প্রত্যেকের চোখে রেনোয়ার ছবিগুলো ছিল (সিনেমা নিয়ে) এই প্যাশনের আধার। কাহিয়ে কোনোদিনই ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো ছকে রেনোয়াকে নিয়ে কথা বলেনি– যার মানে আমরা হয় চিরদিনই তার সাথে নিজেকে এক করে ফেলেছি, নয়তো তাকে শুধুই নিজের বলে দাবি করেছি।” রেনোয়ার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তিনি কাহিয়ে দু সিনেমার ‘পলিতিক দেস অতিয়র’ নিয়ে কিছু কথা বলেন যা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক,যেহেতু অতিয়র নিয়ে যে পাগলামির বহর রেনোয়া লক্ষ্য করেছিলেন কোমোলি এখানে একই সঙ্গে তার স্বীকারোক্তি ও ব্যাখ্যা দিলেন। “এটা সত্যি যে কাহিয়ে-তে ফিল্মকে কোনোকালেই একবগ্গা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়নি, বা চেষ্টা হয়নি একটা হাতেগরম নান্দনিকতা মেনে বিচার করার – আর কোনো বাঁধাধরা ইডিওলজির কথা তো ছেড়েই দিলাম। এই সব কনস্ট্রাক্ট নাক-গলানোর আগে ফিল্মের সারসত্তা বলে একটা জিনিস চলে আসে, যার স্থান মূলত আবেগের জগতে, প্যাশনের মহল্লায়। এক নাছোড় ভালোবাসা অন্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে আমাদের টেনে নিয়ে যায় কিছু বিশেষ ছবির দিকে, কিছু নির্দিষ্ট সিনেম্যাটিক প্র্যাক্টিসের কাছে।… যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখলে, এই যে ‘পলিতিক দেস অতিয়র’ দিয়ে নিজেদেরকে সীমিত করে ফেলা- তার এত অসংলগ্নতা আর অসংগতি- এর সাথে কি নিপাট প্রেম-নির্ভর একটা কনস্ট্রাক্টের মিল নেই?”
উৎস: কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বই Renoir on Renoir: interviews, essays, and remarks (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯); ক্যারল ভল্ক-কৃত ইংরেজি তরজমা অনুসরণ করে বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে।