এবছরেই অগস্ট মাসে, বিএফআই, অর্থাৎ ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে অমিতাভ চ্যাটার্জির আমি ও মনোহর (২০১৮) সম্পর্কে দু’দুটো প্যারাগ্রাফ লেখা হয়েছে। নিবন্ধটি মূলত কলকাতা শহর নিয়ে তৈরি তার প্রতিনিধিস্থানীয়, দশটি ছবির তালিকা। সময়ক্রম মেনে বানানো এই তালিকায় মনোহরের সঙ্গে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), অপর্ণা সেনের থার্টি-সিক্স চৌরঙ্গী লেন (১৯৮১), সুজয় ঘোষের কাহানি (২০১২), দিবাকর ব্যানার্জির ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী! (২০১৫) ইত্যাদি নাম। বিশ্ববিখ্যাত বিলিতি ওয়েব পোর্টালে আর্ট সিনেমা ও বলিউডের তাবড় হোতা-দের সাথে নাম থাকতে দেখলে সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে না যে, আমি ও মনোহর একটি দস্তুরমত কেউকেটা ছবি। শুধু তাই নয়, এই লিস্টি বেরোনোর প্রায় সাথে সাথেই স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট ‘মুবি’-তে – যেখানে মূলত দেশবিদেশের অন্যধারার ছবি কিউরেট করা হয় – ছবিটার স্ট্রিমিং শুরু হয়। ইদানীং বাংলা সিনেমার বংশে বাতি দেওয়ার মত লোক পাওয়া যাবে কিনা সেই নিয়ে সংশয় জাগছে, ঘনঘন ডাক পড়ছে পাশে দাঁড়ানোর – এমন ঘোর সংকটের দিনে খোদ বিএফআই এবং মুবির পিঠ-চাপড়ানি পাওয়া মানে তো রীতিমত উৎসাহজনক ব্যাপার! এমন ছবি নিয়ে বাঙালি সিনেফিলরা উচ্ছ্বাস করবে না তো কে করবে? হয়তো হলে মুক্তি পাওয়ার চার বছর পর আমি ও মনোহরের এই পুনর্মূল্যায়ন থেকেই নতুন বাংলা সিনেমার গতিমুখ দেখতে পাওয়া যাবে! এমন আশা করেই ছবিটি দেখতে বসেছিলাম- কিন্তু সে গুড়ে বালি।
আমি ও মনোহর একদম প্রথম শট থেকেই বিশ্ব সিনেমার একটি সুপরিচিত সাম্প্রতিক ধারা, যার নাম ‘স্লো সিনেমা’, তাকে খুব সচেতনভাবে অনুসরণ করে। স্লো সিনেমার আন্তর্জাতিক ক্যানন অনুযায়ী যদি তার একটি কেস হিস্ট্রি তৈরি করা হয়, তা হলে যে যে সিমটমগুলি সবার আগে চোখে পড়বে–যেমন ক্যামেরার ঠায় একদিকে চেয়ে থাকা, ফ্রেমের মধ্যে অবসন্ন মানুযের আসাযাওয়া বা স্থানুবৎ অপেক্ষা করা, মন্থরগতিতে থেমে থেমে সংলাপ বলা, ঘটনার বাহুল্য বর্জন করে শব্দ ও আলো-ছায়ার সাহায্যে স্রেফ একটি আবহ সৃষ্টির দিকে ঝোঁক– এর সবকটিই আমি ও মনোহরে রয়েছে। এই ছবির গল্প নিয়ে বাক্যব্যয় করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার আঙ্গিক নিয়ে কয়েকটা কথা এখানে না উল্লেখ করে পারছি না। বিশেষত তিনটি দিক– স্লো এসথেটিকস, আইফোন ইমেজ এবং সংলাপ নিয়ে কথা না বললেই নয়।
ক) স্লো সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গেলে, বিশেষত তার মূল্যায়ন করতে গেলে, কয়েকটি অনিবার্য কূট প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। যেকোনো শিল্পবস্তুর গুণমান বিচার করতে গেলে যা কর্তব্য, তা হল সেই শিল্প আঙ্গিক বা ঘরানার নিয়মগুলিকে সম্যকভাবে জেনে, তার সাপেক্ষে একক শিল্পকর্মটির বিশ্লেষণ করা। ঐ ঘরানার মধ্যে যে নিয়মগুলি স্বীকৃত, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই হাত দিতে হয় শিল্পের বিচারে। একটি ঘরানা গড়ে ওঠার পিছনে কারণও থাকে একাধিক, সেটি রাতারাতি গজিয়ে ওঠে না– একটি অগ্রজ ঘরানার মধ্যে দীর্ঘদিনের উদ্ভাবন ও যোগবিয়োগের অনুশীলন করতে করতে ক্রমশ একটি অপরিচিত ও নতুন ঘরানার উদয় হয়। সিনেমার ক্ষেত্রে এমন একটি ঘরানার আবির্ভাবের নেপথ্যে অনেক সময়ই অভিভাবকের ভূমিকায় থাকে ইন্ডাস্ট্রি (অনেক সময় অভিনবত্ব আনার জন্য নতুন ঘরানা তৈরি করা হয়), সমালোচকগোষ্ঠী (এক শ্রেনির ছবিকে তাঁরা সমগোত্রীয় মনে করে আলোচনার সুবিধার্থে তাদের জন্য একটি পৃথক ঘরানা চিহ্নিত করার প্রয়োজন মনে করেন– এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফরাসি ক্রিটিকদের কলম থেকে ফিল্ম নোয়া নামক প্রসিদ্ধ ঘরানাটির উৎপত্তি হয়েছিল), এবং ফিল্ম ফেস্টিভাল (কিউরেশনের সুবিধার্থে একই ধরণের ছবিকে বন্ধনীভুক্ত করে একটি নাম দেওয়া হয় যা অনেকসময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে)। স্লো সিনেমা নামটির জন্ম-ইতিহাসে সমালোচক এবং ফেস্টিভালের ভূমিকা অনেকখানি। একুশ শতকের শুরুর দিকে একাদিক্রমে বিভিন্ন ফেস্টিভালে মূলত এশিয়া ও ইউরোপে তৈরি ধীরলয়ের ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকায়, কিউরেটর এবং সমালোচক– দুই পক্ষই তাদেরকে একটি নতুন নাম দেওয়া যুক্তিযুক্ত বোধ করেন, যাতে অন্যান্য ছবি থেকে তাদেরকে সহজে আলাদা করা যায়। জন্ম নেয় স্লো সিনেমা বা কনটেমপ্লেটিভ সিনেমা নামে একটি নতুন ক্যাটাগরি। সমস্যা হচ্ছে, এই ধরণের ফেস্টিভাল স্বীকৃত ক্যাটাগরি গুলো মাথা চাড়া দেওয়ার পর পরই দেখা যায় ঢাল-তরোয়াল-বিহীন নিধিরামের মত একদল লোক নেমে পড়েছেন তাদের নকল করতে। এঁরা ঘরানার নামকরা ছবিগুলো দেখে তাদের সবচেয়ে মোটাদাগের লক্ষণগুলো হুবহু টুকলি করে বসিয়ে দেন নিজেদের কাজে, উদ্দেশ্য – ফেস্টিভাল বলয়ে কৌলিন্য প্রাপ্তি আর সমালোচকদের পিঠ চাপড়ানি। এদিক থেকে মূলধারার ছবির সাথে আর্ট ফিল্ম-করিয়েদের খুব একটা ফারাক নেই। দু-পক্ষেই নিকৃষ্ট মানের পরিচালকদেরও অভাব নেই, তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালীদের (সাম্প্রতিক বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছে যেমন বলিউড বা তামিল-তেলুগু ছবি) অক্ষম অনুকরণ করার জন্য মহা-উৎসাহে এগিয়ে যান, তারপর বিশ বাঁও জলে ডুবে নাকানিচোবানি খান, বা খাওয়ান।
সমস্যাটা যে স্লো সিনেমার ক্ষেত্রে আরো উৎকট, তা আমি ও মনোহর দেখতে বসে রীতিমত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। যেহেতু সময়ের কোনো বাঁধাছাঁদা নেই, নেই একটি প্লট অনুসরণ করে শট সাজানোর প্রয়োজন, অতএব যেখানে যেমন ইচ্ছে ঠায় ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে রেখে দাও। চরিত্ররা নিরন্তর বকে যাচ্ছে, তাদের সংলাপ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে অ্যামবিয়েন্স সাউন্ডের ভিড়ে, তা চলতে দাও, ক্ষতি নেই। ছবিতে রং নেই, তার জায়গায় ক্যাটক্যাটে সাদাকালো হাইকনট্রাস্ট আইফোন ইমেজ। মানাচ্ছে না? তাতে কী? লাভ ডিয়াজ বা হঙ সাং সু তো সাদাকালোতে ছবি তোলেন, তাহলে আমি কী দোষ করলাম! মোদ্দা কথা– বেলা টার, নুরি বিলজে চেইলেন, লাভ ডিয়াজ, চাই মিং লিয়াং, লিসান্দ্রো আলোনসো, হৌ শিয়াও শিয়েন, মায় আমাদের সব্বার প্রাণের পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি যদি স্লো সিনেমা বানাতে পারেন, তবে আমি বাঙালি পরিচালক হয়ে ক্যামেরাকে প্যারালাইস করে দিলে সবার চামড়া জ্বলবে কেন?
বলে রাখা ভালো, বাঙালি পরিচালকের উচ্চমন্যতা, অনুকরণপ্রীতি, বা যশোলিপ্সা- আমার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে এগুলো নিয়ে নয়। আমার সমস্যা, এবং আশা করি আমার মত আরো অনেকেরই যেটা দৃষ্টিকটু লাগে, সেটা হল অক্ষম অনুকরণ, বাংলায় যাকে ‘হনুকরণ’ বলে। একজন শিল্পী হয়তো তার কষ্টার্জিত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে, অমনি সেই দেখাদেখি তার কাজের সারাৎসার না বুঝে, স্রেফ উপরিতলের কয়েকটি চিহ্নলক্ষণকে ঘুণপোকার মত কুরে কুরে নিলেন – এ’ধরণের শস্তা চটকদারির মোহ শিল্পজগতে চিরকালই ছিল, এভাবেই বিভিন্ন ফ্যাড বা ট্রেন্ড তৈরি হয়। কিন্তু স্লো সিনেমার বলগাহীন সময় এবং আলগা নিয়মকানুনের সুযোগ নিয়ে, শিল্প করার নামে দাঁও মারার যে বাতিক সম্প্রতি দেখা দিয়েছে, সেটি রীতিমত এপিডেমিকের আকার ধারণ করতে চলেছে। অবিলম্বে সেটির একটি টীকা বা টোটকা না পেলে মুশকিল। আমি ও মনোহর দেখতে বসলে এই বাতিকের ভুরি ভুরি নমুনা পাওয়া যাবে। আগেই বলেছি— যেসব বিশেষত্ব দিয়ে স্লো সিনেমাকে শণাক্ত করা হয় তার সব কটাই এখানে হাজির – সুতরাং রোল কল করে ঘরানা চিনে নিতে ভুল হয় না। অর্থাৎ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে নুরি বিলজে চেইলেন বা চাই মিং লিয়াং যে গোত্রের ছবি করেন, অন্তত অ্যানাটোমির বিচারে অমিতাভ চ্যাটার্জির ছবি তাদের কাছাকাছি। কিন্তু তাঁদের ছবিতে শটের কম্পোসিশনে, পরম্পরায় ও শব্দ পরিকল্পনায় যে সৌষ্ঠব থাকে, তার ধারে কাছেও নেই আমি ও মনোহর। ছবির জায়গায় জায়গায় বাঁকা ফ্রেম, বিকট তার কম্পোসিশন। অযৌক্তিকভাবে সাদাকালো ইমেজের ব্যবহার। থেকে থেকে শট থেকে শটে ইমেজের টেক্সচার বদলে যাওয়া। বহির্দৃশ্যে নেওয়া শটগুলো সাবলীল নয়, গাড়িঘোড়ার শব্দে সংলাপ পরিষ্কার বোঝা যায় না– অর্থাৎ সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের অভাব স্পষ্টতই টের পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু তাকে গোপন করার জন্য ন্যূনতম পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই।


অন্যদিকে অন্তর্দৃশ্যের শটগুলি আশ্চর্যরকমের গোছানো; বহির্দৃশ্যের মত অগোছালো, অনিয়ন্ত্রিত ভাবের লক্ষণমাত্র নেই। বোঝাই যাচ্ছে যে ছবি বানানোর সময়ে সিনেমা নামক মাধ্যমের প্লাস্টিক উপাদানগুলোর ভারসাম্য সম্বন্ধে পরিচালক একেবারেই বিস্মৃত হয়েছিলেন (দয়া করে থার্ড সিনেমার ম্যানিফেস্টো দেখিয়ে জাস্টিফাই করতে যাবেন না – ওটা পুরোনো হয়ে গেছে)। নুরি বিলজে চেইলেনের ওয়ন্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া (২০১১) দেখুন – সেখানে আলো আঁধারের কারুকার্য সর্বাগ্রে চোখে পড়বে। কীভাবে, ঠিক কোন মুহূর্তে ক্যামেরা বাতাসে দোলায়মান ঘাসের ওপর নিবদ্ধ হবে, তারপর সেখান থেকে টিল্ট করে যাবে ঢেউ খেলানো টিলার ওপর, আঁধার রাতে যার ওপর দিয়ে ছুটে যাবে রেলগাড়ি, তারপর কাট করে ক্যামেরা নিবদ্ধ হবে কাউন্টারশটে, একটি চরিত্রের ক্লোসআপে– সেই অসাধারণ পরিমিতিবোধ কী নিরলস অধ্যবসায়ে আয়ত্ত করেছেন তুরস্কের পরিচালক! শব্দ পরিকল্পনার কথা তো ছেড়েই দিলাম- ঘাসের ওপর হাওয়ার আছড়ে পড়ার শব্দ, তার কাঁধে চড়ে দূর থেকে ভেসে আসা রেলগাড়ির ঝিকঝিক– দৃশ্যপটের সাথে মিলেমিশে এই শব্দমায়াজাল যেন একটি রক্ত মাংসের সজীব শরীর তৈরি করে, যাকে ছোঁয়া যায়, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে রোমন্থন করা যায়। একটি স্পন্দমান অস্তিত্ব যেন পর্দা আর ইন্দ্রিয়ের মধ্যে যাতায়াত করে। আমি ও মনোহরের রেটিনা গরম করা হাই কনট্রাস্ট ইমেজ, এবড়ো-খেবড়ো শট, আর পরিকল্পনাহীন শব্দের হট্টগোলের মাঝে সেই অনুভূতি কোথায়?
খ) সমস্যাটা আলাদা করে ছবির ইমেজ এবং তাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি নিয়ে নয়। কেউ বলতেই পারেন – সেলফোন তথা আইফোনের বিল্ট-ইন ক্যামেরা ব্যবহার করে যদি কেউ একটা সার্থক ফিচার ফিল্মের আগাগোড়া তোলেন, তাহলে তো উদ্বাহু হয়ে তার প্রশংসা করা উচিত! অতীতের সুপার এইট আর হ্যান্ডিক্যামের মত বর্তমানে সেলফোন ক্যামেরার সহজলভ্যতাও সিনেমা বানানোর ব্যয়ভার অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারে। সেই কারণেই বোধহয় ফোটোগ্রাফিক ইমেজের সবচেয়ে সুলভ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিভূ হল সেলফোন ক্যামেরায় তোলা ছবি (ফোটো ও ভিডিও, দুই অর্থেই)। একুশ শতকের শুরুর দিকে যখন সেলফোন ইমেজ ব্যবহার করে ফিল্ম বানানোর চেষ্টা শুরু হয়, তখনও সেই ইমেজ আজকের মত ঝকঝকে মসৃণ হয়ে ওঠেনি, মোটা মোটা পিক্সেল ফুটে থাকার জন্য তাকে অনেকসময়ই মনে হত হরেক রঙের মৌচাক – যেন সেটি ঘটনাচক্রে ছবি হয়ে গেছে। সে’সব ইমেজে দামী ডিজিটাল ক্যামেরার মত স্পষ্টতা ছিল না বলেই তার নিজস্বতা টের পাওয়া যেত। তাছাড়া, তার দ্বারা বাস্তবের ইলিউশন তৈরি করে লোক ঠকানো যায় এরকম অভিযোগও কেউ কোনোদিন করে নি (যেটি মূলধারার ও আর্ট সিনেমার তথাকথিত বাস্তববাদী ছবি সম্বন্ধে হামেশাই বলা হয়ে থাকে)। যারা ডিজিটাল যুগে এসে অল্পব্যয়ে অন্যধারার ছবি তৈরির কথা ভাবছিলেন, এই ইমেজ তাদের সামনে নতুন পথ খুলে দিতে পারত। সেজন্যই পিক্সেলে ভরা সেলফোন ইমেজের রুক্ষ, ভাঙাচোরা নান্দনিকতাকে ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একক ও যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিল নতুন ফিল্ম ট্র্যাডিশন নির্মাণের উদ্যোগ। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ধাক্কা খেল অচিরেই, যার অন্যতম কারণ – মাত্র একদশকের মধ্যে সেলফোন ইমেজের গুণমান বা রেসোলিউশন অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া। আগে ফোনের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে যে পিক্সেল ফুটে থাকত (অনেকটা ইম্প্রেশনিস্ট পেন্টিঙে মোটা তুলির দাগের মত), সেটি প্রায় মুছে ফেলা হল নতুন ক্যামেরায়। নতুন সেলফোন পেশাদার ফিল্ম ক্যামেরার মত রীতিমত চাঁচাপোঁছা ইমেজ সৃষ্টিতে পটু, তার সঙ্গে যোগ করা হল হরেকরকমের অ্যাপ ও ফিল্টার, যাতে ছবির কালার কারেকশন ও অন্যান্য সম্পাদনার কাজ ফোনেই সেরে ফেলা যায়। প্রতি বছর আইফোনের নিত্যনতুন ভার্শনে ভিডিও তোলার পদ্ধতিকে করে তোলা হচ্ছে আরো নিখুঁত, আরো ঝকঝকে। তাই শুধু অনামা অখ্যাত ইন্ডি পরিচালক নন, অনেক নামজাদা ছবিকরিয়ে আজকাল আইফোন ক্যামেরা ব্যবহার করে ফিল্ম বানাচ্ছেন (যেমন হলিউডের স্টিভেন সোডারবার্গ বা দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চান উক)।
আমি ও মনোহর হয়তো সেই পথেরই পথিক হতে চেয়েছিল। এই ছবিতে আইফোন এসথেটিক্স অন্য মাত্রা যোগ করতে পারত যেহেতু ছবির গল্পাংশে চেষ্টা করা হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের নাটকীয়তাহীন টানাপোড়েনকে তুলে ধরার। সেলফোন ইমেজের সঙ্গে আমাদের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে, মজ্জাগত হয়ে গেছে অতিসামান্য মুহূর্তকে ইমেজ বা ভিডিও ফাইল হিসেবে ফোনের স্টোরেজে রেখে দেওয়ার অভ্যেস, তাই দিনগত পাপক্ষয় নিয়েই যে ছবির গল্প, তাতে সেলফোন ইমেজ রীতিমত যুৎসই হবে- এতে আশ্চর্যের কী আছে?
কিন্তু আশ্চর্যের অবকাশ আছে। ছবি তৈরির সমস্ত উপকরণ হাতের কাছে থাকলেই হয় না, তার প্রয়োগের নিয়মকানুন ও আদবকায়দা রপ্ত করা চাই। আন্তর্জাতিক ছবির সর্বাধুনিক ট্রেন্ড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়াও ভালো ছবি করার পক্ষে যথেষ্ট নয়- সবার আগে দরকার তার চারিত্র্যধর্মকে আত্মস্থ করা, আর হাতের কাছে যে সরঞ্জাম মজুত রয়েছে, তার সাথে সাযুজ্য রেখে সেই ট্রেন্ডের নবনির্মাণ করা। স্লো সিনেমার সাথে আইফোন ইমেজের গাঁটছড়া নিয়ে কোনো সার্বজনীন সিদ্ধান্ত এখানে দিতে চাইছি না, তবে নির্দ্বিধায় বলা চলে- আমি ও মনোহরের ক্ষেত্রে এই মিলন ঠিক মণিকাঞ্চন যোগের মত হয়নি। ধীরলয়ের ছবিতে দর্শকের ইন্দ্রিয়গুলিকে ফ্রেমের দিকে আকর্ষণ করার জন্য যে দক্ষতায় শব্দ ও দৃশ্য পরিকল্পনার দরকার হয়, এখানে তার নিদারুণ অভাব– ফলে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা অনাবশ্যক ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। এই ক্লান্তি কিন্তু ছবির ধীরগতি বা ঘটনাহীন লং টেক-জনিত নয়, বরং পৃথিবীর রূপ জল হাওয়া, মানুষ, না-মানুষ ও চরাচরের সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ডিটেলকে দর্শকের ইন্দ্রিয়ানুভূতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার শোচনীয় অক্ষমতা থেকে উঠে আসে। বোঝাই যায় – সিনেমার এই সুলভ হয়ে ওঠা আমাদেরকে নিষ্পৃহ করেছে ফর্মের রাজনীতি বুঝতে – বোঝানোর মত কোনো জেঠামশাইও নেই আমাদের চারপাশে, অন্তত ফিল্ম স্টাডিসের ক্লাসরুমের বাইরে তো নেইই। বিষয়, আঙ্গিক ও মিডিয়ামের মধ্যে সঠিক যোগস্থাপন করার জন্য যে পরিমিতিবোধ দরকার – সেটাও উবে গেছে কর্পূরের মত। ফলে সেলুলয়েডের যুগ গিয়ে যখন ডিজিটাল এল, আর তার সাথে এসে গেল হরেক রকমের ডিজিটাল ক্যামেরা – হ্যান্ডিক্যাম থেকে স্মার্টফোন – ততদিনে আমরা বুঝতে পেরেছি যে তাদের স্বতন্ত্র আঙ্গিকের রাজনীতিকে চিনে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার সবকটি সম্ভাব্য রাস্তা প্রায় বুজে এসেছে।
এছাড়া ছবিতে অপর একটি উপাদানের বাড়বাড়ন্ত, আমার মতে, স্লো সিনেমা আর আইফোন ইমেজের সফল বিক্রিয়ায় বিষম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে- ছবির সংলাপ।
গ) আগেই বলা হয়েছে যে অমিতাভ চ্যাটার্জির ছবিতে আগাগোড়া একটি নিপাট সাদামাটা ভাব রয়েছে (যেন পরিচালক পণ করেছেন যে জৌলুসহীন ইমেজ ব্যবহার করে ছবি বানাবেন), তাছাড়া মূলধারার ছবিতে ইমেজ, ধ্বনিপরিকল্পনা, সুরারোপ এবং ঘটনার পারম্পর্যে যেমন আবেগ চারিয়ে দেওয়ার গরজ থাকে, এখানে তেমনটা নেই। স্লো সিনেমার রীতি অনুসরণ করে একধরণের ফ্ল্যাট টোনালিটি ব্যবহার করায় নাটকীয়তার সমস্ত সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে গেছে। অথচ আয়রনি-টা ভাবুন- ছবির পুরোভাগে যে তিনজন চরিত্র রয়েছে, তাদের সংলাপ কী ভীষণ মাত্রায় নাটুকে এবং মেকি! কয়েকটি উদাহরণ না দিলে ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না। ছবির একেবারে প্রথম দৃশ্যে (সাউন্ডট্র্যাকে জলের শব্দ, ফ্রেম অন্ধকার, কয়েকটা তারা ফুটে আছে) একজন বাবা ও মেয়ের কথোপকথন শোনা যায়। মেয়ে ডাকে, ‘বাবা,’ বাবা উত্তর দেয়, ‘বলো।’ মেয়ে জানতে চায়, ‘আকাশে যে অত তারা, ওদেরও কি বাবা আছে?’ এই নির্বোধ প্রশ্নের উত্তরে বাবা জানায় যে হ্যাঁ, তারাদেরও বাবা আছেন। মেয়ে যখন সেই ‘বাবা’র পরিচয় জিজ্ঞেস করে, তখন গুরুগম্ভীর গলায় বাবা জানায়, ‘ভগবান।’ এরপর খানিকটা নীরবতা যোগ করা হয়, সম্ভবত আমাদেরও কিঞ্চিৎ সময় দেওয়া- এই আপাত নির্বোধ মন্তব্যে নিহিত গভীর দর্শনবোধ অনুধাবন করার জন্য।
এর পরের দৃশ্যে দেখা হয় দুজন অফিসফেরতা যাত্রীর, একজন তরুণী ও তার প্রৌঢ় সহযাত্রী। প্রৌঢ় জিজ্ঞেস করেন, ‘কী দেখছ অত মন দিয়ে,’ তরুণী বলে, ‘আপনি এসে গেছেন? আপনাকে খুঁজছিলাম।’
প্রৌঢ়: কোথায়, ঐ বাড়ির মাথায়? (!)
