১
আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা ছবিটিকে যদি রূপকথা বলি, তাহলে যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই খানিক ভ্রূ কোঁচকাতে পারেন। বস্তুত, ছবিটিকে রূপকথা বলে দাগিয়ে দেওয়ার মতো কোনও উপাদান ছবিটিতে আপাতভাবে নেই। তা সত্ত্বেও এই প্রসঙ্গ ছবিটির আলোচনায় আসবে; আসবে ভাষার সূত্র ধরে। ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ রূপকথার ভাষ্য। এই এক ফ্রেজেই রূপকথার গল্পের নির্মীয়মাণ জগৎটিতে দর্শককে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়; পাঠকের পরিপার্শ্বের বাস্তব সময়টি থেকে গল্পে ঘটমান সময়টি আলাদা করে নেওয়াতেই রূপকথার জগৎ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার সূত্রপাত। যে ছবি তার নামের মধ্যেই লিখে রেখেছে এই ফ্রেজ, সে ছবির আলোচনায় রূপকথার প্রসঙ্গ আসা জরুরি এবং বাঞ্ছনীয় বইকী। অতএব ছবির নামের মধ্যে প্রাথমিকভাবে যে রাজনীতি নিহিত রয়েছে, সেই রাজনীতিটি বিশ্লেষণ করে না এগোলে ছবিটির পাঠে খানিক ফাঁক থেকে যাবে বলে আমার ধারণা।
গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে সমাজতত্ত্বের জগতে আলোড়ন ফেলে দিলেন ফরাসি নৃতাত্ত্বিক ক্লদ লেভি-স্ত্রস। ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ দি সশিওরের স্ট্রাকচারালিজমের (এই শব্দের বাংলা হিসেবে ‘গঠনবাদ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করতে চাই না) ভাবনার রেশ ধরে স্ট্রাকচারালিজমকে তিনি নিয়ে এলেন সমাজতত্ত্বের আঙিনায়; দেখালেন একটি সমাজের মিথ, লোককথা প্রভৃতির মধ্যে নিহিত থাকে সেই সমাজের বিবিধ আকাঙ্ক্ষা, অ্যাংজাইটি, কৌতূহল প্রভৃতি প্রবৃত্তি। রূপকথার আড়ালে, একদম তলার দিকে লুকিয়ে থাকে সমাজের ‘র’ অংশটি। লেভি-স্ত্রস এবং পরে অন্যান্যরা রূপকথা, উপকথা, মিথে নিহিত সমাজের সেইসব ‘র’ অংশটির খোঁজ করা শুরু করলেন১। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে রূপকথা আর কেবলমাত্র রাজকুমার-রাজকুমারীর মিলনগাথা নয়, নেহাতই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন শেখানো বাচ্চাভোলানো কাহিনী নয়; তা একটি সমাজের সংস্কৃতির জরুরি ডকুমেন্টেশনও বটে। কাজেই যে ফিল্মের নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে রূপকথার গল্পে একচেটিয়া হয়ে যাওয়া ফ্রেজ; সেই ফিল্মকে প্রাথমিকভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটু তলিয়ে দেখা বলে জরুরি মনে করছি।
মোটামুটি অর্ধদশক আগে থেকে যে ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দেশজুড়ে— এ রাজ্যে সেই ঘটনার অন্যতম একটি ফলাফল হল কলকাতা মহানগরীর একটি পণ্য হয়ে ওঠা। বলা ভালো, কলকাতা শহরের কতকগুলো বিশেষ বিশেষ অঞ্চল হয়ে উঠল একেকটি পণ্য। সেইসব অঞ্চলকে যিনি যত চকচকে মোড়কে মুড়ে দেখাতে পারবেন; তাঁর পুঁজির ভাঁড়ার তত পড়বে উপচে। আগে কলকাতার পিঠ-চাপড়ানি পাওয়া কলকাতা-সংলগ্ন অঞ্চলের বাঙালির কাছে ভীষণ জরুরি একটা বিষয় ছিল, সেই মানসিকতাকেই উস্কে দিয়ে গেল ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। বাঙালি এখন শয়নে-স্বপনে শুধু কলকাতাকে দেখতে পায়। বর্ষার ময়দান ছাড়া তার প্রেম জাগে না, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম যান বললে তার মাথায় সাদা নীল ট্রামের ছবি ভেসে ওঠে, রবীন্দ্রসদনে না গেলে তার চায়ের মাটির ভাঁড়ে চুমুক দিতে ইচ্ছে করে না, নিওন আলো ছাড়া সে অন্ধকার দেখে, প্রতিটা বাক্যে শহর না বললে তার শরীর আইঢাই করে। সামাজিক মাধ্যমে কলকাতাকে নিয়ে যে হ্যালহেলে উদযাপন উত্তরোত্তর বাড়ছে, সেই উদযাপনটিই প্রতিফলিত হয় সমকালীন বাংলা ছবিতে। যে কোনও গড় বাংলা ছবি দেখুন- সেখানে কলকাতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সারা বিশ্বকে দেখা হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ গানে জ-কে ‘z’-র মতো উচ্চারণ করে পরপর ধ্বন্যাত্মক শব্দ বসিয়ে দেওয়া, বালিগঞ্জ-পার্কসার্কাসের ঝুপড়ির মানুষের পরিশীলিত বাংলায় কথা বলা, সকলের মুখে চালাক চালাক সংলাপ বসিয়ে দেওয়া এই কলকাতা-সর্বস্বতা রোগের লক্ষণ। আজকাল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল একটা ঐতিহাসিক স্থাপত্য হিসেবে যতটা তাৎপর্যপূর্ণ গণ্য হয়, তার থেকে অনেক বেশি একটা ‘সেলেবল কমোডিটি’ বা বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে বাজারে স্বীকৃত। অথবা, উত্তর কলকাতার গলি বা পুরোনো বনেদি বাড়ির ইতিহাস জানতে যত না মানুষ আগ্রহী; তার থেকে ঢের আগ্রহী সেখানে প্রি-ওয়েডিং ফটোশ্যুট করে কলকাতা-কেন্দ্রিক বায়বীয় মায়াজগতে বুঁদ হয়ে থাকতে। কলকাতার এই একচিলতে পরিধির বাইরে থাকা মানুষের কাছে কলকাতা নামক সাংস্কৃতিক পুঁজির দৃষ্টিতে জাতে ওঠার যে প্রবল বাসনা ছিল, তা থেকেই ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতাকে একটা বিক্রয়যোগ্য এনটিটি হিসেবে গড়েপিটে নেওয়া শুরু। ফলত, কলকাতার কয়েকটি নির্দিষ্ট দিকই বারংবার উঠে আসতে শুরু করল সিনেমার পর্দায়, বইয়ের পাতায়, নাটকের মঞ্চে, ফটোগ্রাফির বিষয়ে। একটি বহুমাত্রিক শহরের একমাত্রিক প্রদর্শন আমাদের ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দিতে শুরু করল কলকাতার যে অঞ্চলগুলির তেমন ‘সেলেবিলিটি’ বা বিক্রয়যোগ্যতা নেই, সেইসব অঞ্চলের কথা। ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা-র যে বিষয়বস্তু, তার অন্যতম জরুরি একটি দিক হল এই অদেখা বা উপেক্ষিত কলকাতার দিকে আলোকপাতের চেষ্টা। এই যে শহরের ঘুণ ধরে যাওয়া অঞ্চল, পচেগলে হেজে যাওয়া শরীরের দিকে নজর দেওয়ার প্রচেষ্টাটি হল, তা অন্তত একটি জরুরি ঘটনা। শহরের পচাগলা ঘা-টিকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। প্রলয় দেখেও অন্ধ হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হচ্ছে না। বিক্রয়যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, পণ্য হিসেবে উপযুক্ত করে তোলার জন্য যে পালিশ, রঙের যে পোঁচ কলকাতার গায়ে দিনের পর দিন ধরে পড়েছে- সেইসব পালিশ, রঙের পোঁচকে সন্তর্পণে তুলে কলকাতার অদেখা, বা, বলা ভালো দেখেও না দেখে থাকার ভান করে থাকা ঘটনাগুলির দিকে আলো ফেলার প্রচেষ্টা হচ্ছে; এইটুকু অন্তত সাধুবাদযোগ্য। এই কলকাতা বিস্মৃতপ্রায় ক্যাবারে-ড্যান্সার মিস শেফালিরও শহর— এই কলকাতাতেই মাল্টিপ্লেক্সের দাপটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সিঙ্গল-স্ক্রিন— এই কলকাতা বারংবার কেঁপে উঠছে জনরোষে— এই কলকাতা অবলীলায় তার আত্মাটিকে ত্যাগ করে ওপরে লাগিয়ে দিচ্ছে সস্তা রঙের পোঁচ।
প্রশ্ন উঠতে পারে- ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা কিভাবে মূলধারার কলকাতাকে প্রত্যাখ্যান করে বিস্মৃতপ্রায় সমান্তরাল কলকাতাকে তুলে ধরছে? ছবিটির মূল চরিত্ররাই যে শুধু মূলধারার কলকাতায় বেমানান তা নয়, ছবিটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজস্বপন্থায় তার চরিত্রদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় ঝলমলে, বহুপ্রদর্শিত কলকাতা থেকে। এই প্রসঙ্গে ছবিটির ফোকাসের ব্যবহার নিয়ে একটু কথা বলা যেতে পারে।



ছবিটির বিভিন্ন পর্যায়ে ফোকাসের ব্যবহারকে মন দিয়ে লক্ষ করলে একটা পুনরাবৃত্ত প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যাবে। যে দৃশ্যে রাজা আর পিঙ্কি বসে বিদেশভ্রমণের স্বপ্ন দেখছে- সে জায়গায় ডিফোকাসে নির্মীয়মাণ পুজোমণ্ডপ (সম্ভবত) দেখতে পাওয়া যায়। ইস্টার আইল্যাণ্ডের মূর্তির আদলে তৈরি করা কতকগুলো মূর্তি, তাজমহলের রেপ্লিকা এবং সেইসব স্থাপত্য সংলগ্ন সমস্ত ঝলমলে আলোকে ক্যামেরা শ্যালো ফোকাসে আবছা করে দেয়। (ছবি ১)। এলা এবং ভাস্করদা নৌকায় চড়ে নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন; সেই সময় আবারও পেছনের ঘাটগুলির ঝলমলে আলোকে ক্যামেরা ব্লার করে দেয় (ছবি ২)। এই দু’জনই যখন নতুন ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে পানীয় সহযোগে নতুন বাড়ি কেনার উদযাপন করছেন, তখনও দূরে বহুতলের আলোগুলি জোনাকির মতো লেগে আছে পর্দার গায়ে; ডিফোকাসে, আবছায়া হয়ে (ছবি ৩)। এই আলো ঝলমলে কলকাতা, লাইমলাইটের মাঝামাঝি থাকা মায়ানগরীর সঙ্গে এই মানুষগুলির স্মৃতি, স্বপ্ন, কামনা-বাসনার কোনও সরাসরি সংযোগ নেই। তাই বারংবার আদিত্যবিক্রম ফোকাসের ব্যবহারে ‘বিক্রয়যোগ্য কলকাতা’-কে তাঁর চরিত্রদের, ন্যারেটিভের থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। কলকাতার যে অংশের স্রোতে মানুষ সামিল হতে চায়, যে অংশের যাপনের শরিক হতে চায়- সেই অংশকে পরিচালক রেখেছেন আবছা। আর যে সমস্ত মানুষগুলোর গল্প ছবিটির উপজীব্য, তারা দর্শকের সবথেকে কাছাকাছি অবস্থান করছে। কলকাতার এরকম একমাত্রিক প্রদর্শনের বিরক্তিকর চর্বিতচর্বণের যুগে ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র ফোকাসের এই ব্যবহার আমার কাছে চূড়ান্ত রাজনৈতিক একটি সিদ্ধান্ত।
পাশাপাশি, ছবিটির শট স্কেলিংও মন দিয়ে লক্ষ করলে চরিত্রগুলোর একাকীত্ব বেশ ফুটে ওঠে। বুবুদা, যিনি আপাত-অনর্থকভাবে আগলে বসে আছেন একটি মৃতপ্রায় থিয়েটার হল, যিনি এই ছবিতে বিস্মৃত কলকাতার আত্মাটির একজন মূর্ত রূপ – তাঁকে ছবিটি বেশিরভাগ সময়ে পরিপার্শ্বের সঙ্গে একাত্ম করে রাখে। কখনও ওয়াইড শট নিয়ে, কখনও মিড শট। বুবুদাকে খুব বেশি পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করলে ছবিটির রাজনীতি ঘেঁটে যাবে। বুবুদার শরীরের আত্মা এখানে মৃতপ্রায় কলকাতা, যে নীরবে তার দিন ঘনিয়ে আসা দেখছে। শেষে যখন মহা প্রত্যাশিত সেতুখানি ভেঙে পড়ছে, চরিত্রদের জীবন বিভিন্নভাবে ঘেঁটে যাচ্ছে- তখন বুবুদাও মারা যান। বুবুদার মৃত্যু ছবিটি দেখায় না। পচাগলা গন্ধের কথা বলে, মাছির ভনভনানি শোনায়। লোকচক্ষুর আড়ালে যে কলকাতার আত্মাটি মারা যাচ্ছে, বুবুদার এরকমভাবে মারা যাওয়ার ঘটনা তার একটি সিম্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু বুবুদা বাদে বাকি চরিত্ররা বহুবার শ্যালো ফোকাসে পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মেয়েকে দাহ করে আসার পর এলা, ব্রিজ তৈরি হওয়ার সময়ে অসহায় ভাস্করদা আসেন শ্যালো ফোকাসে, ক্লোজ শটে; আশেপাশের পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে তাঁদের বিপন্নতাটা স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কাজেই ফোকাসের এহেন ব্যবহার, শট স্কেলিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চরিত্রকে বিভিন্নভাবে ট্রিট করার সিদ্ধান্তকে আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে বিক্রয়যোগ্য, ঝাঁ-চকচকে কলকাতার বিরুদ্ধচারণ করে কলকাতার বিস্মৃতপ্রায় শ্রেণি, বিস্মৃতপ্রায় চরিত্র, ডাইনোসরটির মতোই বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্তপ্রায় মানুষের পক্ষ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হিসেবে পাঠ করব।
কিন্তু এখানেই তৈরি হয় ছবিটির দুটো প্রধান সমস্যা। ছবিটি কলকাতার ঝাঁ-চকচকে মোড়কটি খুলে ভেতরের পচাগলা, দগদগে ঘা-টি দেখতে চায় বটে, কিন্তু দ্বিবিধ কারণে সেইটি পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি বলেই আমার ধারণা। অর্থাৎ ছবিটি পণ্যায়িত কলকাতাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেও তার চরিত্রদের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে দাঁড়াতে পারেনি বলে আমি মনে করি। পালিশ তুলে, রঙের পোঁচ মুছে ফেলে দগদগে ঘা-ওয়ালা শহরটিকে দেখার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে ওঠে আরেকটি পালিশ, আরেকটি কৃত্রিম রঙের পোঁচ- ফর্মের পালিশ, স্টাইলের পরত। দ্বিতীয়ত, ছবিটি ‘একদা এই কলিকাতায় যাহা হইয়াছিল’-র গল্প বলতে চাইলেও আসলে বিশ্বাসযোগ্য কোনও স্পেস তৈরি হয় না, বলা ভালো, কোনও সংযোগ স্থাপনের জমি পাওয়া যায় না। ছবিটি ছবির মতো এগিয়ে চলে, দর্শককে দেয় না একটি নির্দিষ্ট লোকেশনের ধারণা। অবশ্যই এখানে একটা পাল্টা যুক্তি আসতে পারে- চরিত্রগুলোকে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় রাখা হয় না বলেই তাদের বিপন্নতাটা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এটা একটা জোরালো যুক্তি। কিন্তু, ছবিটি শুধুই পরিপার্শ্ব থেকে চরিত্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে, চরিত্ররাও যে কখনও এই শহরের অংশ ছিল তার পক্ষে কোনও কথা বলে না। পিঙ্কি-রাজা যে রবীন্দ্রসদনের আর পাঁচটা যুগলের মতোই জরুরি, শহরের অপরিহার্য একটি যুগল; ঘুপচি ঘুপচি পুরোনো এঁদো বাড়িগুলো যে দক্ষিণ কলকাতার পোস্টারসজ্জিত ছিমছাম ফ্ল্যাটের মতোই এই শহরের জ্যান্ত সত্যি তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। ছবিটি শুরু থেকেই মূলধারার কলকাতা থেকে এই চরিত্র, এই অঞ্চলগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে বলে চরিত্রগুলিকে শুরু থেকেই অগোছালো, নড়বড়ে মনে হয়। বিস্মরণের তো একটা ইতিহাস, নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত আছে। একসময়ে এই মানুষগুলি প্রাসঙ্গিক ছিলেন, ধীরে ধীরে তাঁরা বিচ্ছিন্ন- এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় না বলেই বিপন্নতাটা কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নতায় ফুটে ওঠেনি। এই নিয়ে এই লেখার পরের দিকে বিশদে আরও কিছু কথা বলব। মূল তর্কদুটি করার জন্য দু’টি অন্য কাজের ক্রমাগত রেফারেন্স প্রয়োজন। প্রথমটি একই বছরে মুক্তি পাওয়া ঈশান ঘোষের ছবি ঝিল্লি, অপরটি আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে প্রকাশিত টেক্সট কালিকানন্দ অবধূতের ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’। এই দুই টেক্সটকে ক্রমাগত আলোচ্য ছবিটির সঙ্গে তুলনায় না আনলে আমার বক্তব্যটি যথেষ্ট স্পষ্ট হবে না।
২
গত বছরের গোড়ার দিকের কথা। আহমেদাবাদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-র সূচনা করতে এলেন, পরীক্ষিৎ নগরের রাস্তার ধারের বস্তিগুলি ঢেকে দেওয়া হয়েছিল সাদা কাপড় দিয়ে। ২০১০ সালে নিউ দিল্লিতে যখন বসল কমনওয়েলথ গেমসের আসর; তখন তৎকালীন সরকার ‘সৌন্দর্যায়ন’-র জন্য যেমন রাস্তাঘাট সারাই, আলো বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন; তেমনই বাঁশজাতীয় দ্রুত বেড়ে ওঠা গাছ বসিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন রাস্তার ধারের বস্তি। যাতে ‘নোংরা’ দৃশ্য, ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় বহির্বিশ্বের সামনে হঠাৎ ল্যাংটো না হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এহেন নজির ইতিহাসে বহু রয়েছে। বস্তি, ভাগাড় বিষয়গুলি একটা শহরের রাজধানীর অস্তিত্বের মতোই সত্যি, কিন্তু তাকে কে কতটা অস্বীকার করতে পারে তার মধ্যেই বুঝি নিহিত থাকে শহরটির মহত্ব। এ শহরে প্রিন্সেপ ঘাট, নন্দন যেমন সত্যি; ঠিক ততটাই সত্যি ধাপা। এ শহরে ওলিপাবের পর্ক যতখানি সত্যি, ঠিক ততখানি সত্যি গু খাওয়া শুয়োর শিকার করে, ঝলসে ধাপার কর্মীদের গণভোজন। একটা শহরের হাগা-মোতা, পচাগলা লাশ যেখানে গিয়ে জড়ো হচ্ছে, সেই জায়গাটিকে মূলধারার শিল্প অস্বীকার করবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

এখানেই সামনে আসে ঈশান ঘোষের ঝিল্লি। ছবিটি শুধু এই জায়গাটিকে দর্শকের সামনে সটান নিয়ে গিয়ে তুলে ধরে তা নয়, যেভাবে দেখায়, তা-ও সমান অস্বস্তিদায়ক। প্রান্তচারী মানুষদের জোর করে কেন্দ্রে টেনে নিয়ে আসে না, কেন্দ্রের মানুষদের নিয়ে যায় সেই অস্বস্তিকর প্রান্তটিতে, যেখানে গুয়ের গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত কিন্তু নাক ঢাকার মতো কাপড় নেই। যেখানে রক্ত ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে মৃত ঘোড়ার শরীর থেকে কিন্তু বমি করার শক্তিটুকু নেই। ঝিল্লি-র একটি শটও স্টেবিলাইজ করা নয়, একটি শটও স্থিতিশীল নয়; ক্রমাগত জার্ক দিয়ে, এক্সট্রিম ওয়াইড লেন্সে মানুষের মুখের অস্বাভাবিক ক্লোজ আপ নিয়ে ঝিল্লি ধাপা নিয়ে সাধারণ মানুষের অস্বস্তিটি চারিয়ে দেয় ছবির পর্দায়, ক্রমাগত বিবমিষা, পেটে মোচড় উদ্রেক করে। ঝিল্লি যে শুধুমাত্র প্রান্তচারী মানুষদের গল্প বলেছে তা নয়, প্রান্তচারী মানুষদের গল্প বলার জন্য এমন একটি কায়দা বেছে নিয়েছে যা মূলধারায় প্রচলিত নয়; যা স্বস্তিদায়ক কৌশল নয়; স্থির ক্যামেরায় গৃহীত যে সমস্ত শট দেখে, সুশ্রাব্য সরোদের সুর শুনে মন শান্ত হয়ে আসে, তার সম্পূর্ণ একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত একটি কায়দা। অতএব, ঝিল্লি উপেক্ষিত মানুষদের গল্প বলার জন্য তৈরি করে নিয়েছে সমান্তরাল একটি ফর্ম। তাই ঝিল্লি শুধু কনটেন্টেই মূলধারার বিরোধিতা করছে না; বিরোধিতা করছে মূলধারার গল্প বলার কায়দারও। ঝিল্লি ছবিটির কিছু কিছু বিষয় নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে কিন্তু যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সকলেই মোটামুটি একমত হবেন যে ছবিটি গল্প বলার কায়দায় অন্তত বাংলা বাজারে নতুনত্ব আনতে পেরেছে। দর্শককে এসি হলে আসনে বসিয়ে আরাম দিয়ে পরিপার্শ্ব ভুলিয়ে দেওয়ার যে চর্চা বাংলা বাজারে শুরু হয়েছে, তার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে কতকগুলো ল্যাংটো সত্যিকে ছেড়ে দিয়েছে দর্শকের সামনে, দর্শকের প্রতিটি অস্বস্তিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে।
ঠিক এই জায়গায় তৈরি হয় ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র প্রথম সমস্যাটি। ঝিল্লি যে সমস্ত মানুষের গল্প বলে, তারা আক্ষরিক অর্থেই ‘ডিসকার্ডস’; সেখানে ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র চরিত্ররা বাতিল না হলেও উপেক্ষিত তো বটেই। উপেক্ষিত- বিস্মৃতপ্রায়-প্রত্যাখ্যাত। সেইসমস্ত প্রান্তিক মানুষদের ছবিটি টেনে নিয়ে আসতে চায় কেন্দ্রে। অর্থাৎ ঝিল্লি যেভাবে প্রান্তচারীদের কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মানুষকে; ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা’ উল্টোটা করে, অর্থাৎ প্রান্তচারীদের নিয়ে আসতে চায় মঞ্চের মাঝামাঝি। সেই কাজটি এই ছবিটির ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। আগেও বললাম, ঝিল্লি অনালোচিত এবং উপেক্ষিত মানুষদের কথা বলার জন্য আশ্রয় নেয় একটা বিকল্প ফর্মের, যা মূলধারার স্বীকৃত কথনরীতি নয়। কাজেই অস্বস্তিটা শুধুমাত্র কনটেন্ট থেকেই নয়, উঠে আসে ফর্ম থেকেও। কিন্তু ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা আশ্রয় নেয় মূলধারার চর্চিত ফর্মের; যে ফর্ম একটি পেলব পশমে মুড়ে তুলতুলে করে পেশ করে কনটেন্ট। একদা কলকাতায় যা সব ঘটত, তাকে তুলে আনাই যদি এ ছবির মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে একটা বিকল্পরীতিকে গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন ছিল, অন্তত, মূলধারার চর্চিত ফর্মের সঙ্গে বিকল্প গল্প বলার ক্ষেত্রে আরও সচেতন থাকা জরুরি ছিল। ফর্মের গুরুত্ব বুঝতে গেলে আবার আমাদের একটু ডাইগ্রেস করতে হবে।
ফরাসি বিপ্লবের কয়েকদশক পর অনার দি বলজাক যখন উপন্যাস লিখছেন, তখন তাঁর লিখনশৈলী তাঁকে পূর্বতন লিখিয়েদের থেকে আলাদা করে তুলছে। তাঁর লিখনশৈলীর মাধ্যমে সমাজের পুনর্পবিত্রকরণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন সমালোচকরা। কী করেছিলেন বলজাক? দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করে, অতিরঞ্জিত উপমা ব্যবহার করে পাঠককে প্রস্তুত করে দিতেন বিটুইন দ্য লাইনস পড়ার জন্য, সেই বিটুইন দ্য লাইনসে নিহিত থাকত প্রাগাধুনিক যুগের নৈতিক মূল্যবোধ, কর্মফল প্রভৃতি ‘পবিত্র’ বিষয়সমূহ। আধুনিকতা এসে মানুষকে যৌক্তিক, উন্নত করেছে বটে, কিন্তু এই সমস্ত নৈতিকতাকে পেছনের সারিতে ঠেলেও দিয়েছে বলে অনেকে মনে করতেন। ফরাসি বিপ্লবের পর সমাজে যে প্রাথমিক নৈরাজ্য এসেছিল, তার কারণ হিসেবে অনেকে এই নৈতিকতার অভাবকেই দায়ী করতেন। বলজাকের লেখায় বিটুইন দ্য লাইনসে থেকে যেত এই নৈতিক জগৎ; একটি টেক্সটকে পাঠ করার সময়ে সচেতন পাঠক কেবল অতুলনীয় শৈলীর কারণেই খোঁজ পেতেন এই জগৎটির। আরও পরে জয়েস বা ইলিয়ট যখন লিখছেন, তখনও তাঁরা প্রধানত তাঁদের শৈলীর কারণেই পূর্বতন ঔপন্যাসিক বা কবির থেকে আলাদা হয়ে উঠছেন। কাজেই আমার যা বলার তা কিভাবে বলছি তা নিয়ে যদি না ভাবি, তাহলে সেই বলাটা মাটি হয়ে যায়। কথন এবং কথনশৈলী বিপরীতমুখী হয়ে গেলে সেই শিল্পের ছড়িয়ে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত অচেনা বা অনালোচিত মানুষের এবং শহরের কথা বলছেন কিন্তু বলছেন একটা অভ্যস্ত ফর্মে, যে ফর্ম দর্শককে প্রস্তুত করছে না একটা নতুন আঙ্গিক থেকে ছবিটিকে দেখতে- এইটিকেই আমি বলতে চাইছি প্রান্তচারী মানুষদের কেন্দ্রের দিকে টেনে আনার অপচেষ্টা। তাঁদের কথা বলতে গেলে একটা বিকল্প ফর্ম জরুরি, যে ফর্ম মানুষকে অভ্যস্ত রীতির বাইরে নিয়ে গিয়ে ভাবাবে। এই ফর্ম- স্থির ক্যামেরা, ধীর গতি, মৃদু আলো, খানিক অ্যাবসার্ডিটি— এ জিনিস ২০২২-র দুনিয়ায় খানিক ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। ক্লিশে হয়ে গিয়েছে বলেই এই ফর্ম আলাদা করে কোনও ভাবনার উদ্রেক করে না।
কেন এই কথা বলছি? বর্তমানে সিনেমাজগতে খানিক আয়রনিক্যালি ধূমকেতুর মতো উঠে এসেছে স্লো-সিনেমা। বাংলায় তো বটেই, সারাবিশ্বে এখন ফিল্মফেস্টিভ্যালগুলিতে চলছে স্লো-সিনেমার রমরমা। যে সমস্ত চলচ্চিত্র-নির্মাতারা ইন্ডাস্ট্রির ছবির সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা করে ‘অন্যধারা’-র ছবি বানাবার চেষ্টা করছেন বা ইতোমধ্যেই ‘অন্যধারার’ চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে বেশ নামডাক অর্জন করেছেন- সেই চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের অনেকেই পড়ে গিয়েছেন স্লো-সিনেমার ফাঁদে। শ্যালো ফোকাসে দৃষ্টিনন্দন ফ্রেম তৈরি করা, সুশ্রাব্য সুর তৈরি করা, ব্যস্ত জীবনের সমান্তরালে ধীর গতির জীবনকে ততোধিক ধীরগতিতে দেখানোর নেশা বড় বালাই। এই ফর্ম এখন হয়ে উঠেছে ফিল্মফেস্টিভ্যালে খ্যাতি কুড়োনোর চাবিকাঠি, মানুষজন চোখ-কান বুজে এই শৈলী প্রয়োগ করে ছবির পর ছবি বানিয়ে চলেছেন। কাজেই আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে অন্তত বাংলায় যে গোত্রে পড়েন, সেই গোত্রে এখন এই ফর্মই সর্বস্বীকৃত। এই ছবিটির ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে এই ফর্মটিকে সচেতনভাবে প্রয়োগ অথবা সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করা জরুরি হয়ে উঠেছিল। এইধরনের প্রান্তিক এবং বিস্মৃতপ্রায় মানুষদের গল্প আমরা এইরকম শৈলীতে নির্মিত ছবিতে দেখে দেখে এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, আমাদের এই জাতীয় ছবি আর বিশেষ ভাবায় না। ঝিল্লি যে অস্বস্তি দিতে পেরেছিল, চোখের সামনে শহরটা মারা যাচ্ছে দেখেও ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র ক্ষেত্রে সেই অস্বস্তি চারিয়ে যায় না। কারণ এখন তো আমরা এই মানুষগুলোর গল্প এভাবেই দেখে অভ্যস্ত। আজ থেকে সাত বছর আগে যখন এই আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তই বানিয়েছিলেন আসা যাওয়ার মাঝে, তখন এই রীতি খেটে গিয়েছিল কারণ তখন এই রীতি অন্তত বাংলায় নতুন। সাদামাটা মানুষের গল্প বলার জন্য এই ফর্মটিই তখন মূলধারার বিকল্প হয়ে উঠেছিল কিন্তু এখন, সিনেমার আরও বেশি গণতন্ত্রীকরণের পর, এইটিই চলে এসেছে খানিক মূলধারা। যে রীতি মোটামুটি দর্শকমহলে মান্য, যে রীতি অধুনা আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালমঞ্চে চর্চিত- সেই মান্য, চর্চিত, বিখ্যাত রীতি ব্যবহার করে পুনরায় অখ্যাত-অনালোচিত-উপেক্ষিত-প্রত্যাখ্যাত মানুষজনের গল্প বলার ভাবনা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক, কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে গেলে আরও বেশি সচেতন থাকা প্রয়োজন ছিল। সেই সচেতনতার অভাব যেন খানিক পরিলক্ষিত হয়।
একজন শিল্পীর শিল্প যখন আমরা কাটাছেঁড়া করতে বসব, তখন শিল্পী সম্পর্কে যাবতীয় পূর্ব আহরিত ধারণা, যাবতীয় ‘এনিগমা’ কাটিয়ে বসা জরুরি— ফিল্ম স্টাডিজের ক্লাসে বলেছিলেন অরিজিৎদা, অধ্যাপক অরিজিৎ মণ্ডল। এক্ষেত্রে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত একটি সফল ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁর আগের দুটি ছবি দেখে মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু ধারণা তৈরি করে ফেলেছে। আসা যাওয়ার মাঝে দু’জন অতি সাধারণ মানুষের ছিমছাম প্রেমের ছবি, সেখানে উক্ত শৈলী খেটে গেছে। জোনাকি অত্যন্ত ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে উঠে আসা কিছু ছবি, সেখানেও এই শৈলীর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-য় এই শৈলীর ব্যবহার হয়তো আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের পরিচালক হিসেবে ইমেজ অক্ষুণ্ণ রাখে; কিন্তু ছবিটির চরিত্রদের সঙ্গে একাত্মতা তৈরি না হওয়ার কারণ এই শৈলীর অসচেতন প্রয়োগই। ঝাঁ-চকচকে পালিশটি তোলার কাজে নিমগ্ন হওয়া যায় না কারণ একেকটি পালিশ তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্ত হতে থাকে ফর্মের পালিশ- পেলব আলো, ধীরস্থির শট, তুমুল স্পেকট্যাকল প্রভৃতি। ঝিল্লি-র বকুলকে বিশ্ববাংলার গেটের সামনে পুলিশের লাথি মারার দৃশ্য যে ক্ষিপ্রতা ও সচেতনতায় মনে করিয়ে দেয় বস্তিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ঘটনা; ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা সেরকমভাবে কখনওই খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তার চরিত্রদের পক্ষ নিতে পারে না; পরিচালকের ইমেজ এখানে ছবির প্রয়োজনকে কোথাও গিয়ে ঢেকে দেয়। ছবিটির চরিত্রদের সঙ্গে দর্শক একাত্ম হওয়ার আগেই, বিষয়বস্তুর গভীরে ঢোকার আগেই তারা আবিষ্ট হতে থাকে সমান্তরাল পালিশে। যা কিছু সুললিত, যা কিছু ধীরস্থির, যা উত্তাল নয়- তাকে ‘কাব্যিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যেস থেকে আমরা এই ছবিটিকেও বলেছি ‘কাব্যিক’, বলেছি ‘পোয়েটিক ইমেজারি’। ঠিক এখান থেকেই আমার দ্বিতীয় বক্তব্যের দিকে যাওয়া শুরু।
৩
তাহলে কি প্রান্তচারী মানুষদের জীবনকে কবিতার মতো করে কেউ দেখাতে পারবেন না? সুললিতভাবে তাঁদের কথা কেউ বলতে পারবেন না এরকম কোথাও দাসখত লেখা আছে কি? একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসতে পারে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্যই আমাকে একটু হাত পাততে হবে কালিকানন্দ অবধূতের প্রবাদপ্রতিম উপন্যাস উদ্ধারণপুরের ঘাট-এর কাছে। একেবারে সরাসরি কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক।
“উদ্ধারণপুরের দিন।
সুপ্তিমগ্না প্রকৃতির ধমনীতে নতুন জীবনের জোয়ার তুলে যে জ্যোতির্ময় উদিত হন ধরণীর বুকে, তিনি উদ্ধারণপুরের ঘাটকে সভয়ে এড়িয়ে চলেন। উদ্ধারণপুরের দিন আসে ওস্তাদ জাদুকরের বেশ ধরে। ভেল্কি-বাজির সাজ-সরঞ্জাম-বাঁধা প্রকাণ্ড পুঁটলিটা পিঠে ফেলে আঁধার কালো যবনিকার অন্তরাল থেকে নিঃসাড়ে পা টিপে টিপে আবির্ভূত হয় উদ্ধারণপুরের দিন। ধীরে ধীরে যবনিকাখানি চোখের ওপর মিলিয়ে যায়। আলোর বন্যায় ভেসে যায় রঙ্গমঞ্চ। হেসে ওঠে উদ্ধারণপুরের ঘাট। পোড়া কাঠ, ছেঁড়া মাদুর, চট কাঁথা, বাঁশ চাটাই, হাড়গোড়, ভাঙা কলসী সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। হাড়গিলাদের ঘুম ভাঙে। শকুনিরা ডানা ঝাপটে সাড়া দেয়। আকাশের দিকে মুখ তুলে শেয়ালেরা শেষবারের মত বলে ওঠে— হুক্কা হুয়া-হুয়া হুয়া-হুয়া-হুয়া। অর্থাৎ কি না, হে নিশা, আবার ফিরে এস তুমি। দিনের আলোয় আমরা বড় চক্ষু-লজ্জায় পড়ে যাই কাঁচা মড়া নিয়ে টানাটানি করতে। তার ওপর ওই ওরা জেগে উঠে পাখা ঝাপটাচ্ছে, এখনি ভাগ বসাতে আসবে আমাদের ভোজে।”
অথবা, পড়ে দেখা যাক এই অংশটুকু—
“গঙ্গার ওপারে আকাশে একটি তারা খসে পড়ল। তীর বেগে নামতে নামতে হঠাৎ গেল মাঝপথে মিলিয়ে। এপারে ঐ ওধারের শেষ চিতাটা থেকে ছিটকে পড়ল একখানা জ্বলন্ত কাঠ। অনেকগুলি স্ফূলিঙ্গ লাফিয়ে উঠল আকাশের দিকে। কিছু দূরে উঠে ওরাও মিলিয়ে গেল। আকাশ থেকে যে নেমে এল সে পেল না মাটির স্পর্শ, আর আকাশ ছুঁতে যারা উঠল তারা পেল না আকাশের নাগাল। মহাশূন্য সবই গ্রাস করল।
আমাকেও।”
(বানান অপরিবর্তিত।)
আর উদ্ধৃতি বাড়িয়ে লেখার শব্দসংখ্যা বৃদ্ধি করব না। তবে যাঁর মোটামুটি উপন্যাস পড়ার অভ্যাস রয়েছে, তালিম রয়েছে; তিনি বুঝতে পারবেন উপন্যাসের ভাষা হিসেবে এই ভাষ্য কতখানি কাব্যিক। প্রথম অনুচ্ছেদটি উপন্যাসের একদম শুরুর দিকের অংশ, পরেরটি উপন্যাসের মাঝামাঝি জায়গা থেকে উদ্ধৃত। এক ভয়াবহ পুজোর মাঝে যখন সদ্যমৃতরা চিতা থেকে উঠে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে জীবন্ত মানুষদের; সেইরকম এক অবস্থার বর্ণনার পাশাপাশি লেখক লিখছেন এই দ্বিতীয় উদ্ধৃতাংশটি। শেষ ‘আমাকেও’ শব্দটি খেয়াল করুন- এর বিস্তৃতি ভাবতে বসলে বাকরূদ্ধ হয়ে যাই। এক অব্যাখ্যেয়, অবর্ণনীয় শূন্যতা এই অনুচ্ছেদটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠককে ঘিরে ধরে। উদ্ধারণপুরের শ্মশানে যে জীবন-মৃত্যুর দৈনন্দিন কারবার চলে, সেই কারবার পেরিয়ে যে রহস্যাবৃত জগৎ পড়ে আছে গঙ্গার ওপারে; সেই জগৎটির হদিশ মেলে যেন এই একটি অনুচ্ছেদেই।
এবার যাওয়া যাক প্রথম অনুচ্ছেদে দেওয়া উদ্ধৃতিতে। কেউ যদি ছবি বানাতে চান, তিনি পড়লেই বুঝতে পারবেন একেকটি বাক্য জুড়ে জুড়ে ক্লাসিক মন্তাজ হতে পারে। যে অঞ্চলের বর্ণনা কালিকানন্দ অবধূত দিচ্ছেন; তা পবিত্র শ্মশান হিসেবে স্বীকৃত হলেও ঠিক ‘ভদ্রলোক’দের জায়গা নয়। যাদেরকে ভদ্রসমাজ ‘ডিসকার্ড’ করে দিয়েছে, সেইসমস্ত প্রান্তচারী মানুষদের কথাই আগাগোড়া এই বইয়ের উপজীব্য। কালিকানন্দ অবধূত তাঁদের কথা লিখছেন, লিখছেন কাব্যিক ভাষ্যেই- অপূর্ব অনুপ্রাস ব্যবহার করে, তুলনারহিত উপমার মাধ্যমে- কিন্তু তাঁর লেখা মানুষকে নিয়ে গিয়ে ফেলছে উদ্ধারণপুরের ঘাটেই। এতটাই দৃশ্যমান তাঁর বাক্যের মধ্যে নিহিত ছবি, এতটাই স্পষ্ট তাঁর লেখা প্রত্যেকটি শব্দ। অর্থাৎ অবধূতের ভাষ্য কোথাও গিয়ে চরিত্রের কাছে, লোকেশনের কাছে পৌঁছোবার পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে না, অন্য দিকে ভুলিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে না- বরং তাঁর ভাষ্য আমাদের চোখের সামনে আরও বেশি করে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে উদ্ধারণপুরের ঘাট, উদ্ধারণপুরের ঘাটের চরিত্রদের। উদ্ধারণপুরের ঘাট জায়গাটিও একটি বিকল্প স্পেস হয়ে উঠতে চেয়েছে। লেখায় বারংবার এসেছে বহির্বিশ্বের হাসি-কান্না, দিন-রাত, প্রেম-বিরহের থেকে উদ্ধারণপুরের হাসি-কান্না, দিন-রাত, প্রেম-বিরহ কিভাবে আলাদা। রাত্রিকে পিশাচিনীর সঙ্গে তুলনা করে তার সঙ্গে সঙ্গমের উল্লেখ পর্যন্ত রয়েছে। সমাজে যে সমস্ত মানুষ ব্রাত্য- যেমন খন্তা ঘোষ, শ্মশানের এক প্রান্তে ঘর বাঁধা দেহোপজীবিনীরা, রতন মোড়ল প্রমুখ— তাদের কথাই লেখক লিখেছেন, লিখেছেন কাব্যিক ভাষাতেই কিন্তু কোথাও গিয়ে কাব্যিক ফর্ম দিয়ে তাঁকে সমান্তরাল পালিশ তৈরি করতে হয়নি। ফর্ম গিয়ে বিষয়বস্তুকে ঢেকে দেয়নি। কাব্যের সঙ্গে তো সাধারণত একটু ভদ্র, পালিশ করা, সুললিত দ্যোতনা জুড়ে দেওয়া হয় কিন্তু এক্ষেত্রে অবধূত কাব্যিক ভাষাতেই বিবমিষা, ব্রাত্যজন, ‘ছোটলোক’, মানুষের ক্ষয়-কামনা-লালসার কথা লিখে গিয়েছেন। কাজেই, ‘কাব্যিক’ শৈলী ব্যবহার করে উচ্ছিষ্ট মানুষের গল্প বলায় আমার আপত্তি নেই, কিন্তু সেই মানুষগুলোকে দেখার পথেই এই শৈলী অন্তরায় হয়ে উঠলে আমার খানিক আপত্তি করার জায়গা থাকে বইকী, যা হয়েছে ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র ক্ষেত্রে।
আবার প্রশ্ন আসতে পারে- মাধ্যম হিসেবে দুটো তো আলাদা। একটা উপন্যাসের সঙ্গে কি এভাবে জোর করে ফিল্মের তুলনা করা যায়? আমি ইচ্ছে করেই এই উপন্যাসটিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এলাম যাতে অন্য শিল্পমাধ্যমেও কিভাবে কাব্যিক ভাষা প্রান্তজনের ভাষা হয়ে উঠেছে সেইটি দেখানো যায়। এই উপন্যাসকে আলোচনায় টানা আরও একটি কারণে। লেখার গুণে উদ্ধারণপুর হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত স্পেস, দর্শক উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পাতা অবধি বুঁদ হয়ে যান উদ্ধারণপুরের ঘাটেই। পাশাপাশি যদি চরিত্রগুলিকে আমরা একটু খতিয়ে দেখি, তাহলে নিতাইদাসী, চরণদাস বাবাজী, খন্তা ঘোষ, আগমবাগীশ— এঁদেরকে কি আদৌ উদ্ধারণপুরের বাইরের চরিত্র বলে ভাবা যায়? এঁদের অভিব্যক্তির সঙ্গে, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের সঙ্গে অবধূত এমনভাবে উদ্ধারণপুরের রোজনামচা সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন, এঁরা একটা জেনেরিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করলেও একেকটি চরিত্রকে উদ্ধারণপুরের ঘাটের বাইরে এবং একেকটি চরিত্র বাদে উদ্ধারণপুরের ঘাট কল্পনা করা মুশকিল। একটা উদাহরণের দিকে আবার তাকানো যাক। নিতাইদাসী একদিন গভীর রাত্রে নীরবে কাঁদছে উদ্ধারণপুরের ঘাটে, সাক্ষী শুধু গোঁসাই। সে অংশটুকু পড়ুন-