তরুণী: আচ্ছা শকুনগুলো ওখানে কেন ওড়ে বলুন তো?
প্রৌঢ়: আন্দাজ করতে পারি, আমার মত বুড়ো হাবড়ারা রিটায়ার করলে ওরা পিছু নেবে।
প্রতিটা সংলাপ টেনে টেনে সময় নিয়ে, বলা ভালো চিবিয়ে চিবিয়ে বলা। এই দুটি উদাহরণ থেকে বাকি ছবির সংলাপের একটা ধারণা করে নিন, কারণ প্রায় দুঘন্টা দৈর্ঘ্যের এই ছবিতে যখনই একটি চরিত্র মুখ খুলেছে, বেশিরভাগ সময় এরকম সারগর্ভ বাণীই শোনা গিয়েছে। আরেকটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না: একটি দৃশ্যে তরুণী ও প্রৌঢ় ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরছে; প্রৌঢ় নিজের দিনপঞ্জী লেখার প্রচেষ্টা নিয়ে কথা বলে চলেছে। ‘পরে পড়ে দেখেছি, বর্তমানের আমির চেয়ে অতীতের আমিটা (দিনপঞ্জীতে) অনেক বেশি আছে।’ তারপর আরেকটু থেমে, ‘আরেকটা মজার ব্যাপার কী জানো?’ এবার অনেকক্ষণ তিনি থেমে রইলেন, তাঁর জায়গায় তরুণী বলে উঠল, ‘ভবিষ্যতের না থাকা আপনিটা আপনার লেখায় এসে গেছে।’
একটি ছবি যখন সবদিক থেকেই বিবর্ণ, বাহুল্যবর্জিত, তখন তার সংলাপরচনায় এমন আরোপিত কাব্যিকতা বা দার্শনিকতা কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এমনকি যে শেষ উদাহরণটি দিলাম, সেখানে সাউন্ড ডিজাইন এতটাই নিকৃষ্ট যে গাড়িঘোড়ার শব্দের আড়ালে সংলাপ প্রায় অস্পষ্ট হয়ে যায়, বারবার রিওয়াইন্ড করে শুনে ঠাহর করতে হয় সংলাপে ঠিক কী বলা হচ্ছে। যদি ধরেই নিই যে বাজেটে কুলোচ্ছে না বলে পরিচালক উপযুক্ত সাউন্ড ইকুইপমেন্ট জোগাড় করতে পারেননি, বা ডাবিঙের উপযুক্ত স্টুডিও-ও তাঁর আয়ত্তে ছিল না, তা সত্ত্বেও কেন তিনি ঐ জায়গায় সংলাপ রাখলেন? স্লো সিনেমার শ্রেষ্ঠ যেসব দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে রয়েছে, সেখানে সাউন্ড ব্যবহারের পারিপাট্য কিন্তু প্রশ্নাতীত। সেরকম পারিপাট্য না থাকলে এবং শব্দসৃষ্টিতে পরিমিতিবোধ দেখাতে না পারলে, বাস্তবের সার্থক ঘনবিবরণ কখনোই সম্ভব হয় না। সংলাপরচনা গল্পের জরুরি অংশ বটে, কিন্তু তার পাশাপাশি সে শব্দপরিকল্পনারও অংশ। শুধু দর্শককে সারগর্ভ বাণী শোনালে, গুরুগম্ভীর মেসেজ দিলে বা পরিচালকের উথলে ওঠা কাব্য ও দর্শনবোধকে সংলাপের মধ্যে উপুড় করে দিলেই কেল্লা ফতে হয় না। সংলাপকে ব্যবহার করতে হয় ফিল্মের সবকটা প্লাস্টিক এলিমেন্টের সাথে তাল মিলিয়ে, তাদের চাপানউতোরের সাথে সাযুজ্য রেখে। সেখানে একেবারেই অতিরেক হবে না এমন নয়, তবে সেই অতিরেকের নিজস্ব ব্যঞ্জনা থাকবে, সেই ব্যঞ্জনা ভারসাম্যরক্ষার জন্য ছাপ রেখে যাবে ছবির শব্দ ও দৃশ্যপটে। এক্ষেত্রে সংলাপ রচনার পরিমিতিবোধ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের একটি মন্তব্য উদ্ধৃতি করার লোভ সামলাতে পারছি না: “বাংলা ছবিতে চটকদারি সংলাপের একটা রেওয়াজ অনেকদিন থেকেই চলে আসছে। এ ধরনের সংলাপ ছবির চেয়ে নাটকেই মানায় বেশি। নাটকে কথাই সব, ছবিতে তা নয়। নাটকের পরিবেশের সাথে বাস্তব পরিবেশের মিল এত সামান্য যে, নাটকের দর্শক পাত্র-পাত্রীর মুখে বাস্তবজীবনের স্বাভাবিক কথোপকথন আশাই করে না।