“ঐ যে নারী, একাকিনী— অন্ধকারে শ্মশানে দাঁড়িয়ে কান্না সামলাবার চেষ্টা করছে, মনে হল— এ কান্না নতুন কান্না নয়।— অনেকদিনের জমানো অনেক কান্না আজ শ্মশানের তাপে গলে ঝরছে। মনে হল, এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই ওর, যাকে ও ঐ বেদনার সামান্য অংশও দিতে পারে। তা যদি পারত তাহলে এতটা করুণ নিষ্ঠুর বলে মনে হত না ওর ঐ নিঃশব্দ রোদনকে।
উদ্ধারণপুরের ঘাট।
সে রাত্রে অনেক অশ্রু ঢেলেছিল নিতাই উদ্ধারণপুরের ঘাটের ভস্মে। সাক্ষী ছিলাম একমাত্র আমি। একটি চিতাও জ্বলছিল না সে রাত্রে উদ্ধারণপুরের শ্মশানে। মড়ার বিছানার স্তুপের ওপর মড়ার মত কাঠ হয়ে বসে রইলাম। নির্বিকার নিরাসক্ত নিরপেক্ষ সাক্ষীর আদর্শ হয়ে। একটি আঙুল তুলতে পারিনি। একটি বাক্য গলা দিয়ে বের হয়নি আমার। যেন একটা বিষের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।”
এর পর উদ্ধারণপুরের অশ্রু বহির্বিশ্বের অশ্রুর থেকে কতখানি আলাদা তা নিয়ে আবার অবধূত চমৎকার ভাষায় লেখেন। টেক্সটের এক অংশ থেকে আরেক অংশে পৌঁছোনোর জন্য নিতাইদাসী এখানে একজন অনুঘটকের কাজ করছেন, তাঁর কান্না মিশে যাচ্ছে উদ্ধারণপুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে। এরকম প্রতিটি চরিত্রই কোথাও গিয়ে উদ্ধারণপুরের চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলেন। প্রতিটি চরিত্র উদ্ধারণপুরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, উদ্ধারণপুর প্রতিটি চরিত্র নিয়ে গড়ে ওঠা অদ্ভুত এক স্পেস। অর্থাৎ একটি গল্প/উপন্যাস/সিনেমায় যখন আমি একটি জায়গার নাম উল্লেখ করছি, তখন চরিত্রর সঙ্গে জায়গার সম্পর্ক, জায়গাটির নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার খানিক দায় বর্তায়।
এইখান থেকে তৈরি হয় ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-র দ্বিতীয় সমস্যা। ছবিটি তার চরিত্রদের মূলধারার পণ্যায়িত কলকাতার থেকে আলাদা তো করে নেয়, কিন্তু তাদের দেয় না বিকল্প কোনও অবস্থান। কতকগুলো সার্বজনীন সমস্যার মাঝখানে পড়ে কতকগুলো অগভীর চরিত্র, ফলে তাদের লোকেশনের সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক তৈরি হয় না। যেমন ধরা যাক শিশিরের চরিত্রটি। শিশিরের চরিত্রের সঙ্গে খুব ভালোভাবে প্যারালাল করা যায় উদ্ধারণপুরের চরণদাস বাবাজীর। দুটি চরিত্রই সংসার ভুলে বুঁদ হয়ে আছেন আপন জগতে, দুটো চরিত্রকে বেঁধে রেখেছে প্রেয়সীর জন্য চিরন্তন অপেক্ষা। কিন্তু চরণদাস বাবাজী যতখানি উদ্ধারণপুরের, শিশির ততখানি কলকাতার নন। অর্থাৎ উদযাপিত কলকাতার সমান্তরালে যে বিস্মৃতপ্রায় কলকাতা রয়েছে, তা ছবিতে লোকেশন হিসেবে উঠেই আসেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে বুবুদার থিয়েটার। কিন্তু এ বাদে চরিত্রগুলির বিচরণ ক্ষেত্র কোথায়? আলোচনার শুরুতে যদিও উল্লেখ করেছিলাম যে একটি শক্ত ভিতের অভাব থেকেই চরিত্রগুলোর বিপন্নতা ফুটে উঠছে এমন একটি প্রতিযুক্তি আসতে পারে। তা যুক্তি হিসেবে বেশ জোরালোও। এর উত্তর দিতে গেলে আবার একটু উপন্যাসের আলোচনায় যেতে হবে। উদ্ধারণপুরের শেষটুকু পড়লে বুক মুচড়ে ওঠে। তার কারণ হচ্ছে উদ্ধারণপুর চরিত্রগুলোর সঙ্গে অঞ্চলের জোরালো সংযোগ দেখিয়ে ধীরে ধীরে সকলকে ছিন্নমূল করে। নিতাই দাসী যখন চলে যায়, তখন বুক বিদীর্ণ হয়ে যায়। খন্তা ঘোষের করুণ মৃত্যু স্তব্ধ করে রাখে বহুক্ষণ। উদ্ধারণপুর ফাঁকা হয়ে আসছে- যে অসীম শূন্যতা গঙ্গার বুকে খাঁ খাঁ করে- সেই অসীম শূন্যতা তৈরি হয় পাঠকের মনে। সেখানে আমরা যদি ছবিটির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ছবির চরিত্রগুলি শুরু থেকেই একটি শক্তপোক্ত ভিতের অভাবে ভুগেছে। তারা কিভাবে কলকাতায় প্রাসঙ্গিক ছিল? তাদের কলকাতা কবে থেকে কিভাবে ভুলে গেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়া, একটা প্রেক্ষিতের অনুপস্থিতি ছবিটার ক্ষেত্রে আশ্রয়ের অভাবজনিত বিপন্নতার প্রশ্নটিকে মাথাচাড়া দিতে দেয় না।
সোশ্যাল ইকোলজি তর্ক করে প্রতিটা মানুষ তার পরিবেশের সঙ্গে নিরন্তর সংযোগ স্থাপন করে; তার বেড়ে ওঠা, তার যাপনে বড়সড় প্রভাব ফেলে তার পরিপার্শ্ব। কাজেই একটা চরিত্রকে কাটাছেঁড়া করে দেখতে গেলে তার পরিপার্শ্বকে মাথায় রাখা খুব জরুরি। এই ছবির পরিধিতে যেহেতু বিকল্প কলকাতা আসেই না, তাই এই চরিত্রগুলোর কাছাকাছি পৌঁছোনো দুরূহ। এমন হতে পারে যে পরিচালক নিজেই চাননি চরিত্রের সঙ্গে দর্শকের কোনও সংযোগ তৈরি হোক। কিন্তু একেকটি লং শটে চরিত্রগুলির ব্যক্তিগত পরিসরে দর্শককে থিতু হওয়ার সময় দেওয়া আবার আগের বাক্যটির পরিপন্থী। কাজেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে সংযোগ না হতে পারার কারণ ছবিটির কোনো পর্যায়েই একটি লোকেশনের স্পষ্টতা না থাকা। এখন আমরা যদি ছবিটিকে একটি ভেঙে যাওয়া সময়ের রূপকথা বলে মনে করি, তাহলে চরিত্রগুলোর ব্যাকস্টোরি না থাকার একটা কারণ দর্শানো যেতে পারে। রূপকথা চরিত্রগতভাবেই একটু জেনেরিক। নভেলধর্মী গল্পে চরিত্রদের বিস্তারিত ব্যাকস্টোরি, প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক বর্তমান কিন্তু ফেবল সবসময়েই জেনেরিক। এক কাঠুরে ছিলেন, হাত ফস্কে কুঠার জলে ফেলে দিলেন, জলদেবতা উঠে তিনটে কুঠার দেখালেন, সততার জন্য কাঠুরে তিনটি কুঠারই পেয়ে গেলেন— এ গল্প আমরা ছোটবেলায় সকলেই পড়েছি। কাঠুরে কোথায় থাকে, কেন সে কাঠ কেটেই দিন চালায়, তার শ্বশুরবাড়ি কিরকম, জঙ্গলটি পর্ণমোচী না চিরহরিৎ এ জাতীয় বর্ণনা রূপকথায় থাকে না, না থাকাই বাঞ্ছনীয়। রূপকথা সরাসরি খুব বেশি ইনফর্মেশন পাঠককে দেয় না, তাকে বিটুইন দ্য লাইনসে গিয়ে কাটাছেঁড়া করলে তবে রাজনৈতিক, সামাজিক সাবটেক্সটগুলি পাওয়া যায়। কাজেই রূপকথা চরিত্রগতভাবে সাজেস্টিভ, জেনেরিক। যদি আমরা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা-কে রূপকথা বলি, তাহলে তার চরিত্রগুলোকে হঠাৎ খতিয়ে দেখার দায় পড়ছে কেন? পড়ছে কারণ ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা তো কলকাতা নামক মায়ানগরীর পালিশটি তোলারও চেষ্টা করছে। মধ্যবিত্তের পোস্টারসজ্জিত ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে, রবীন্দ্রসদন-ময়দান-পার্কস্ট্রিট-দুর্গাপুজোর বাইরের কলকাতায় যেতে চেষ্টা করছে। যেখানে আসছে সিণ্ডিকেট রাজনীতির প্রসঙ্গ, যেখানে আসছে চিটফাণ্ড ক্রাইসিস, যেখানে আসছে সিঙ্গল স্ক্রিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত— সেইরকম একটি তথ্যে ভরা ছবির চরিত্রগুলো অগভীর হলে তো মুশকিল। রয় অ্যাণ্ডারসনের লিভিং ট্রিলজি-তে আমাদের চরিত্রের ব্যাকস্টোরি খোঁজার দায় নেই। তিনিও তিক্ত, নৈরাশ্যবাদী চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখছেন বটে; কিন্তু তাঁরও কাব্যিক ফর্ম চরিত্রের কাছাকাছি আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে। দশ থেকে বারো মিনিটের একেকটি ছোট ছোট খণ্ডে প্রতিটা চরিত্র পারফর্ম করে চলে যাচ্ছে। সেইটি রূপকথা। সেটা একটা কল্পিত স্পেস। এখানে না হয়েছে জগৎ নির্মাণ ও তার সঙ্গে চরিত্রদের সংযোগ; না হয়েছে নির্মিত জগতে চরিত্রদের ফেলে দেখা। সময়ে সময়ে চরিত্রগুলো এমনই অ্যাবসার্ড (যেমন শিশিরের ঘরের মধ্যে সানগ্লাস পরে থাকা), সেই অ্যাবসার্ডিটিকে একটা সময়ের পর জৈবিক না মনে হয়ে আরোপিত মনে হয়। এই হল দ্বিতীয় সমস্যা- যেখানে একটি শহরের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে বুড়িছোঁয়া করে ছুঁয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেশনের স্পষ্টতা এবং স্থিরতা থাকছে না; ফলত চরিত্রগুলো না পারছে মূলধারার কলকাতার অংশ হতে, না পারছে একটি দাঁড়ানোর মতো জমি খুঁজে নিতে, না পারছে সেই জমি হারানোর প্রেক্ষিত তৈরি করতে।
৪
২০১৪ থেকে ২০২২, এই আটবছরে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত যে তিনটি ছবি বানিয়েছেন, সেই তিনটি ছবি ঘটনাচক্রে তাঁর একটা ইমেজ নির্মাণ করে দিয়েছে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, যে কোনও ফিল্মমেকারই একাধিক ছবি বানানোর পর তাঁর একটা শৈল্পিক ইমেজ দর্শক তৈরি করে নেয়। কিন্তু ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা কোথাও গিয়ে সেই ইমেজের ফাঁদে পড়ে যায়। ছবিটি কখনই কলকাতার মৃতপ্রায় সত্ত্বাটিকে অস্বীকার করে না, বিস্মরণের সমস্যাকে নিজের পরিধির বাইরে রেখে ভাবতে বসে না; কিন্তু কোথাও গিয়ে ফর্ম এবং কনটেন্ট কোনও এক অসচেতনতায় বিপরীতমুখী হয়ে যাওয়ায় এবং যে জায়গায় একদা কিছু ঘটত বলে দাবি করা হচ্ছে সেই জায়গাটিকেই যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় ছবিটি ঘেঁটে গেল। শৈলী যদি বিষয়বস্তুর পরিপূরক না হয়ে উঠে বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে ‘আমাকে দেখুন’ ‘আমাকে দেখুন’ করে বারংবার ছবির সারফেসে চলে আসে; তাহলে কী তৈরি হতে পারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ছবি তার সাম্প্রতিক জলজ্যান্ত নজির হয়ে রইল। সায়ন্তনদা, সায়ন্তন দত্ত লিখেছিলেন স্লো সিনেমার শৈলী আপাতভাবে নকল করা খুব সোজা আর তা ফেস্টিভ্যাল-সার্কিটে জনপ্রিয়ও, কাজেই এই জাতীয় শৈলী আজকাল বহুব্যবহৃত (প্যারাফ্রেজ করলাম)। সেই বক্তব্যের সূত্র ধরেই আরেকটু বলা যেতে পারে। যে ছবি বিকল্প কলকাতাকে দেখার প্রচেষ্টা করেছিল, যে ছবি কলকাতার ‘উচ্ছিষ্ট’ মানুষজনের স্বপ্নকে উপজীব্য করার চেষ্টা করছিল, সে ছবিও শেষতক মূলধারার কলকাতা এবং বাকি দুনিয়ার অন্যতম চর্চিত আর উদযাপিত রীতিতে ছবি বানিয়ে অফুরান সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলল- এ বেশ দুর্ভাগ্যের। এই আর কী।
টীকাঃ
১) গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ দি সশিওরের ‘স্ট্রাকচারালিজম’-এর ভাবনা ভাষাতত্ত্ব থেকে ধার করে ক্লদ লেভি-স্ত্রস প্রয়োগ করলেন সমাজতত্ত্বের পরিধিতে। সশিওর বলেছিলেন, যে কোনও স্ট্রাকচারের থাকে একটি ‘লাং’ (Langue), যা বিশ্বজনীন, যা স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক থাকে। আর থাকে একটি ‘প্যরোল’ (Parole), যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে বদলে যায়। লেভি-স্ত্রস দেখালেন একটি মিথের বর্ণনা যতই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বদলে যাক না কেন, যতই তার ‘রিটেলিং’ হোক না কেন; মিথকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি সাধারণ ‘লাং’। ‘প্যরোল’-এর পর্দাটি সরিয়ে ‘লাং’-এর কাছাকাছি পৌঁছোতে পারলে যে সমাজ থেকে সেই মিথটা উঠে এসেছে, সেই সমাজ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। গ্রিকদের ঈডিপাসের মিথকে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখালেন মানুষের উৎপত্তি নিয়ে গ্রিকদের মনে যে দোলাচল ছিল, তা কিভাবে ঈডিপাসের মিথে প্রতিফলিত হয়েছে। আরও পরে ভ্লাদিমির প্রপ ‘মর্ফোলজি অফ দ্য ফোক টেল’ গ্রন্থে রূপকথাকে ‘এলিমেন্টারি’ অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করলেন। অতএব, রূপকথার গল্প শুধুমাত্র দৈত্য-দানো-রাজকুমার-রাজকুমারী-জাদু-পশুপাখির আঙিনা থেকে বেরিয়ে একটা নবলব্ধ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় এসে পড়ল। পরী, প্রাসাদ, মায়া প্রভৃতির পালিশের তলায় তলায় একেবারে ‘র’ সামাজিক কাঠামোটিকে চিহ্নিত করার একটা চর্চা শুরু হল।