…আমাদের দেশের চিত্রনাট্যকার অনেকসময়ই এই পার্থক্যটি মনে রাখেন না। বিশেষত নায়ক-নায়িকার মুখে যেসব কথা প্রয়োগ করা হয়, সে সংলাপ ছবির চেয়ে নাটকেই মানায় বেশি।…চলচ্চিত্রে সময়ের দাম বড় বেশি। যত অল্প কথায় যত বেশি বলা যায়, ততই ভালো; আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।”
দুঃখের বিষয়, আমি ও মনোহরের নাটুকে কৃত্রিম সংলাপের বাহুল্য স্লো সিনেমার উৎকৃষ্ট নজির-গুলির সাপেক্ষে বেমানান হলেও, গড়পড়তা বাংলা ছবির তুলনায় খুব একটা বেখাপ্পা ঠেকে না। বাজে বকার ব্যামো বাংলা ছবির মূলধারা এবং ‘স্বাধীন’ – এই দুই ক্ষেত্রেই এত বাড়াবাড়ি আকার ধারণ করেছে যে, তার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এবং স্রেফ সাউন্ড-ইমেজের ওপর নির্ভর করে ন্যারেটিভ ফিল্ম বানানোর স্বার্থে অবিলম্বে সকল পরিচালকের নতুন করে চলচ্চিত্রের অ আ ক খ শেখা দরকার। সিনেমার প্লাস্টিক উপাদানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে কীভাবে সিনেম্যাটিক ভাবনার জন্ম দিতে হয়, সেই কাজে এককালে কী মেনস্ট্রিম, কী আর্ট সিনেমা- দুই ধারার বহু বাঙালি পরিচালক সিদ্ধহস্ত ছিলেন। পূর্বজদের সেই মুনশিয়ানা নিয়ে আজও আমরা গর্ব করি। বাংলাদেশের বাংলা সিনেমায় কিন্তু এখনও এই ঐতিহ্যকে সযত্নে জিইয়ে রাখা হয়েছে এবং নিত্যনতুন ফিল্ম বানিয়ে তাকে দিন দিন করে তোলা হচ্ছে আরো সমৃদ্ধ। অথচ সেই মুনশিয়ানার অভাবের দরুণ, গ্লোবাল সিনেমার লেটেস্ট ট্রেন্ড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও, বর্তমানে বাংলা সিনেমার ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। ‘যা দেখি তারই ভিডিও করি এবং যা ভিডিও করি তাই জনসমক্ষে পেশ করি’- সোশাল মিডিয়া আমদানির পর এটাই হয়ে গেছে স্ট্যান্ডার্ড লজিক, তার ওপর আজকাল বেশিরভাগ ‘স্বাধীন’ পরিচালকদের ছবি দেখলে মনে হয় তাঁরাও একে বেদবাক্যের মত স্বীকার করে নিয়েছেন, অতএব সংযম নামক গুণটি তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করাও অন্যায়। ইদানীং বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান আসছে। আশঙ্কা হয়, এরকম চলতে থাকলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন, পরাধীন – পশ্চিমবঙ্গের সব বাংলা ছবির জন্যই স্ট্রেচার ধরার ডাক পড়বে। অলমিতি।